শামীম-আইভী বিরোধ আবারও প্রকাশ্যে

প্রকাশ | ১৯ নভেম্বর ২০১৬, ০৮:২০ | আপডেট: ১৯ নভেম্বর ২০১৬, ১১:৪৯

নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি, ঢাকাটাইমস

আগামী ২২ ডিসেম্বর অনুষ্ঠেয় নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে সামনে রেখে শামীম ওসমান ও সেলিনা হায়াৎ আইভীর মধ্যে বিরোধ ফের প্রকাশ্যে রূপ নিলো।

২০১১ সালেই লক্ষাধিক ভোটের ব্যবধানে আইভীর কাছে হেরে যাওয়ার মধ্যদিয়ে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের এমপি শামীমের সঙ্গে তাঁর বিরোধ প্রকাশ্যে আসে।

নগর মেয়র আইভীর বিরুদ্ধে শামীম ও তাঁর অনুসারীদের ঘুষ-দুর্নীতির নানা লিখিত অভিযোগ এবং টিভি-টক শোতে এই দুই নেতার মধ্যে হাতাহাতির উপক্রম হওয়ার দৃশ্যও জাতি দেখেছেন। তবে শক্তহাতে আইভী সততার সঙ্গে তাঁর দায়িত্ব পালন করে গেছেন। বিষয়টি আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের শুভ নজর কারতে সক্ষম হন। শেষ পর্যন্ত শামীম ওসমানের পাঠানো তালিকা না ধরে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গণভবনে অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের সভায় আইভীর হাতেই তুলে দেয়া হয় নারায়ণগঞ্জের নৌকা প্রতীক।

তবে বেশ কিছু দিন ধরে শামীম ও আইভীর মধ্যে প্রকাশ্যে বিরোধ দেখা না গেলেও সম্প্রতি তফসিল ঘোষণার পর সেই পুরনো বিরোধ প্রকাশ্যে রূপ নেয়।

আইভী ও তাঁর অনুসারী আওয়ামী লীগ নেতাদের বাদ দিয়ে শামীম ওসমান তাঁরই অনুসারিদের নিয়ে কোনোমতে একটা বৈঠক করে মহানগর কমিটির সভাপতি আনোয়ার হোসেনসহ তিনজনের নাম কেন্দ্রে পাঠানোর মধ্যদিয়ে বিরোধ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এই তিন জনের মধ্যে দুই জনই এলাকায় ভীষণভাবে বিতর্কিত। এতে ক্ষুব্ধ আইভী নিজ উদ্যোগে নির্বাচনে দলের মনোনয়ন চেয়ে কেন্দ্রের কাছে আলাদা একটি আবেদন করেন। সেই আবেদনটি আওয়ামী লীগ আমলে নিয়ে শুক্রবার রাতে গণভবনে অনুষ্ঠিত এ সংক্রান্ত বোর্ডের সভায় আইভীকেই বেছে নেয়া হয়।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের সদস্য ও জেলা যুবলীগের সভাপতি আব্দুল কাদির ঢাকাটাইমসকে জানান, গত ১৫ নভেম্বর তড়িঘরি একাংশের বর্ধিত সভা করে যে তিন জনের নাম প্রস্তাব করে কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে তাদের কেউই আইভীর জনপ্রিয়তার ধারে কাছে নেই।

১৩ বছর ধরে আইভী নারায়ণগঞ্জ পৌরসভা এবং সিটি কর্পোরেশনের মেয়রের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। নারায়ণগঞ্জের উন্নয়ন করে তিনি মানুষের হৃদয় জয় করে ফেলেছেন। কিন্তু শামীম ওসমানের অনুগত নেতাকর্মীরা বর্ধিত সভার নামে যে তিন নেতার নাম প্রস্তাব করেছেন তাদের মধ্য একমাত্র আনোয়ার হোসেন ছাড়া বাকি দুই নেতা নিজ দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে বিতর্কিত। তাদের নাম সিটি মেয়র প্রার্থী হিসেবে কেন্দ্রে পাঠানো হস্যকর ছাড়া আর  কিছুই না। তিনি বলেন, আমার মনে হয় সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বর্তমান মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীর নাম প্রস্তাব না করাটা শামীম ওসমানের রাজনেতিক জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। কারন আইভীর নাম কেন্দ্রে পাঠানো হলে শামীম ওসমান বরং সমাদৃত হতেন।  

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় একাধিক নেতা ঢাকাটাইমসকে বলেছেন, শামীম ওসমানের আরেকটি বড় ভুল হচ্ছে- আনোয়ার হোসেন ছাড়া বাকি যে দুই নেতার নাম প্রস্তাব করে কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে তারা নিজ এলাকাতেও বিতর্কিত।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলা বা মহানগর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে এই দুই নেতার কোন জনপ্রিয়তা তো-নেই বরং নানাভাবে তারা আলোচিত ও সমালোচিত। 

এদের একজন হচ্ছেন সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুজিবুর রহমান। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১৩ সালে সিদ্ধিরগঞ্জের মুজিববাগ এলাকায় এক নিরীহ বিধবা নারীর বসত ভিটা জোরপূর্বক দখল করে ওই বৃদ্ধাকে মারধর করে এলাকা ছাড়া করেন এই মুজিবুর রহমান। মুজিবুর রহমান সাংসদ শামীম ওসমানেরই আস্থাভাজন নেতা। শামীম ওসমানের কারনেই মুজিবুর রহমান দীর্ঘদিন ধরে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ আঁকড়ে আছেন। নানা বির্তকিত কর্মকাণ্ডের কারণে তিনি নিজ দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে সমালোচিত।

মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য কেন্দ্রে তাঁর নাম প্রস্তাব না করার বিষয়ে আইভী বক্তব্য হচ্ছে- গত ১৫ নভেম্বর মহানগর আওয়ামী লীগের একাংশের বর্ধিত সভায় যারা উপস্থিত ছিলেন তারা সবাই শামীম ওসমানের অনুগত। গত ২০১১ সালের ৩০ অক্টোবর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিপুল ভোটের ব্যবধানে আমার কাছে হেরে যাওয়ার পর থেকেই বিরুদ্ধে অবস্থান নেন শামীম ওসমান।

সিটি করপোরেশনের নানা উন্নয়ন কাজে বাধা দান, সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে মামলা মোকদ্দমা করাসহ আমার বিরুদ্ধে শহরে নানা অরুচিকর ব্যানার পোষ্টার, ফেস্টুন, সাঁটানোসহ নানা মিথ্য অপপ্রচার চালিয়েছে। সর্বশেষ আমাকে কোনঠাসা করার জন্য নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন চাচাকে নিয়ে মাঠে নামে।

গত তিন চার মাস ধরে বিভিন্ন সভাসমাবেশ করে আনোয়ার হোসেনকে আসন্ন নির্বাচনের মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন শামীম ওসমান। গত ১৫ নভেম্বর বর্ধিত সভায় যে নাম প্রস্তাব করে যে নাম পাঠানো হয়েছে তা পুরোপরি শামীম ওসমানের ইশারায় হয়েছে।

আইভী দাবি করেন, নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের তৃণমূলের ৭০ শতাংশ নেতাকর্মী তার পক্ষে রয়েছে। কিন্তু ভয়ে সাধারণ নেতাকর্মীরা মুখ খুলতে পারছেন না।  তিনি বলেন, এটাকে কোনোভাবেই তৃণমূলের বর্ধিত সভা বলা যাবে না। 

এ ব্যাপারে নারায়ণগঞ্জ চার আসনের সংসদ সদস্য একেএম শামীম ওসমান বলেন, তৃণমূলের বর্ধিত সভায় এক জন নেতাকর্মীও মেয়র আইভীর নাম প্রস্তাব করেননি। সভায় এক বাক্যে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ত্যাগী নেতা আনোয়ার হোসেনের নাম বলেছে। তাই আনোয়ার হোসেনকে একক প্রার্থী করে কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে। আমার বিশ্বাস প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা তৃনমুলের  মতামতকে প্রাধান্য দেবেন।

আইভী-শামীমের বিরোধের নেপথ্যে

২০১১ সালে নবগঠিত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী শামীম ওসমান নাগরিক কমিটির প্রার্থী ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীর কাছে এক লাখেরও বেশি ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন। এর পর থেকেই তাঁর বিরুদ্ধে অবস্থান নেন শামীম। একই সাথে তার যেকোনো ভালো উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করাসহ প্রশাসনিক ভাবে পদে পদে জটিলতা সৃষ্টি করেণ। এছাড়া ২০১৩ সালের  ৬ মার্চ নারায়ণগঞ্জের মেধাবী শিক্ষার্থী আইভীর নির্বাচন কমিটির সদস্য সচিব রফিউর রাব্বির ছেলে তারভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যার ঘটনায় ওসমান পরিবারকে দায়ী করেন রাব্বি। ওই সময় আইভী সরাসরি ত্বকী হত্যার জন্য ওসমান পরিবারের সদস্যদের দায়ী করে বিচার দাবি করে প্রকাশ্যে। এছাড়া শামীম ওসমানের অনুগতরা নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালান সেখানে বাঁধ সাধেন আইভী। সিটি করপোরেশনের উন্নয়ন কাজের টেন্ডার আহ্বান থাকে উন্মুক্ত। এসব কারণেই মূলত তাদের মধ্যে বিরোধ দিন পর দিন বাড়তে থাকে।

(ঢাকাটাইমস/১৯নভেম্বর/প্রতিনিধি/এআর)