দুদকের অভিযানে ডাক্তার ফিরল হাসপাতালে

ঢাকা টাইমস ডেস্ক
| আপডেট : ২৩ জানুয়ারি ২০১৯, ১৩:৫০ | প্রকাশিত : ২৩ জানুয়ারি ২০১৯, ০৯:০৭

হাসপাতালে ডাক্তার থাকেন না এই চিত্র পাল্টে গেল এক দিনেই। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) এনফোর্সমেন্ট বিভাগের অভিযানে যেসব হাসপাতালে ডাক্তার দেখা যায়নি, পরদিন তার প্রতিটিতেই উপস্থিত থাকতে দেখা গেছে তাদের। ফলে রোগীরা ভালো সেবা পেয়েছেন।

সোমবার ঢাকার তিনটি কর্মচারী কল্যাণ হাসপাতাল, মা ও শিশুসদন ও মুগদা জেনারেল হাসপাতাল, ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা, টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার, রংপুরের পীরগাছা, রাজশাহীর গোদাগাড়ী, দিনাজপুর সদর হাসপাতাল, কুষ্টিয়ার কুমারখালী এবং পাবনার সদর ও আটঘরিয়া উপজেলা হাসপাতালে অভিযান চালায় দুদক। এর মধ্যে ঢাকায় কেবল মুগদা হাসপাতালে শতভাগ চিকিৎসকের উপস্থিতি দেখা গেছে।

সার্বিকভাবে চিকিৎসকের অনুপস্থিতির হার ছিল ৪০ শতাংশ। আর ঢাকার বাইরে হাসপাতালে না যাওয়া চিকিৎসকের সংখ্যা আরও বেশি। সাত জেলার হাসপাতালে ১৩১ জন চিকিৎসকের মধ্যে কাজে যাননি ৮১ জন, শতকরা হিসাবে যা প্রায় ৬২ শতাংশ।

এই চিত্র দেখে দুদক বিস্ময় প্রকাশ করে। সেই সঙ্গে অনুপস্থিত চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়।

এটি যে কেবল এক দিনের চিত্র নয়, সেটি সমন্বয়ক দুদকের মহাপরিচালক (প্রশাসন) মুনীর চৌধুরীর বক্তব্যেই স্পষ্ট। তিনি জানান, চিকিৎসকেরা মাসে একবার বা কয়েকবার গিয়ে সারা মাসের উপস্থিতি খাতায় সই করে আসেন।

চিকিৎসকদের এই প্রবণতার বিরুদ্ধে নানা সময় সরকারের পক্ষ থেকে হুঁশিয়ারির পাশাপাশি ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণাও আসে। এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বলেছেন, ‘হাসপাতালে না এলে চাকরি থাকবে না।’ কিন্তু গণমাধ্যমের প্রতিবেদন বলছে, কাজ হয় না তাতেও। বিশেষ করে, মফস্বল ও গ্রাম এলাকায় ডাক্তাররা গরহাজির থাকেন, ভোগেন রোগীরা।

তবে দুদকের অভিযানের পরদিনই হাসপাতালগুলোতে উল্টো চিত্র দেখা গেছে। সময়মতো সকাল আটটাতেই উপস্থিত হন চিকিৎসকেরা।

পাবনা থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক খাইরুল ইসলাম বাসিদ জানান, দুদকের অভিযানের দিন পাবনা জেনারেল হাসপাতালে ৪৯ জন চিকিৎসকের মধ্যে পরিচালকসহ ৩৫ জন চিকিৎসক অনুপস্থিত থাকলেও গতকাল তাদের সবাই কর্মস্থলে আসেন সময়মতো।

দুদকের অভিযানের পর সিভিল সার্জনেরও টনক নড়েছে। সকালে তিনি বেড়াসহ বেশ কিছু উপজেলা হাসপাতাল পরিদর্শন করতেও বের হন।

দুদকের পাবনা সমন্বিত কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক আতিকুর রহমান ঢাকা টাইমসকে জানান, সোমবার তারা হাসপাতালে কর্মরত ৪৯ জন চিকিৎসকের মধ্যে ১৪ জনকে উপস্থিত দেখতে পান। খবর পেয়ে হাসপাতালের সহকারী পরিচালকসহ কয়েকজন পড়িমরি করে ছুটে আসেন, তবে দেরিতে। আর এই বিলম্বের যথাযথ কারণ তারা দেখাতে পারেননি।

হাসপাতালের পরিচালক রঞ্জন দত্ত অবশ্য অনুপস্থিতির নানা যুক্তি দেখানোর চেষ্টা করেছেন। ঢাকা টাইমসকে তিনি বলেন, ‘অনেক সময় চিকিৎসকেরা জরুরি রোগী দেখতে ব্যস্ত থাকেন। চিকিৎসকেরা প্রায়ই হাসপাতালে উপস্থিত হয়ে তারা গুরুতর রোগী দেখতে ছুটে যান, যার কারণে সময়মতো তারা সরকারি হাজিরা প্রতিপালন করতে পারেন না। আবার অনেকের ব্যক্তিগত কারণেও দেরি হতে পারে। তার মানে এই নয় যে তারা অনুপস্থিত।’

এমনটিই যদি হবে তাহলে দুদকের অভিযানের পরদিন কেন শতভাগ চিকিৎসক উপস্থিত, সে প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি হাসপাতালের পরিচালক।

হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা এক রোগীর অভিভাবক আকবর আলী জানান, কেবল চিকিৎসকের উপস্থিতি বাড়েনি, সেবাও ভালো পেয়েছেন তারা। বলেন, ‘সাত দিন আগে রোগী ভর্তি করেছি। গতকাল পর্যন্ত বাহির থেকে ওষুধ কিনতে হয়েছে। কিন্তু আজ হাসপাতাল থেকেই ওষুধ দেওয়া হয়েছে তার রোগীকে।’

পাবনা নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি নরেশ মধু বলেন, ‘দুদক থেকে যে অভিযান শুরু হয়েছে, এতে কিছুটা হলেও পরিবর্তন আসবে। কিন্তু দেশে যে উদ্যোগই নেওয়া হয় তার কোনো ধারাবাহিকতা থাকে না। নিয়মিত তদারক করা হলে শুধু স্বাস্থ্য বিভাগ নয়, সব ক্ষেত্রেই পরিবর্তন আসবে।’

রাজশাহীর গোদাগাড়ী হাসপাতালের চিত্রও একই রকম। এই হাসপাতালে শনিবার ভর্তি হওয়া কাঁঠালবাড়িয়া গ্রামের শঙ্কর রজ জানান, হাসপাতালে ভর্তির পর গতকাল সকালেই প্রথম একজন চিকিৎসক তার খোঁজ নিয়েছেন।

রাজশাহী ব্যুরো প্রধান রিমন রহমান জানান, এই হাসপাতালে এমবিবিএস চিকিৎসক তিনজন। তারা হলেন শারমিন আক্তার, শাহেদা নাসরীন ও মেসবাউল আলম। তাদের থাকার জন্য হাসপাতালটিতে সরকারি কোয়ার্টারও রয়েছে। কিন্তু কেউ থাকেন না। সবাই রাজশাহী শহর থেকে হাসপাতালে যান।

স্থানীয়রা জানান, এত দিন বহির্বিভাগে বেশির ভাগ সময় একজন এবং কখনো কখনো দুজন চিকিৎসক রোগীদের সেবা দিয়েছেন। কিন্তু একসঙ্গে তিনজনের দেখা কখনো পাননি রোগীরা। তবে আগের দিন দুদকের অভিযানের পর গতকাল তাদের তিনজনই একসঙ্গে কাজ করেছেন। সকাল সকাল তারা হাসপাতালে গেছেন। বহির্বিভাগে বসে তারা সেবা দিয়েছেন। ভর্তি রোগীদেরও খোঁজখবর নিয়েছেন।

তবে দুদক ঘটা করে জানালেও তাদের অভিযানের কথা বেমালুম অস্বীকার করেছেন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মেসবাউল হাসান খান। তিনি বলেন, চিকিৎসকদের হাসপাতালে রাখার জন্য তিনি চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

রাজশাহীর সিভিল সার্জন সঞ্জিত কুমার সাহাও বলেছেন, দুদকের অভিযানের বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না। তবে দুদক কোনো লিখিত প্রতিবেদন দিলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

দিনাজপুর থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক শাহ্ আলম শাহী জানান, জেলা সদরের প্রধান চিকিৎসালয় জেনারেল হাসপাতাল এমনিতেই চিকিৎসক-স্বল্পতায় ভুগছে। ৫৮ জন চিকিৎসক প্রয়োজন থাকলেও ৩৩টি পদ শূন্য। বাকি ২৫ জনের মধ্যে দুদকের অভিযানের সময় অনুপস্থিত ছিলেন ১০ জনের মতো।

দুদকের দিনাজপুরের উপপরিচালক বেনজির আহমেদ জানান, সহকারী পরিচালক আহসানুল কবীর পলাশের নেতৃত্বে অভিযানে চিকিৎসকদের ৪০ ভাগকেই হাসপাতালে পাওয়া যায়নি।

তবে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক আহাদ আলীর সাফাইয়ের শেষ নেই। তার দাবি, চিকিৎসকেরা হাসপাতালে উপস্থিত হলেও উপস্থিতি খাতায় সই না করায় দুদকের কাছে অনুপস্থিতি ধরা পড়ে।

ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা হাসপাতালেও বদলে যাওয়ার চিত্র দেখেছেন ব্যুরো প্রধান মনোনেশ দাস। এই সরকারি চিকিৎসালয়ে দুদকের সোমবারের অভিযানে ১২ জন চিকিৎসকের মধ্যে কাজে পাওয়া যায়নি একটি বড় অংশকে।

রোগীরা জানান, এটা নিয়মিত চিত্র। এর চেয়েও কম চিকিৎসক থাকেন কখনো কখনো। আর কাজে না আসার বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যাও দেওয়া হয় না তাদের। জিজ্ঞেস করলে দুর্র্ব্যবহারও করা হয়।

গতকাল হাসপাতালে গিয়ে সব চিকিৎসককে উপস্থিত দেখে অবাক হয়েছেন রোগীরাই। এদের একজন সাগর আলী। তিনি ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আজকে (গতকাল) ডাক্তার পাওয়া গেছে। হাসপাতাল ছিল কর্মচঞ্চল।’

দুদক পুরো কর্মঘণ্টা উপস্থিত থেকে চিকিৎসকদের না পেলেও ঢাকা টাইমসের সঙ্গে আলাপকালে জরুরি বিভাগে দায়িত্ব পালন করা আলী রেজা সিদ্দিকী বলতেই পারেননি কখন দুদকের দল এসেছিল। আর অনুপস্থিতির বিষয়টিও বেমালুম অস্বীকার করেছেন তিনি। বলেন, ‘ইমার্জেন্সি বিভাগে আমরা চারজনই উপস্থিত ছিলাম।’

একই দাবি করেছেন মুক্তাগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মীর আনোয়ার হোসেনও। দুদকের তথ্যের বিপরীতে গিয়ে তার দাবি, পরিদর্শনকালে একজন চিকিৎসক দেরিতে এসেছেন। আর সে সময় তিনি সিভিল সার্জনের অফিসে ভিডিও কনফারেন্সে ছিলেন। বাকি সবাই সব সময় নিয়মিত সেবা দেন।

দুদক যা বলছে

হাসপাতালে অনুপস্থিত চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবেÑজানতে চাইলে দুদকের মহাপরিচালক (প্রশাসন) মুনীর চৌধুরী ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘হাসপাতালে চিকিৎসকের অনুপস্থিতির বিষয়টি মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি। এখন আমরা লিখিত আকারেও অভিযোগ দাখিল করব। আমাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে।’

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক চান দুদক এই ধরনের অভিযান অব্যাহত রাখুক। ঢাকা টাইমসকে তিনি বলেন, ‘সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সময়মতো কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকা অসদাচরণ। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হলে অবশ্যই এটা কমে যাবে। কোনো ডাক্তার হাসপাতালে অনুপস্থিত থাকলে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া যায়। তার পদোন্নতি, ইনক্রিমেন্ট ও বরখাস্ত করা যায়। ব্যবস্থা গ্রহণ করলে এগুলো কমে যাবে।’

সংবাদটি শেয়ার করুন

জাতীয় বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :