বইঃ আমার কথা

মাতৃভাষার প্রতি মমতা

অনলাইন ডেস্ক
| আপডেট : ১৮ নভেম্বর ২০১৬, ১৪:১৯ | প্রকাশিত : ১৮ নভেম্বর ২০১৬, ১৩:৫৩

সৈয়দ আবুল হোসেন বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন। সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে আমার কথা। এই বইয়ে তিনি নিজের চিন্তা, কর্মকান্ড, মূল্যবোধ, নানা অভিজ্ঞতা ও পরিকল্পনা সম্পর্কে লিখেছেন।

এটি পড়লে তাকে যারা পুরোপুরি চিনেন না তাদের সুবিধা হবে। বইটি ঢাকাটাইমস২৪ডটকম ধারাবাহিকভাবে ছাপছে। আজকের পর্বে থাকছে ‘মাতৃভাষার প্রতি মমতা’।

ভাষা-আন্দোলন আমাদের স্বাধীনতার মূলমন্ত্র ও আলোকবর্তিকা হিসাবে চিহ্নিত। ভাষা রক্ষায় রক্ত দিয়ে আমরা বিশ্বকে আমাদের শক্তি, সাহস, তেজ আর উত্থানের বার্তা দিয়েছিলাম। তাই একুশে আমাদের চেতনার স্মারক, প্রেরণার উৎস। একুশ আমাদের অহংকার। একুশ আমাদের গর্ব। একুশ আমাদের পথের দিশা। একুশ মানে মাথা নত না করে মাথা উঁচু করা। মাতৃভাষাকে রক্ষার মাধ্যমে সত্য ও ন্যায়ের দাবী প্রতিষ্ঠা করা। একুশের বিজয় আমাদের সীমাহীন শক্তিতে উদ্দীপ্ত করেছে, উজ্জীবিত করেছে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার মন্ত্রে। আমরা ধাপে ধাপে এগিয়ে গিয়েছি। একুশ থেকে একাত্তর, তাই দুটো একসূত্রে গাঁথা। আমরা মুখের ভাষার জন্য বুকের রক্ত দিয়েছি কিন্তু আজ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয়ভাবে বা সামাজিকভাবে বাংলা ভাষাকে সর্বস্তরে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হয়নি। ভাষা একটি জাতির স্বকীয়তার প্রধান নিয়ামক। যে ভাষার জন্য আমরা রক্ত দিয়েছি, জীবন দিয়েছি অকাতরে- সে ভাষা শুদ্ধরূপে উচ্চারণের ও লেখার জন্য এখন সামান্য শ্রম দিতে কুণ্ঠিত হচ্ছি, এমন স্ববিরোধী জাতি কি পৃথিবীতে আর আছে?৮

পবিত্র কোরানে বলা হয়েছে, ভাষার স্রষ্টা স্বয়ং আল্লাহতায়ালা। ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনি (আল্লাহ) মানুষ সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তাকে ভাব প্রকাশ করতে শিখিয়েছেন।৯’ জন্মগতভাবেই মানুষ তার মাতৃভাষায় কথা বলে। কারণ মহান আল্লাহতায়ালা মানুষের জন্মের পর তাকে মায়ের ভাষাতে কথা বলতে শিখিয়েছেন। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর একটি শিশু তার মা-বাবা, আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী থেকে যেসব কথা শোনে, তাদের কাছ থেকে যে ভাষা শেখে এবং তাদের সঙ্গে যে ভাষায় কথা বলে মনের ভাব প্রকাশ করে তা-ই তার মাতৃভাষা। ভাষা মানুষের প্রতি আল্লাহর অশেষ দয়া ও অনুগ্রহ এবং তাঁর সৃষ্টিকুশলতার একটি অনুপম নিদর্শন। পবিত্র কোরানে আল্লাহ্পাক বলেছেন, ‘আর তাঁর নিদর্শনাবলির মধ্যে রয়েছে মহাকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য।’১০

পৃথিবীতে প্রতিবছর ৭টি করে ভাষা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। জনসংখ্যার বিলুপ্তি ভাষা-বিলুপ্তির প্রধান কারণ। সে হিসাবে বাংলা ভাষার অবস্থান পতনের দিকে নয়, উত্থানের দিকে। পৃথিবীতে চারটি ভাষাও যদি টিকে থাকে তন্মধ্যে একটি হবে বাংলা। তবে, আমরা যারা বাংলা ভাষায় কথা বলি এবং লিখি, বিশেষ করে, শিক্ষিত ও উচ্চশিক্ষিত হিসাবে পরিচিত- তাঁদের অনেকের কার্যকলাপ বাংলা ভাষাকে ক্রমশ বিপন্নতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। প-িতদের লেখালেখি বাংলা বানান ও উচ্চারণ রীতির বিরাট প্রতিবন্ধক। তাঁদের লেখা ও বানানে পারস্পরিক ভিন্নতা সাধারণ পাঠকদের বাংলা বানান ও শব্দচয়নকে সাংঘাতিকভাবে স্বেচ্ছাচারী করে তুলছে। ভাষার অভ্যন্তরীণ রীতিনীতির তুঘলকি সিদ্ধান্ত ও দায়বোধহীন চিন্তা-চেতনা বাংলা ভাষাকে ক্ষয়রোগের মতো পতনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। পণ্ডিতবর্গের বানান-বিষয়ক মতানৈক্য বাংলা ভাষার বিদ্যমান জটিলতার মূল কারণ। একবিংশ শতকে এসেও আমাদের বুদ্ধিজীবীরা বাংলার মতো একটি সুসমৃদ্ধ ভাষাকে সমতার বন্ধনে আবদ্ধ করতে পারছেন না। এ ব্যর্থতার দায় তাঁরা কীভাবে এড়াবেন?১১

বিশ্বায়নের প্রক্রিয়ায় আমাদের আশপাশের দেশগুলো অধিকমাত্রায় ইংরেজির দিকে ঝুঁকছে। এমনকি গণচীনেও ইংরেজি রপ্ত করার হিড়িক পড়েছে। ব্যবসায়-বাণিজ্য-বিনিয়োগ-প্রযুক্তি ও যোগাযোগের জন্য এছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই। অগ্রগতি অর্জনের জন্য আমাদেরও এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। কিন্তু সেটা কতটুকু এবং কোন কোন ক্ষেত্রে তার সুস্পষ্ট সীমা নির্ধারণও প্রয়োজন। তা নিশ্চয়ই মাতৃভাষাকে অবহেলা করে নয়। বাংলার বদলে ইংরেজির প্রসার হবে আত্মহননের শামিল। পর্ণকুটিরে ছিন্নবস্ত্রে বসবাসরত গর্ভধারিণীকে অবহেলা করে ধনী শাশুড়িকে নিয়ে মেতে থাকা আর যাই হোক, কোনো সুস্থ মানুষের কাজ হতে পারে না। ঠিক তেমনি মানুষের কাজ হতে পারে না- মাতৃভাষাকে অবহেলা করে অন্যের ভাষা নিয়ে উল্লাস করা। এমন লোকদের চরিত্র আঁকতে গিয়ে মধ্যযুগের কবি আব্দুল হাকিম বলেছেন :

যে সব বঙ্গেতে জন্মি

হিংসে বঙ্গবাণী

সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।

এ কারণে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আমাদের একটি ভাষানীতি প্রয়োজন। এ ভাষানীতি বাংলা ও ইংরেজির একটি সমান্তরাল সহঅবস্থান নিরূপণ করবে এবং তার যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করবে। ভাষানীতি না-থাকার কারণে আমরা প্রায় সবক্ষেত্রে একটা হ-য-ব-র-ল অবস্থা প্রত্যক্ষ করছি। সরকারি দফতরগুলোতে যে-যার মর্জি-মতো করে বাংলায় নোট লিখছেন। আমি গত বিশ বছরে সরকারি দফতরে শুদ্ধ ও প্রমিত বাংলা বানানে একটি পত্রও পাইনি। নোটের ভাষা ও বানানও নিম্নমানের। যাঁরা এগুলো লেখেন তাঁরা উচ্চশিক্ষিত। নিজের ভাষার প্রতি যাঁরা এত অজ্ঞ তাঁদের উচ্চডিগ্রি নিয়ে সংশয় প্রকাশ অমূলক হবে না। সবচেয়ে বেশি নৈরাজ্য চলছে শিক্ষায়তনগুলোতে। বাংলা বানানে কোথাও কোনো সমতা নেই। শিক্ষকবৃন্দেরও কিছু করার নেই। বাজারে প্রচলিত বিশেষজ্ঞ-লিখিত বানানেও রয়েছে সাংঘর্ষিকতা। এমনকি বাংলা একাডেমির বানান-রীতিতেও কোনো সুনির্দিষ্টতা নেই। প্রত্যেক দেশের প্রত্যেক জাতির নিজস্ব ভাষানীতি রয়েছে। তাদের নিজেদের প্রয়োজনেই তারা তা প্রণয়ন করেছে, অনুসরণ করে চলেছে। কিন্তু বাংলা ভাষায় তা নেই। অথচ আমরা এ ভাষার জন্যই জীবন দিয়েছি।

একটি জাতীয় ভাষানীতির জন্য প্রয়োজন জাতীয় ঐকমত্য। এ ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার জন্য জাতীয়তাভিত্তিক উদ্যোগ আবশ্যক। ভাষানীতি প্রণয়নের জন্য একটি কমিটি গঠন করা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। এ ধরনের জাতীয় কমিটি শিক্ষাবিদ, প্রযুক্তিবিদ, বিজ্ঞানী, চিকিৎসক, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, সরকারি কর্মকর্তা ও কূটনীতিক, সাংবাদিক, আইনজীবী, শিক্ষার্থী এবং আগ্রহী সাধারণ নাগরিকদের মতামত গ্রহণ করবে। এ মতামতের ভিত্তিতে কমিটি জাতির সম্মুখে তার প্রতিবেদন উপস্থাপন করবে। অতঃপর এ বিষয়ে দেশব্যাপী পূর্ণাঙ্গ বিতর্ক অনুষ্ঠিত হবে। বিতর্কের পরে সবার সুপারিশের ভিত্তিতে জাতীয় ভাষানীতি গৃহীত হবে এবং তার প্রয়োগ হবে বাধ্যতামূলক। ভাষা-সংক্রান্ত এ জাতীয় কমিটির দ্বিতীয় কাজ হবে জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে ভাষানীতি কতটুকু প্রয়োগ হচ্ছে তা মনিটর করা বা লক্ষ্য রাখা। যারা ভাষানীতি অনুসরণ করবে না, তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।

অনেকে যুক্তাক্ষরকে বাংলা ও বাংলা বানানের সমস্যা বলে মনে করে থাকেন। ভাষা কিংবা বানান উভয় বিবেচনায় যুক্তাক্ষর সমস্যা নয়, বরং সুবিধা। যুক্তাক্ষর শব্দের যথার্থ উচ্চারণে সহায়তা করে। বাংলা যুক্তাক্ষরগুলো ধ্বনি-প্রতিলিপি হিসাবে ব্যবহারের ক্ষেত্রে সাশ্রয় বিবেচনায় বিস্ময়কর শৃঙ্খলাজাত কৌশল। এটি শুধু অভ্রান্ত নয়, অতি সূক্ষ্ম বিবেচনাতেও একটি বিজ্ঞানভিত্তিক প্রয়াস হিসাবে স্বীকৃত। বাংলায় লেখা যায় না এমন ধ্বনি খুব একটা বেশি নেই।

জনসংখ্যা বিবেচনায় বাংলা পৃথিবীর চতুর্থ ভাষা। বাইশ কোটি লোক বাংলায় কথা বলে। পৃথিবীর প্রত্যেক ভাষার কিছু-না-কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সে বিবেচনায় বাংলা ভাষার যে সীমাবদ্ধতা পরিদৃষ্ট হয়, তা অন্যান্য ভাষা বিবেচনায় অতি নগণ্য। বাংলা ভাষার লিখনগতি ইংরেজি ভাষার সমান, কিন্তু পঠনবেগ ইংরেজির চেয়ে বেশি। ইংরেজি লিপি ধ্বনিমূলক নয়, বর্ণনাত্মকমূলক। একটি ধ্বনির প্রতিলিপি হিসাবে ইংরেজিতে একটি বর্ণ

সৃষ্টি হয় না। উদাহরণস্বরূপ ‘g’ বর্ণের কথা বলা যায়। এটি কখনও ‘বর্গীয়-জ’ কখনও বা ‘গ’। আবার কখনও উচ্চারণই হয় না। ইংরেজিতে অনেকগুলো শব্দ রয়েছে যেখানে বর্ণচিহ্ন উপস্থিত থাকলেও উচ্চারিত হয় না এবং বর্ণের উচ্চারণে প্রবল পার্থক্য লক্ষণীয়। ইংরেজির এ অবিজ্ঞানোচিত ও রীতিবিহীন উচ্চারণরীতি সংস্কার করে ধ্বনিমূলক পদ্ধতিতে বিজ্ঞানোচিত ইংরেজি লেখার পদ্ধতি প্রচলনের জন্য জর্জ বার্নার্ড শ মোটা অঙ্কের অর্থ উইল করে গিয়েছিলেন। কিন্তু ইংরেজি ভাষা এত বেশি অবৈজ্ঞানিক যে, তা ঠিক করা সম্ভব হয়নি।১২

প্রত্যেকটি ধ্বনির জন্য বাংলায় নির্দিষ্ট হরফ আছে। ‘ক’ বর্ণের উচ্চারণ সবসময় সর্বত্র অভিন্ন। ইংরেজি বর্ণমালার তৃতীয় বর্ণ ‘সি (C)’ এর মতো ভিন্নভাবে উচ্চারিত হওয়ার সুযোগ বাংলায় নেই। আবার কোনো বর্ণের অর্ধ-উচ্চারণ প্রয়োজন হলে হসন্ত দিয়ে চিহ্নিত করে দেওয়ার রীতি বাংলা ভাষার একটি বাড়তি সুবিধা।

সমতাভিত্তিক বানানরীতির সর্বজনীন গ্রাহ্যতা এবং সম্প্রসারণের অভাব বাংলা বানানের প্রধান সমস্যা। বাংলা বানানরীতির পরিপ্রেক্ষিত সূত্রগুলো শব্দের উৎসভিত্তিক। একজন লোকের পক্ষে বাংলা বানানরীতি যত সহজে আয়ত্তে আনা সম্ভব, বাংলা শব্দের উৎসগুলো আয়ত্তে আনা তত কঠিন। কিন্তু বানানরীতির সমতাবিধানের মাধ্যমে সহজে কষ্টকর বিষয়টাকে আয়ত্তে নিয়ে আসা যায়। বাংলা ভাষায় বর্তমানে ব্যবহৃত শব্দের সংখ্যা প্রায় এক লাখ পঁচিশ হাজার। তন্মধ্যে আনুমানিক ষাট ভাগ শব্দ তৎসম।

শব্দের উৎস সম্পর্কে জ্ঞাত না-হলে বানানের নিয়মগুলো যথার্থভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব নয়। তবে বাংলা বানানের নিয়মে সমতা ও আদর্শরীতি প্রচলন করা সম্ভব হলে শব্দের উৎসভিত্তিক অসুবিধাগুলো চমৎকারভাবে দূরীভূত করা সম্ভব। তৎসম-অতৎসমের দ্বন্দ্বে না গিয়ে সব শব্দকে বাংলা ভাষার নিজস্ব সমৃদ্ধি ধরে নিয়ে অগ্রসর হলে সমস্যা থাকার কথা নয়। মাতৃভাষা মায়ের মতো। ভাষা শেখার প্রতি অবহেলা ও স্বেচ্ছাচারিতা বাংলা বানানে ভুল ও সাংঘর্ষিকতার অন্যতম কারণ। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সুনজর না দিলে আমাদের প্রিয় মাতৃভাষার সাবলীল প্রসারে বিঘ্ন ঘটবে।

আল্লাহ্ যুগে যুগে মানবজাতিকে সৎপথ প্রদর্শনের জন্য যত নবি-রাসুল প্রেরণ করেছেন এবং তাঁদের কাছে যেসব ধর্মগ্রন্থ পাঠিয়েছেন তাঁদের ভাষা ছিল ওইসব জাতির মাতৃভাষা। এর উদ্দেশ্য ছিল- প্রত্যেক জাতির নিজ নিজ মাতৃভাষার মাধ্যমে ঐশী বাণী থেকে সহজে শিক্ষালাভ করতে সমর্থ হওয়া। তাই আমাদের প্রত্যেকের উচিত মাতৃভাষা বাংলাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদান। মাতৃভাষার গুরুত্ব সম্পর্কে আল্লাহ্ ইরশাদ করেছেন, ‘আর আমি প্রত্যেক রাসুলকেই তাঁর স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি তাদের কাছে পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য।’১৩

আগেই বলা হয়েছে, বাংলা বানানে সাংঘর্ষিকতা ও সে¦চ্ছাচারিতা প্রমিত বানান প্রচলনে বিরাট বাধা। প্রচলিত ভুল বাংলায় বানান সাংঘর্ষিকতার অন্যতম কারণ। এখানে উদাহরণস্বরূপ ইক (ষ্ণিক) প্রত্যয়যোগে গঠিত শব্দের কথা বলা যায়। যেমন- ‘বর্ষ’ থেকে বার্ষিক, ‘মানস’ থেকে মানসিক, ‘মাস’ থেকে মাসিক, ‘রসায়ন’ থেকে রাসায়নিক, ‘দর্শন’ থেকে দার্শনিক এবং ‘অর্থ’ থেকে আর্থিক; তাহলে ‘অর্থনীতি’ থেকে অর্থনৈতিক হবে কেন? এটি প্রচলিত ভুল। ব্যাকরণের রীতি অনুসারে অর্থনীতি + ইক (ষ্ণিক) = আর্থনীতিক। তেমনি রাজনীতি + ইক (ষ্ণিক) = রাজনীতিক। কিন্তু অনেকে লেখেন যথাক্রমে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক। এমন লেখা ভুল। প্রায় সবাই এমন ভুল করেন বলে এরূপ ভুলকে বলা হয় প্রচলিত ভুল। এখানে ব্যাকরণগত ভুল ছাড়াও প্রায়োগিক ভুলও রয়েছে। অর্থনীতি ও রাজনীতি উভয়ই নীতির বিষয়, তাই নৈতিকতা নিয়ে আসা হাস্যকর। এটি বিবেচনা করলেও ‘অর্থনৈতিক’ ও ‘রাজনৈতিক’ শব্দ দুটোর বানান অশুদ্ধ।১৪

বাংলায় বচন পরিবর্তনে প্রমিত-রীতি অনুসরণেও প্রচুর ভুল ও সাংঘর্ষিকতা লক্ষ্য করা যায়। অনেকে ‘কর্মকর্তা’ পদের বহুবচন-প্রকাশে লেখেন ‘কর্মকর্তাগণ, কর্মকর্তাবৃন্দ’ কিন্তু ‘নেতা’ শব্দের বহুবচন-প্রকাশে লেখেন নেতৃবৃন্দ, ভ্রাতার বহুবচন প্রকাশে লেখেন ভ্রাতৃবৃন্দ, শ্রোতার বহুবচন প্রকাশে লেখেন শ্রোতৃবৃন্দ। তাহলে ‘কর্মকর্তা’ শব্দের বহুবচন প্রকাশে ‘কর্মকর্তাবৃন্দ হবে কেন? এটি প্রচলিত ভুল। শুদ্ধরূপ হবে ‘কর্মকর্তৃবৃন্দ’। এর একটি সূত্র রয়েছে। এটি মনে রাখলে ভুলের আশঙ্কা কমে যাবে। কোনো বিশেষ্যের শেষে ‘তা’ থাকলে ওটি বহুবচন করার সময় ‘ত’ এর নিচে ‘ঋ-কার’ যুক্ত হয়। এটাই ব্যাকরণের নিয়ম। অতএব নেতা শব্দের বহুবচন যে-কারণে নেতৃবৃন্দ বা নেতৃগণ সে একই কারণে কর্মকর্তা শব্দের বহুবচন কর্মকর্তৃবৃন্দ বা কর্মকর্তৃগণ। ‘নেত্রীবর্গ’ ও ‘নেতৃবর্গ’ শব্দ দুটো সমোচ্চারিত কিন্তু বানান ও অর্থ ভিন্ন। ‘নেত্রীবর্গ’ শব্দের অর্থ ‘একাধিক মহিলা নেতা’। অন্যদিকে ‘নেতৃবর্গ’ শব্দের অর্থ ‘পুরুষ-মহিলা নির্বিশেষে একাধিক নেতা’। তেমনি ‘অভিনেত্রীবর্গ’ মানে মহিলা অভিনেতাবৃন্দ কিন্তু ‘অভিনেতৃবর্গ’ অর্থ সব অভিনেতা ও সব অভিনেত্রী।১৫

‘ভাল’ শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ forehead, brow, fate ইত্যাদি। ‘ভালো/ভাল’ শব্দদ্বয়ের ইংরেজি প্রতিশব্দ good, fair, excellent.. ভালো শব্দটি ‘ভাল’ হিসাবেও লেখা হয়। অভিধানেও অমনটি দ্বিতীয় ঘরে শুদ্ধ দেখানো হয়েছে। তবে যেহেতু দুটো বানানে পার্থক্য আছে সেহেতু good বলতে ‘ভালো’ লেখা বিধেয়। আমি good অর্থে ভালো লিখি। good অর্থে ‘ভাল’ লেখা প্রমিত নয়। তেমনি black অর্থে ‘কালো’ কিন্তু yesterday/time/ সময় অর্থে ‘কাল’ (উচ্চারণ : কাল্) লেখা বিধেয়। ‘ভালো যে বাসা’ বাক্যটিকে এককথায় প্রকাশ করলে হয় ‘ভালোবাসা’ কিন্তু ইংরেজি Love শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হচ্ছে ভালবাসা। তাই ইংরেজি Love-কে ‘ভালবাসা’র পরিবর্তে ভালোবাসা লিখলে তা Love না হয়ে good house অর্থ প্রকাশের আশঙ্কা থেকে যায়।১৬

মাতৃভাষার প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসার পাশাপাশি অন্যের ভাষার প্রতিও সবার শ্রদ্ধাশীল হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। পৃথিবীর সব ভাষাই আল্লাহর অনুমোদিত ভাষা। প্রত্যেক মাতৃভাষায় যেহেতু একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠী কথা বলে থাকে তাই মাতৃভাষার প্রতি তাদের মধ্যে ভালবাসা সৃষ্টি হয়। ভাষার সঙ্গে তাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতি জড়িত থাকে, পারস্পরিক ভাব আদান-প্রদান হয়, একে অপরকে বোঝা ও উপলব্ধি করা, অন্যকে প্রভাবিত করা, সৎপথে চলার আহ্বান করা, অন্যায় কাজে বাধা প্রদান প্রভৃতি মাতৃভাষার মাধ্যমেই সহজভাবে সম্ভব। তাই মাতৃভাষার প্রতি আমাদের সবচেয়ে বেশি মমতা প্রয়োজন, ঠিক মায়ের মতো।

আগামীকাল কাল থাকছে - ​‘ভবিষ্যতের সরকার কেমন হবে’ আরও পড়ুন - ‘সুখ ও শান্তি : আমাদের করণীয়’ ‘নেতৃত্বের শক্তি’, ‘আদর্শ জীবন গঠনে মূল্যবোধ’, ‘আমার প্রাত্যহিক জীবন’​, 'আমার অনুভব'

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :