প্রতারিত ভোক্তারা অভিযোগ করে পেলেন ৭৫ লাখ টাকা

জহির রায়হান
 | প্রকাশিত : ২২ জানুয়ারি ২০১৯, ০৯:২৮

২০১৫ সালে বিদ্যুৎ বিলের সব টাকা পরিশোধ করলেও ২০১৮ সালের ৯ জানুয়ারি তিন হাজার ৭৭২ ইউনিটের বিল পরিশোধ করতে বলা হয় রামপুরার নন্দীপাড়ার রনি ইসলামকে। টাকার অঙ্কটা বেশ বড় ৩৮ হাজার ৮১৮ টাকা। বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা ডিপিডিসির সঙ্গে যোগাযোগ করে কাজ না হওয়ার পর রনি যান ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে।

এ ধরনের আরও বেশ কয়েকজন গ্রাহক আনেন ভুতুড়ে বিলের অভিযোগ। আর গ্রাহক হয়রানির প্রমাণ পাওয়ার পর ডিপিডিসিকে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।

চলতি বাণিজ্য মেলার ঘটনা। মিরপুরের কামরুন মোস্তফা ‘রিকো মার্কেটিং’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান তাকে ইতালীয় বলে গছিয়ে দেয় দেশি পণ্য। সন্দেহ জাগে মোস্তফার। সোজা চলে যান ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে।

সন্দেহ প্রমাণিত হয়। শুনানিতে জানা যায়, পণ্যটি আসলে দেশিই ছিল। স্বীকারও করে রিকো মার্কেটিং। জরিমানা করা হয় ৩০ হাজার টাকা। আইন অনুযায়ী এর ২৫ শতাংশ হিসেবে সাড়ে সাত হাজার টাকা পান অভিযোগকারী কামরুন মোস্তফা। বাকিটা জমা হয় রাষ্ট্রীয় কোষাগারে।

দামে, মানে, ওজনে ঠকে আসা ভোক্তারা গত প্রায় এক দশক ধরেই এভাবে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ জানানোর সুযোগ পাচ্ছেন। আর প্রতিকার মিলছে বলে অভিযোগের প্রবণতাও বাড়ছে। পরিসংখ্যান বলছে, প্রতিবছরই আগেরবারের চেয়ে বেশি মামলা হয়েছে। অর্থাৎ প্রতারণার শিকার ক্রেতারা আর চুপ করে বসে থাকছেন না।

২০০৯ সালে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন পাস হয় আর ২০১০ সালের ৬ এপ্রিল আইনটির বাস্তবায়ন শুরু করে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। গত ১২ জানুুয়ারি পর্যন্ত ৫২ হাজার ১০৮টি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে ভোক্তা ঠকানোয় জরিমানা করা হয়েছে।

অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০১০ থেকে গত ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রতারিত ভোক্তার ২১ হাজার ১৮৯টি লিখিত অভিযোগ জমা পড়েছে। এর মধ্যে অভিযোগ নিষ্পত্তি হয়েছে ১৮ হাজার ৮০৯টি। তদন্ত চলছে বাকি দুই হাজার ৩৮০টি।

আইন অনুযায়ী অভিযোগ প্রমাণিত হলে যে জরিমানা হয় তার ২৫ শতাংশ অভিযোগকারী পেয়ে থাকেন। যেসব মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে, তাতে জরিমানা হয়েছে ৪১ কোটি ১৫ লাখ এক হাজার টাকা। এর মধ্যে ভোক্তার অভিযোগে জরিমানা হয়েছে ৩০ কোটির মতো। আর অভিযোগকারীরা পেয়েছেন ৭৫ লাখ ৫৮ হাজার ৪২৭ টাকা।

তবে এখন পর্যন্ত অভিযোগ যা জমা পড়েছে তার সিংহভাগই রাজধানীর। ঢাকার বাইরে এখনো অভিযোগ দেওয়ার হার কম। আর সেখানে সচেতনতা বৃদ্ধির চেষ্টাও চলছে।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শফিকুল ইসলাম লস্কর ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আমরা সারা দেশের ভোক্তাদের সচেতন করতে চাই। দেখা যায়, এখন যে অভিযোগ আসছে সেগুলোর বেশির ভাগই রাজধানীর ভোক্তারা করছেন। আমরা এটা গ্রাম পর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে চাই। ভোক্তাদের তাদের অধিকার সম্পর্কে জানাতে আমরা কাজ করছি। তারা জানতে পারলে অভিযোগ আরও বেশি আসবে।’

ব্যবসায়ী রাফায়েত রোমান রাজধানী ঢাকার হাতিরপুলের একটি রেস্তোরাঁয় খাবার খেতে গিয়ে দেখলেন, এক বোতল কোমল পানীয়ের প্রকৃত দাম ১৫ টাকা। অথচ আদায় করা হচ্ছে ২৫ টাকা। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে রেস্তোরাঁ কর্তৃপক্ষ তাকে বলে এখানে এটাই হয়। পরে তিনি মূল্য রসিদ নিয়ে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে অভিযোগ করেন। শুনানি শেষে তার জয় হয়।

এ বিষয়ে রাফায়েত রোমান ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘ভোক্তারা সচেতন হলে অন্যায়, প্রতারণা অনেক কমে যাবে। এটা সব ক্ষেত্রেই। আমি অভিযোগ করেছি। কারণ ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর আমার অধিকার আদায়ের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।’

বাড়ছে অভিযোগের সংখ্যা

অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে, প্রথম তিন বছরে খুব বেশি অভিযোগ জমা পড়েনি। তবে যে কটি জমা পড়েছে, নিষ্পত্তি হয়েছে তার সব কটি।

২০১০ থেকে ২০১৩ অর্থবছরে অভিযোগ জমা পড়ে ১৭৯টি। ১৭ জন অভিযোগকারী পেয়েছেন ৫১ হাজার ৫০০ টাকা।

এর পরের প্রতিবছরই বাড়ছে অভিযোগ আর অভিযোগকারীর সংখ্যা। ২০১৪-১৫ সালে অভিযোগ জমা পড়ে ২৬৪টি। নিষ্পত্তি হয় সব কটি। এদের মধ্যে ১০৭ জন অভিযোগকারী ২৫ শতাংশ হিসেবে পেয়েছেন এক লাখ ৮৮ হাজার ৫০০ টাকা।

২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে অভিযোগ জমা পড়ে ৬৬২টি। অভিযোগকারীদের মধ্যে ১৯২ জন জরিমানার ২৫ শতাংশ হিসেবে পেয়েছেন দুই লাখ ৯৩ হাজার ৮৭৫ টাকা।

২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে অভিযোগের সংখ্যা বেড়ে হয় প্রায় দশ গুণ। সে সময় ছয় হাজার ১৪০টি অভিযোগের মধ্যে নিষ্পত্তি হয় সব কটি। আর অভিযোগ প্রমাণিত হওয়া এক হাজার ৪১৬ জন ভোক্তা জরিমানার ২৫ শতাংশ হিসেবে পেয়েছেন ১৫ লাখ ৫১ হাজার ৬৭৭ টাকা।

২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে অভিযোগের সংখ্যা আরও প্রায় ৫০ শতাংশ বাড়ে। ওই বছর জমা পড়ে মোট নয় হাজার ১৯টি অভিযোগ। নিষ্পত্তি হয় সব কটি। আর প্রমাণিত হওয়ার পর এক হাজার ৯৩৪ জন অভিযোগকারী জরিমানার ২৫ শতাংশ হিসেবে পেয়েছেন ৩৯ লাখ ৭২ হাজার টাকা।

২০১৮-২০১৯ অর্থবছরের ১৩ জানুয়ারি পর্যন্ত অভিযোগ জমা পড়েছে চার হাজার ৯২৫টি। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে দুই হাজার ৫৪৫টি। তদন্ত চলছে দুই হাজার ৩৮০টির। আর চলতি বছর এখন পর্যন্ত নিষ্পত্তি হওয়া মামলায় ৮৩১ জন অভিযোগকারী জরিমানার ২৫ শতাংশ হিসেবে পেয়েছেন ১৩ লাখ ৩৯ হাজার ৬২৫ টাকা।

এর বাইরে অধিদপ্তরের নিজের অভিযানেও মামলা হয়েছে বহু। এই অভিযানগুলো মূলত বাজার তদারকিতে গিয়ে হয়েছে। এ ধরনের মামলার সংখ্যা ১৪ হাজার ৭০৯।

অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (তদন্ত) মাসুম আরিফিন ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘যে অভিযোগগুলো এখনো নিষ্পত্তি হয়নি, সেগুলো কিছুদিন আগে দায়ের করা। আমরা দ্রুত এগুলো নিষ্পত্তি করব।’

কীভাবে নিষ্পত্তি হয় জানতে চাইলে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা দুই পক্ষকেই চিঠি দিয়ে শুনানির দিন ধার্য করি। তাদের বক্তব্য শুনে দোষীর ব্যাপারে ব্যবস্থা নিই। একটা অভিযোগ এলে দুই পক্ষকে একসঙ্গে করতে সাত থেকে আট দিন লেগে যায়। আর অভিযোগ যদি জটিল হয়, অন্য বিভাগের ওপর নির্ভর করে, তাহলে একটু সময় লাগে।’

ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘ভোক্তারা সচেতন হয়েছে এবং অভিযোগ দিয়ে প্রতিকার পাচ্ছে। এ কারণে মামলার সংখ্যাও বাড়ছে। একসময় ছিল ভোক্তারা জানতই না যে তাদের কোনো অধিকার আছে। আমরা চাই এমন সময় আসবে যে সময় কোনো প্রতিষ্ঠান আর ভোক্তাকে ঠকাবে না, সঠিকভাবে সেবাও দেবে তারা। সেটা হয়তো সময় লাগবে।’

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :