বইঃ আমার কথা

‘আদর্শ জীবন গঠনে মূল্যবোধ’

প্রকাশ | ১৫ নভেম্বর ২০১৬, ১০:২৫ | আপডেট: ১৫ নভেম্বর ২০১৬, ১০:৫৭

অনলাইন ডেস্ক

সৈয়দ আবুল হোসেন বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন। সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে আমার কথা। এই বইয়ে তিনি নিজের চিন্তা, কর্মকান্ড, মূল্যবোধ, নানা অভিজ্ঞতা ও পরিকল্পনা সম্পর্কে লিখেছেন।
এটি পড়লে তাকে যারা পুরোপুরি চিনেন না তাদের সুবিধা হবে। বইটি ঢাকাটাইমস২৪ডটকম ধারাবাহিকভাবে ছাপছে। আজকের পর্বে থাকছে ‘আদর্শ জীবন গঠনে মূল্যবোধ’।

আমার বাবা ছিলেন একজন খাঁটি মুসলমান। ধর্মীয় মূল্যবোধে ছিল তাঁর অগাধ বিশ্বাস। তিনি তাঁর সব কাজের মধ্য দিয়ে সততা, ন্যায় এবং সত্যকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি সকল সম্প্রদায়ের মানুষকে ভালবেসেছেন। তিনি সবাইকে আপন করে নিয়েছিলেন। আমার পিতার এ ইতিবাচক চিন্তা তাঁকে অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তি হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেছে। আমরা ভাইবোনেরা পিতার এমন উদার শিক্ষায় বড় হয়েছি। বাবার অনুসরণীয় মূল্যবোধ আমরা ধারণ করেছি। সেই পঞ্চাশের দশকে মানুষ ভালোকে ভালো বলে গ্রহণ করেছেন। মন্দকে ঘৃণা করেছেন। মন্দ কখনও ভালোকে ছাপিয়ে যেতে পারেনি। ফলে সমাজে ভালো দিকটা উচ্চকিত হয়েছে। এতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে মানবিক মূল্যবোধ।

মূল্যবোধ মানুষকে ভালো হতে শেখায়। মন্দকে চিনতে শেখায়, মন্দ থেকে দূরে থাকতে সাহায্য করে। মূল্যবোধ সততা ও সৎ হতে উৎসারিত একটি স্বর্গীয় প্রত্যয়- যা ব্যক্তিকে মানবিকবোধে উজ্জীবিত করে। মানুষকে ন্যায়পথে পরিচালিত করে।

বর্তমানে আমরা প্রায়শ মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কথা শুনি। সমাজ, রাষ্ট্র, অর্থনীতি ও রাজনীতির অবক্ষয়ের কারণ হিসাবে মূল্যবোধের অভাবের কথা বলতে শুনি। রেডিও, টিভির আলোচনা, সভা-সেমিনারে বক্তৃতা-বিবৃতি সর্বত্র মূল্যবোধের অবক্ষয় জাতিকে অধঃপতনের দিকে ধাবিত করছে- একথা বুদ্ধিজীবী ও দেশের বোদ্ধা নাগরিকদের বলতে শুনি। দেশে দুর্নীতির প্রসার ও বিচারহীনতার কথা শুনি। অত্যাচার, অনাচার, মারামরি এবং অন্যায়ভাবে দ্রুত বড়লোক হওয়ার প্রতিযোগিতার কথা শুনি। আমরা দেখি, সমাজ নৈরাজ্যের দিকে যাচ্ছে। সমাজে ও রাষ্ট্রে ন্যায়কে দাবিয়ে অন্যায় প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। ভালোকে সরিয়ে মন্দ জায়গা করে নিচ্ছে। সততাকে কাঁদতে দেখি। অসৎ ব্যক্তিকে সমাজে বুক ফুলিয়ে হাসতে দেখি। রাজাকারকে ‘শহিদ’ বলতে শুনি। মুক্তিযোদ্ধাকে সমাজে নিগৃহীত হতে দেখি। অপমান লুকাতে মুক্তিযোদ্ধাকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে দেখি। বোদ্ধাজনেরা বলেন, এসব আমাদের সার্বিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের ফসল। আমরা যারা ভালো, তারা সবাই এর প্রতিকার চাই- সত্যকে প্রতিষ্ঠিত দেখতে চাই। কিন্তু প্রতিকার পাই কি? পাই না। কারণ, আজকের দিনে মূল্যবোধ ও মানবিকতার অভাব খুব বেশি।

মূল্যবোধ মানুষকে ভালো হতে শেখায়। মন্দকে চিনতে শেখায়, মন্দ থেকে দূরে থাকতে সাহায্য করে। মূল্যবোধ সততা ও সৎ হতে উৎসারিত একটি স্বর্গীয় প্রত্যয়- যা ব্যক্তিকে মানবিকবোধে উজ্জীবিত করে। মানুষকে ন্যায়পথে পরিচালিত করে। বিশেষ করে, মানুষকে সৎবুদ্ধি ও মানবতার সেবায় উদ্বুদ্ধ করে। প্রশ্ন জাগে, তাহলে মূল্যবোধ কী? এককথায় বলা যায়, Values বা মূল্যবোধ হলো মানুষের সর্বজনীন আচরণ। সত্য, ন্যায় ও ভালবাসা- এ মূল্যবোধের বহিঃপ্রকাশ। এগুলো মানুষের মানবিক গুণ (Human values)। এ মূল্যবোধ কালের আবর্তেও পরিবর্তন হয় না। অধিকাংশ সমাজ এ গুণগুলোকে, এ ভালো আচরণগুলোকে শাশ্বত হিসাবে লালন করে। এ মূল্যবোধ সর্বসমাজে সর্বজনস্বীকৃত। 

সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্রমবিকাশে আরও কিছু ইতিবাচক কাজ- এ মূল্যবোধের সাথে সংযুক্ত হয়েছে। বর্তমান সমাজে কিছু ধারণা যেমন- ইক্যুইটি, সোশ্যাল জাস্টিস, দেশপ্রেম, স্বাধীনতা, নাগরিকত্ব, শ্রমের মর্যাদা, ধৈর্যশীলতা, নারী ও বয়স্কদের প্রতি সম্মান এবং দরিদ্রদের প্রতি দয়া- এসবও সর্বজনীন মূল্যবোধের আওতাভুক্ত বলে বিবেচিত। সমাজ এবং রাজনীতিক পরিবেশের কারণে আরও কিছু মূল্যবোধের উদ্ভব হতে দেখা যায়। যেমন- কমিউনিজম, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র; এমনকি একনায়কতন্ত্রের কারণেও কিছু মূল্যবোধের অস্তিত্ব দেখা যায়। অধিকন্তু রয়েছে আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ (Spiritual values)। মানুষকে সম্প্রীতির মাঝে প্রশান্তিতে বসবাস ও বিকাশের জন্য এ মূল্যবোধ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সমাজ-সংসার কিংবা রাষ্ট্র বা জাতিতে জাতিতে হানাহানির অন্যতম কারণ মূল্যবোধের অবক্ষয়। তাই মূল্যবোধের যে কোনো বিচ্যুতি সমাজে ভারসাম্যহীনতার জন্ম দেয়। মূল্যবোধহীনতা সমাজে অন্যায়, অত্যাচার বৃদ্ধি করে। আমরা যদি ভালো হতে চাই, তাহলে সর্বজনীন মূল্যবোধে ফিরে যেতে হবে। মন্দ পথ পরিহার করে ন্যায়ের পথ প্রশস্ত করতে হবে। ন্যায়ের পথ ও ভালো কাজ প্রভৃতি আমাদের মনের প্রশান্তি ও শান্তি আনতে পারে। 

সমাজে ‘নৈতিকতা’ শব্দটি বহুল প্রচলিত। ভালো কাজের সাথে নৈতিকতা শব্দটি সম্পর্কিত। এ নৈতিকতা আবার মূল্যবোধ থেকে উৎসারিত। নৈতিকতা মানে ব্যবহার (Manner), চরিত্র (Character) এবং যথাযথ আচরণ (Proper behaviour)।  নৈতিকতা বলতে সাধারণত Code of Conduct- কে বোঝায়, যা আয়ত্ত করে একজন ব্যক্তি, দল বা সমাজ, সত্য ও মিথ্যাকে পার্থক্য করতে শেখে এবং যার দ্বারা সত্যকে এগিয়ে নেওয়া যায়। মূল্যবোধ অর্জনে আমাদের ধর্ম ইসলাম পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছে। ইসলাম একটি সম্পূর্ণ জীবনব্যবস্থা হিসাবে নৈতিকতা ও মূল্যবোধকে সমন্বয় করে মানুুষের জীবনকে ভালোর দিকে নিয়ে যায় এবং মন্দ বর্জনের পথ দেখায়। আমরা বর্তমানে যে সমাজে বাস করি সেখানে ভালো ও মন্দ বিদ্যমান। ইসলাম শুধু ভালোকে মূল্যবোধ হিসাবে চিহ্নিত করে এবং সমগ্র মানবজাতিকে মূল্যবোধ অর্জন ও সত্যের পথ দেখায়। 

ভালো ও মন্দ দুটো বিশেষণ। ভালো কাজ হলো যা বিভিন্ন ধারণা যেমন- মূল্যবোধ, সদ্গুণ, আদর্শ, ন্যায়বিচার, কল্যাণ ইত্যাদির সাথে সম্পর্কিত। পক্ষান্তরে, মন্দ কাজ ভালো ধারণার সম্পূর্ণ বিপরীত অর্থবোধক। এ ভালো ও মন্দের পার্থক্যকরণে ইসলামের দৃষ্টিকোণের বাইরেও বিভিন্ন ধর্ম ও কালচারে এ ধারণা প্রতিফলিত হয়। তারা মনে করে ভালো অর্থ- সততা (Honesty), সত্য বলা (Truth),  দয়া (Charity)। অন্যদিকে, মন্দ অর্থ- প্রতারণা, চুরি, মিথ্যা বলা প্রভৃতি। অবশ্য তাদের মনোভাবের সাথে মদ্যপান, যৌন স্বাধীনতা, হিজাব ইত্যাদি বিষয়ে ইসলামের পার্থক্য রয়েছে।

বাংলাদেশের সিংহভাগ মানুষ ধর্মপ্রাণ। ধর্মান্ধের সংখ্যা খুব কম। আমাদের দেশের মুসলমান অন্যান্য দেশের মানুষের চেয়ে অনেক বেশি উদার ও সহনশীল।

আমরা জানি, ইসলাম একটি সর্বজনীন ধর্ম। মানবতার ধর্ম। ইসলাম সমগ্র মানবজাতির ধর্ম। ইসলাম ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব দেয়। এই উন্নয়নের জন্য দরকার ধৈর্য ও সংগ্রাম। এ সংগ্রাম হবে অবিচার, মন্দ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে। অসত্যের বিরুদ্ধে। কূপম-ূকতার বিরুদ্ধে। এই সংগ্রাম হবে মানুষের নৈতিকতা ও জাগতিক কল্যাণের জন্য। সত্যের জন্য, ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য, মানুষের উন্নত জীবনযাপনের জন্য। আল্লাহর পথে কাজ করার জন্য। ইসলামে উন্নয়নের অর্থ- সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা, শান্তি স্থাপন করা, মানুষের জন্য মৌলিক চাহিদা পূরণ করা এবং সমাজের অগ্রগতি সাধন করা। সার্বিকভাবে মানুষের শারীরিক, মানসিক ও আত্মিক উন্নয়ন করা।
 
বাংলাদেশের সিংহভাগ মানুষ ধর্মপ্রাণ। ধর্মান্ধের সংখ্যা খুব কম। আমাদের দেশের মুসলমান অন্যান্য দেশের মানুষের চেয়ে অনেক বেশি উদার ও সহনশীল। আমার এলাকার অনেক মুসলিম হিন্দুসম্প্রদায়ের বিভিন্ন পূজায়, হিন্দু বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে আমার কাছে সহায়তা প্রদানের অনুরোধ নিয়ে আসেন। আমি যথাসাধ্য সহায়তা করি। এমন অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধ ও ধর্মীয় সম্প্রীতি পৃথিবীর খুব কম দেশে আছে। ভারতে সম্প্রতি গরুর মাংস খাওয়া-না খাওয়া বিতর্ক আমাকে ভীষণভাবে কষ্ট দিয়েছে। ভারতের বিদগ্ধ সমাজকেও কষ্ট দিয়েছে। অনেক কবি-সাহিত্যিক ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার প্রতিবাদস্বরূপ ভারত সরকার প্রদত্ত তাদের খেতাব বর্জন করেছেন। একবিংশ শতকে এসে মানুষ এসব কী করছে! আমার একটা কথা মনে পড়ে। রাজীব গান্ধী (১৯৪৪-১৯৯১) তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। আমি ত্রিবান্দামের এক হোটেলে ছিলাম। গরুর মাংস খেতে ইচ্ছে হলো। এক বাবুর্চিকে বললে, তিনি নিজেই আমার জন্য বিফস্টিক বানিয়ে আনলেন। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, ওই বাবুর্চি ছিলেন হিন্দুধর্মাবলম্বী। সেটি সম্ভবত, ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারির ঘটনা। এখন ২০১৫। এ বছর গরুর মাংস খাওয়া-না-খাওয়া বিতর্কে মানুষ খুন হলো। পঁচিশ বছর সময় এগিয়েছে কিন্তু ভারতের ক্ষমতাসীনদের রাজনীতি কি এগিয়েছে, নাকি পিছিয়েছে? কোথায় নেমে গিয়েছে ভারতের অসাম্প্রদায়িকতা, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও মানবিক মূল্যবোধ! আমরা অনেক ক্ষেত্রে ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছি। বিশ্বশান্তির জন্য এমন সাম্প্রদায়িক কর্মকা- ও চিন্তা-চেতনা হতে আমাদের দূরে থাকা আবশ্যক। 

আল্লাহর প্রতি যে ব্যক্তির প্রতিনিয়ত আত্মসমর্পণ করার ইচ্ছা, তাগিদ এবং ভয় রয়েছে- সে ব্যক্তি কখনও অন্যায় কাজ করতে পারে না।

এ কথা সত্য যে, আদর্শবান মানুষ হতে হলে তার সামনে কিছু অনুকরণীয় বিষয় থাকে, তা তিনি যে-ধর্মের অনুসারীই হোন না কেন। এই অনুকরণীয় বিষয়গুলো, নৈতিক মূল্যবোধগুলো তার পার্থিব এবং অপার্থিব সকল জীবনের ক্ষেত্রেই প্রয়োজন। আমরা মুসলমান। আমাদের সামনে রয়েছে আল্লাহ-প্রদত্ত বিধিবিধানÑ যা আল্লাহপাক পবিত্র কোরানের বিভিন্ন স্থানে বর্ণনা করেছেন। মহানবি হযরত মুহম্মদ (স.) আল্লাহপাকের নির্দেশিত কোরানের আলোকে জীবন গঠনের তাগিদ দিয়েছেন। আমাদের সামনে একদিকে যেমন কোরানের মহান বাণী রয়েছে, অপরদিকে রয়েছে মহানবি (স.)-এর হাদিস। সুতরাং মানুষের চরিত্র গঠন, সামাজিক কর্তব্যপরায়ণতা এবং পরকালের নিরন্তর শান্তি অর্জন প্রভৃতি ক্ষেত্রে এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। পবিত্র কোরানে আল্লাহপাক বলেন, “যারা মানুষকে সৎকাজের আহ্বান করবে, নিজে সৎকাজ করবে এবং বলবে আমিই তো আত্মসমর্পণকারী, আল্লাহ বলেছেন তার কথার চেয়ে উৎকৃষ্ট কথা আর কার হতে পারে।” এখানে সৎকাজের প্রতি আহ্বান এবং আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণ করার আহ্বান জানানো হয়েছে। সমাজজীবনে তিনিই শ্রেষ্ঠ মানুষ যিনি সৎচিন্তা করেন এবং সৎকাজ করেন। আল্লাহর প্রতি যে ব্যক্তির প্রতিনিয়ত আত্মসমর্পণ করার ইচ্ছা, তাগিদ এবং ভয় রয়েছে- সে ব্যক্তি কখনও অন্যায় কাজ করতে পারে না। পৃথিবীতে আদর্শবান ব্যক্তি তিনিই যিনি স্রষ্টার প্রতি আত্মসমর্পণ করার মাধ্যমে নিজেকে উৎসর্গ করেন এবং সত্য ও ন্যায়ের পথে থাকেন।

রাতের অন্ধকার এবং দিনের আলো কখনও এক হতে পারে না। এ দুয়ের মধ্যে রয়েছে সত্য এবং ন্যায়ের উপমা। অন্ধকার হচ্ছে অন্যায়ের প্রতীক এবং আলো হচ্ছে সত্য ও ন্যায়ের প্রতীক। আলোর রশ্মিতে অন্ধকার বিদূরিত হয় এবং সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। যেমন- সূর্যালোকের শুভাগমনে রাতের অন্ধকারের অস্তিত্ব থাকে না। ঠিক তেমনিভাবে ভালো এবং মন্দ এই দুয়ের মূল্যমান কখনও একই পর্যায়ভুক্ত নয়। ভালো চিরকালই কল্যাণের এবং আদর্শের, অপরদিকে মন্দ চিরকালই অকল্যাণকর, ঘৃণ্য ও অপাঙ্্ক্তেয়। কোরান পাকে তাই বলা হয়েছে : ‘ভালো এবং মন্দ সমান হতে পারে না, মন্দকে তুমি প্রতিহত করো উৎকৃষ্ট কিছু দিয়ে।’ আল-কোরানে আল্লাহ ভালো সম্পর্কে আরও বলেছেন- “He who created death and life, that he may try which of you is  the best in deed’ –Al-Mulk 67:2. আল্লাহ মন্দ সম্পর্কে আল কোরানে বলেছেন- “Taste the penalty of eternity for your evil deeds.”– Al Sajdah-32:14. মানুষের বিশ্বাস ভালো ও মন্দ কাজের মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হয়। মহান আল্লাহতায়ালা আল-কোরানে ভালো-মন্দ সম্পর্কে অন্তত ৩৬০ বার ভালো পথে চলার আহ্বান এবং মন্দ সম্পর্কে সতর্ক থাকার কথা উল্লেখ করেছেন। হযরত মুহম্মদ (স.) অসংখ্যবার একই তাগিদ দিয়েছেন। 

বর্তমান সমাজে ‘বন্ধুত্ব ও শত্রুতা’ শব্দ দুটোও ভালো ও মন্দ কাজের সাথে জড়িত হয়ে পড়েছে। অথচ বন্ধুত্ব শব্দটি আল্লাহ ও রাসুলের সম্পর্কের মধ্য দিয়ে দ্যোতনা পেয়েছে। ভালো ও মন্দের পার্থক্য বুঝতে অক্ষম হওয়ায় আমরা বন্ধুত্বকে শত্রুতায় পরিণত করেছি। বন্ধুত্ব মানুষকে মহান করে এবং শত্রুতা মানুষকে ধ্বংস করে। তবে শত্রুর ওপর ভরসা করা বোকামি। মানুষের জীবনে বন্ধুর প্রয়োজন খুব বেশি। পরস্পরের মধ্যে বন্ধুত্বে উভয়ই লাভবান হন। আমরা দেখেছি একজন শত্রু যখন বন্ধু হয়, তখন সে তার জন্য ভালো কিছু করে। ইতিহাসে এর অনেক নজির রয়েছে। শত্রুকে বন্ধু করার চেয়ে ভালো কাজ কিছু হতে পারে না। আল-কোরান ও হাদিস শরিফের অনেক জায়গায় শত্রুকে বন্ধু করার তাগিদ রয়েছে এবং পরস্পরের জন্য ভালো কাজ করাকে বন্ধুত্ব প্রতিষ্ঠার সহজ উপায় বলা হয়েছে।

কাজ, সততা ও মনুষ্যত্ব মানুষকে মহান করে। মানুষের সার্বিক কল্যাণ সাধন করে। আমি আমার ব্যক্তিজীবন, অনুভব এবং সকল কাজের মধ্য দিয়ে তা উপলব্ধি করেছি।

আমরা দেখেছি, অভিজ্ঞতায় উপলব্ধি করেছি, অস্থিরচেতা মানুষ বরাবরই সমাজে অগ্রহণযোগ্য ব্যক্তি। মানুষের কল্যাণ এবং সমাজ বিনির্মাণে ধৈর্যশীলদের আদর্শবান বলা হয়েছে। এ আদর্শবান ব্যক্তি সমাজ থেকে অন্যায়, অপকর্ম, দুঃশাসন দূরীভূত করতে পারে। ভালোকে উচ্চকিত এবং মন্দকে পরিহার করতে পারে। ভালো ব্যক্তিত্বের সামনে শয়তান কখনও অগ্রসর হতে পারে না। মহান আল্লাহ বলেছেন, “যদি কখনও শয়তানের কুমন্ত্রণা পাও তাহলে আল্লাহকে বারবার স্মরণ করো। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের মধ্যে যে সময় নির্ধারণ করা হয়েছে তা যথাযথভাবে পালন করা হলে শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।” আল্লাহপাক আরও বলেছেন, ‘শয়তানের ধোঁকা এবং কুমন্ত্রণা থেকে রক্ষা পেতে হলে বেশি বেশি কোরান তিলাওয়াত করতে হবে।’ কথায় বলে, মানুষ যতই বুদ্ধিমান হোক না কেন, খারাপ কাজ শেষ পর্যন্ত মানুষের ধ্বংস ডেকে আনে।

তাই বলা যায়, মানুষের জীবন গঠন, সমাজ, পারিপার্শ্বিকতা, দেশ গঠন ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রেই যে ধর্মীয় আদর্শ রয়েছে তার বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। ধর্মীয় মূল্যবোধ স্বাভাবিক কারণেই পার্থিব এবং অপার্থিব সকল জীবনের জন্য অনুকরণীয়। এ মূল্যবোধ অর্জনকারী ব্যক্তিই হলো আদর্শ ব্যক্তি বা নাগরিক এবং আল্লাহর প্রিয় বান্দা। পৃথিবীতে যত ধর্মাবলম্বী মানুষই থাকুক না কেন, তা মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান যাই হোক না কেন, প্রত্যেকের ধর্মের সামাজিক দর্শনের মর্মবাণী প্রায় অভিন্ন। ব্যক্তিগত জীবন, সমাজ বিনির্মাণ, দেশ ও রাষ্ট্র গঠন- এর সকল ক্ষেত্রেই যার যার ধর্মীয় অনুশাসন অনুসরণ করলে পৃথিবী হবে সকলের জন্য অধিকতর বাসযোগ্য, কল্যাণকর এবং শান্তিময়। এই প্রশান্তিময় জীবন গড়ায় আমরা যেন সবাই সচেষ্ট হই। কাজ, সততা ও মনুষ্যত্ব মানুষকে মহান করে। মানুষের সার্বিক কল্যাণ সাধন করে। আমি আমার ব্যক্তিজীবন, অনুভব এবং সকল কাজের মধ্য দিয়ে তা উপলব্ধি করেছি।

আগামীকাল থাকছে - 'নেতৃত্বের শক্তি'

আরও পড়ুন ঃ ‘আমার প্রাত্যহিক জীবন’​ , 'আমার অনুভব'