দোষ মাহফুজ আনামের একার!

প্রকাশ | ৩০ আগস্ট ২০১৬, ১৭:৪২

আরিফুর রহমান

এক মাস ধরে বিছানায় শুয়ে আছি। কাতরাচ্ছি। বাঁ পায়ে প্রচণ্ড যন্ত্রণা। গত ২০ জানুয়ারি সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হওয়ার পর বাঁ পায়ে অস্ত্রোপচার করতে হয়। খবরের কাগজ, টেলিভিশন এবং বাইরের জগতের সঙ্গে প্রায় বিচ্ছিন্ন আমি। ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামকে নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়ি খোদ আমার অস্ত্রোপচার করেছেন যিনি সেই শল্যচিকিৎসকের কাছে। মাহফুজ আনামকে নিয়ে কী হচ্ছে? কেন হচ্ছে? পায়ের ড্রেসিং করতে করতে প্রশ্ন ছোড়েন ডাক্তার মেজবাহ উদ্দিন। উত্তর দিতে পারিনি। বলি, আমার জানা নেই। বিড়বিড় করে শল্যচিকিৎসক বলতে থাকেন, যা হচ্ছে তা কি ঠিক হচ্ছে? নিশ্চুপ থাকি। বাঁ পায়ের প্রচণ্ড যন্ত্রণা নিয়েও কৌতূহল হয় কী ঘটনা? কয়েক দিনের পুরনো পত্রিকা আনাই অফিস থেকে। এটিএন নিউজে মুন্নি সাহার সঙ্গে কথোপকথনে মাহফুজ আনামের ভুল স্বীকার সম্পর্কে অবগত হই। ১/১১-এর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে ‘দুর্নীতিপরায়ণ’ দেখাতে ডেইলি স্টার পরিবেশিত খবরের জন্য সম্পাদক মাহফুজ আনামের বিলম্বিত অনুতাপের বিষয়ে জানতে পারি। ওই সময় মাহফুজ আনাম সম্পাদিত পত্রিকাটি দেশের সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দলের সভানেত্রীর তথাকথিত দুর্নীতি নিয়ে যে খবর প্রকাশ ও প্রচার করেছিল তা ছিল ইচ্ছাকৃত ভুল।

ইচ্ছাকৃত ভুল অবশ্যই অপরাধ। ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম ইচ্ছাকৃতভাবেই ভুল করেছেন এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে দেরিতে হলেও সেই ভুল স্বীকার করে তিনি বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় একটি নতুন উদাহরণও সৃষ্টি করেছেন বটে। ইচ্ছাকৃতভাবে বারবার ভুল করলে অবশ্যই সেই অপরাধকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। কিন্তু প্রথমবারের ‘ইচ্ছাকৃত ভুল’ এবং সেই ভুল স্বীকার বড় অপরাধের পর্যায়ে পড়ে কি! মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে সারা দেশে যারা মানহানির মামলা করছেন তাদের উদ্দেশ্য কী? বিভিন্ন জেলায় আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা পরিচয়ধারীরা কি কারো অনুমতি নিয়েছেন? রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতির প্রয়োজন হয়। আর মানহানির মামলায় যার মানহানি হয়েছে তাকেই অভিযোগ দিতে হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কোনোটাই অনুসরণ করা হচ্ছে না। মামলাবাজরা বিশেষ কোনো সুবিধা ভোগের আশায় অতি উৎসাহ নিয়ে এসব করছেন বলেই আমার ধারণা। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের সুস্পষ্ট অবস্থান থাকাও প্রয়োজন। এ জন্য যে, ১/১১-এর সময়ে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের তথাকথিত ‘রাজনৈতিক শুদ্ধি অভিযান’ তৎপরতাকে যারা সব রকম সমর্থন দিয়েছেন, তারা তাহলে বাদ যাবেন কী কারণে? ‘ইচ্ছাকৃত ভুল’ মাহফুজ আনাম একা করেছেন? তা তো নয়। গণমাধ্যমের একাধিক সম্পাদক, সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতা, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবীসহ সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃস্থানীয়রা অতি উৎসাহী হয়ে অথবা চাপে পড়ে বঙ্গবন্ধু-তনয়াকে হেয়প্রতিপন্ন করার চেষ্টায় নেমেছিলেন।

একই চেষ্টা বিএনপির চেয়ারপারসনের ক্ষেত্রেও ছিল। দুই নেত্রীকে রাজনীতি থেকে বিদায় দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে পত্রিকায় প্রতিষ্ঠিত সম্পাদক যেমন কলাম লিখেছেন, তেমনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ধারক-বাহক পরিচয়দানকারী কতিপয় সাংবাদিকও নানাভাবে শেখ হাসিনা-খালেদা জিয়াকে কটাক্ষ করে নানা সংবাদ পরিবেশনসহ নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে নিজেদের জড়ান। ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে দিয়ে রাজনৈতিক দল গঠনের পেছনে কারা ছিলেন? মাহফুজ আনাম একা? এদের কেউ কেউ দিব্বি গণভবনে বিভিন্ন আয়োজনে আমন্ত্রণ পান, বুক চিতিয়ে আওয়ামী লীগ ও সরকারের হিতাকাঙ্ক্ষী পরিচয়ও দেন। মাহফুজ আনাম তো ভুল স্বীকার করেছেন। সাংবাদিকতা পেশার অন্য কেউ কি ১/১১-এর সময় তাদের অপতৎপরতার জন্য ভুল স্বীকার করেছেন? করেননি। অথচ যিনি ভুল স্বীকার করলেন, কার্যত ক্ষমা চাইলেন, তাকে চেপে ধরা হচ্ছে। এসব কিসের আলামত?

সম্প্রতি বেসরকারি এক টেলিভিশনের টক শোতে বঙ্গবন্ধুর ছোট মেয়ে শেখ রেহানার স্বামী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. শফিক সিদ্দিক যথার্থই বলেছেন, যদি ১/১১-এর অপতৎপরতার সহযোগীদের বিচার বা শাস্তির প্রশ্ন আসে, তাহলে তালিকায় অনেকেই আসবেন। তিনি আওয়ামী লীগের একজন নেতার উদাহরণ দিয়েছেন যিনি তথাকথিত কিংস পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন। ১/১১-এর সময় আমার কর্মস্থল ছিল প্রথম আলো। একদিনের ঘটনা বলি- সম্পাদক মতিউর রহমান দুপুরের ঠিক আগে আগে বার্তা বিভাগ ও রিপোর্টিং বিভাগের কিছু সাংবাদিককে নিয়ে বৈঠক করছিলেন কীভাবে পত্রিকার নিউজ আরো ভালো করা যায় এসব নিয়ে। এমন সময় সম্পাদকের মুঠোফোন বেজে উঠল। ইশারায় সম্পাদক আমাদের সবাইকে চুপ থাকতে বললেন। জি... ভাই (সংগত কারণে নাম উল্লেখ করছি না)। অপর প্রান্তে  আওয়ামী লীগের শীর্ষ এক নেতা, মুহূর্তেই বুঝে গেলাম। ওই নেতা সম্পাদককে বলতে চাইলেন, কিছুক্ষণের মধ্যে তিনি আওয়ামী লীগের সংস্কার বিষয়ে তার প্রস্তাব সংবাদ সম্মেলন করে জানাবেন। তবে এটি তিনি স্বেচ্ছায় করছেন না, করতে হচ্ছে চাপে পড়ে। বাধ্য হয়ে।

জীবনের শেষ প্রান্তে এসে হুমকি-ধমকি, ভীতি প্রদর্শন আর সহ্য করতে পারছেন না বলেই সংস্কার প্রস্তাব পেশ করতে হচ্ছে বলে সম্পাদককে নিজের কষ্টের কথা জানালেন। যা আলোচনা শেষে সম্পাদক আমাদের বললেন। আওয়ামী লীগের সেই নেতা এখন সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী। তিনি প্রকাশ্যে কখনো ভুল স্বীকার করেছেন এমনটি শুনিনি। আড়ালে-আবডালে অথবা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে ভুল স্বীকার, ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকলেও থাকতে পারেন। তার মতো অনেকেই এখন সরকারের মন্ত্রী, এমপি এবং আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন, যারা স্বেচ্ছায়, চাপে পড়ে অথবা অন্য কোনো কারণে দলের সভানেত্রীকে এবং আওয়ামী লীগকে ক্ষতিগ্রস্ত করার চেষ্টায় কোনো না কোনোভাবে শামিল ছিলেন। বিস্ময়করভাবে ৭-৮ বছর পর সব দায়ভার এসে পড়ছে একটি ইংরেজি দৈনিকের সম্পাদকের ওপর। মাহফুজ আনাম প্রতিষ্ঠিত, সফল সম্পাদক সন্দেহ নেই। ডেইলি স্টার বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি প্রচারিত ইংরেজি দৈনিক এটাও ঠিক। তবে প্রচারসংখ্যা যে কোনোভাবেই ৫০ হাজারের বেশি নয়, এটাও ঠিক।

দেশের তৃণমূল পর্যায়ে ডেইলি স্টারের যে পরিচিতি ছিল না, মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা করে তা কয়েক হাজার গুণ পরিচিতি লাভ করেছে। এটা ডেইলি স্টারের জন্য মন্দের ভালো কি না জানি না। তবে এটা বুঝি, এভাবে একের পর এক মামলা একজন সম্পাদক, প্রকাশক, সাংবাদিকের ওপর কত বড় মানসিক চাপ সৃষ্টি করে। গোটা সাংবাদিকতাকেই চাপে ফেলে দেয়। এতে কার লাভ! গণতান্ত্রিক শক্তি সম্পর্কে বহির্বিশ্বে যদি কোনো নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয় তাহলে সেটা কি বর্তমান সরকার ও আওয়ামী লীগের জন্য ভালো কিছু? বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যম ইতিমধ্যে এ বিষয়ে তাদের পর্যবেক্ষণ দিচ্ছে। সেই পর্যবেক্ষণ সাংবাদিকতার পক্ষে, মাহফুজ আনামের পক্ষে, কিছুটা হলেও সরকারের বিপক্ষে। আশা করব সরকারের শীর্ষপর্যায় থেকে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া হবে। মাহফুজ আনামের ভুল স্বীকারকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করে সরকার ও আওয়ামী লীগ যদি কোনো সুস্পষ্ট বক্তব্য দেয় তাহলেই বিষয়টির সহজ সমাপ্তি হতে পারে। না হলে মাহফুজ আনাম হয়রানি হবেন সত্য, কিন্তু বাংলাদেশের গণমাধ্যম যে চাপের মুখে- এই প্রচারই জোরালো হবে যা সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত করবে। একজন সংবাদকর্মী হয়ে এ বিষয়ে খুব হতাশ লাগছে আমার।

ইতিমধ্যে সম্পাদক পরিষদ মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে। এ সম্পাদকদের মধ্যে কয়েকজন সরকারের অতি ঘনিষ্ঠজন বলেই পরিচিত। সর্বজনশ্রদ্ধেয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানসহ দেশের বেশ কিছু বুদ্ধিজীবীও মাহফুজ আনামের পক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন। বিবৃতিদাতাদের প্রত্যেকেই মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি বলে পরিচিত। তাহলে বিষয়টা কী দাঁড়াচ্ছে। এতে একটু একটু করে মাহফুজ আনামের নৈতিক জয়ই হচ্ছে। এসব সাংবাদিকতার টুটি চেপে ধরার চেষ্টার প্রতিবাদ নয় কি!

ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতির অনেক বিষয় নিয়ে আমরা প্রকাশ্যে সমালোচনা করেছি, করছি। হয়তো ভবিষ্যতেও করব। কিন্তু একজন মাহফুজ আনামকে বিপদগ্রস্ত করতে গিয়ে গোটা সাংবাদিকতাকে বিপদগ্রস্ত করার চেষ্টা কখনোই সমর্থন করব না।    

২০১৩ সালের ২২ মে অগ্রজ সাংবাদিক শাজাহান সরদার, আমি ও দৈনিক মানবকণ্ঠের প্রকাশক জাকারিয়া চৌধুরী তৎকালীন মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকীর আক্রোশের শিকার হয়েছিলাম। লতিফ সিদ্দিকী ঢাকায় আমাদের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেছিলেন নিজে বাদী হয়ে। টাঙ্গাইলে তার এক চেলাকে দিয়েও মামলা করানো হয়। ঢাকার মামলায় আমাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছিল। প্রথমে উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন পাই। লম্বা সময় ধরে মামলা চলে। এক বছরের বেশি ঢাকা ও টাঙ্গাইল আদালতে দিনের পর দিন হাজিরা দিয়েছি। একপর্যায়ে মন্ত্রীর পক্ষ থেকে আপসের প্রস্তাবও পাই। আমরা আপস হইনি। হাজিরা দিতে দিতে মন্ত্রী বিরক্ত হয়েছেন।

মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে আমাদের অনুকূলেই। দুই মামলার কষ্টের দিনগুলোর কথা খুব মনে আছে। মাহফুজ আনাম কয়েক ডজন মামলার আসামি। স্বাভাবিক নিয়মে তাকে আদালতে হাজিরা দিতে হবে। যদি রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে হস্তক্ষেপ হয় তাহলে হয়তো হয়রান হওয়া থেকে নিষ্কৃতি পেতে পারেন তিনি। এতে সরকারেরই লাভ। গণমাধ্যমের ওপর বেশি চাপ প্রয়োগ কখনোই ভালো ফল দেয়নি। আমাদের ভুল-ত্রুটি সংশোধনের সুযোগ আছে, অন্যভাবে তা হতে পারে। মামলা দিয়ে, হামলা করে, চাপ প্রয়োগ করে নয়।