হাজার কি.মি পায়ে হেঁটে প্রতিবাদ শিশু ধর্ষণের

প্রকাশ | ১১ ডিসেম্বর ২০১৬, ২১:৪৭ | আপডেট: ১২ ডিসেম্বর ২০১৬, ১০:১৭

খাইরুল ইসলাম বাসিদ, পাবনা

নিত্যদিন শিশু ধর্ষণ, নারী নির্যাতন-গণমাধ্যমে পড়তে পড়তে কত দিন আর ভালো লাগে? কিছু তো একটা করতে হবে। মানুষ হিসেবে যে জন্ম। এভাবে আর কতদিন চলা যায়-এই ভেবেই রাস্তায় নেমে পড়লেন একজন লোকমান সওদাগর।

জনসচেতনতার ডাক নিয়ে সর্ব উত্তরের জনপদ পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া থেকে সর্বদক্ষিণের জনপদ কক্সবাজারের টেকনাফের পথে যাত্রা শুরু করেছেন লোকমান। তবে তিনি কোনো বাহনই ব্যবহার করছেন না। প্রায় এক হাজার কিলোমিটার পথ তিনি চলবেন পায়ে হেঁটে।
 
তিনি প্রচার করছেন শান্তি আর সহমর্মিতার কথা। প্রচার করছেন মনুষ্যত্বের বাণী। প্রচার করছেন নারী ও শিশুদেরকে সম্মানের চোখে দেখার, প্রচার করছেন পরিবেশ রক্ষার ডাক।
 


লোকমােেনর বাড়ি চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার ফতেয়াবাদ গ্রামে। তিনি পেশায় ব্যবসায়ী। বয়স ৪৭। গত ২৯ নভেম্বর পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়া থেকে যাত্রা শুরু হয় লোকমানের।

১৩ দিন পর রবিবার সন্ধ্যায় যখন লোকমানের সঙ্গে ঢাকাটাইমসের কথা হয়, তখন তিনি সিরাজগঞ্জ চৌরাস্তায় জেলায় অবস্থান করছিলেন। তিনি জানালেন এই যাত্রায় নামার কাহিনি, তার উদ্দেশ্য, এই দেশ আর তার মানুষের বিষয়ে তার অভিজ্ঞতার কথা।

লোকমান জানান, বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্ট থেকে শুরু করে তিনি শুরুতেই পঞ্চগড় শহরে যান। এরপর ঠাঁকুরগাঁও, দিনাজপুরের বীরগঞ্জ ও ১০ মাইল হয়ে পাগলাপীর হয়ে রংপুর আসেন। এরপর সেখান থেকে বগুড়া হয়ে সিরাজগঞ্জ আসেন।

কেমন লাগে হাঁটতে?

-‘ভালোই লাগে, অনেক কিছু দেখা যায়’।
-ক্লান্তি লাগে না?
-‘ক্লান্তি তো একটু লাগবেই।’
তখন কী করেন?

‘সাথে কিছু খাবার রাখি, ওরস্যালাইন, ফল, কিছুু ওষুধ থাকে, সব সময় এক বোতল পানিও থাকে। এগুলো খাই। তারপর আবার যাত্রা শুরু করি।’

কেবল হাঁটেন না লোকমান। সঙ্গে রাখেন লিফলেট, সামাজিক সচেতনতা গড়ার চেষ্টায় সেগুলো বিতরণ করেন। তার প্রধান লক্ষ্য স্কুল। এ ছাড়া যেখানেই জটলা, যেখানেই সচেতনতা

আমার হাতে লিফলেট থাকে, কিছু স্লোগান থাকে।
কী লেখা আছে এতে? জানতে চাইলে মোট ছয়টি স্লোগান আছে এতে।
১.    সবাই মিলে গাছ লাগাই, পরিবেশ দূষণ থেকে দেশ বাঁচাই।
২.    শিক্ষা জাতির মেরুদ-, সুশিক্ষায় সুশিক্ষিত হই এবং ছেলে মেয়েদেরকে শিক্ষিত করি।
৩.    মাদক সেবন থেকে বিরত থাকি, মাদক জীবন কেড়ে এবং এবং একটি পরিবারকে ধ্বংস করে দেয়।
৪.    শিশু ও নারী নির্যাতন থেকে বিরত থাকি।
৫.    বাল্যবিবাহ ও যৌতুকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ি।
৬.    আমরা নিজের ভুলগুলো নিজের চোখে দেখি না। নিজের ভুলগুলো সংশোধন করার চেষ্টা করি।

সব শেষে লেখা আছে, ‘আমার এই স্লোগান যদি কেউ মনে প্রাণে গ্রহণ করেন, তাহলে আমার পথ চলা স্বার্থক হবে।’

লোকমান জানান, একদিনে ৩০ কিলোমিটার হাঁটার লক্ষ্য আছে তার। তবে দিনের বেলায় কেবল হাঁটেন তিনি। আর থাকার জায়গা আগে থেকেই নির্দিষ্ট করতে হয় বলে কোনো দিন ৩৫ কিলোমিটার কোনো দিন বা ২৫ কিলোমিটার হাঁটতে হয়।

-মানুষ মানুষ কী বলে?
-‘সকালে এক ভদ্রলোক পেলেন, বললেন কই যাচ্ছেন। তখন তাকে লিফলেট দিলাম। বলেন, এত দূর হেঁটে যাবেন!’।
-লোকমান বলেন, ‘স্কুলে অনেক প্রশংসা করে।’
-কোনো বাহনে চেপেও তো যেতে পারতেন, সবচেয়ে কঠিন পথটা কেন বেঝে নিলেন-জানতে চাইলে লোকমান বলেন, ‘ কঠিনটা বেছে নিলাম-মানুষ যেন গুরুত্ব দেয়। মানুষ তো গাড়িতে করে ঘরের সামনে নামতে চায়। আমি বলছি, কঠিনের কথা।’

-এই চিন্তাটা কেন আসলো?-জানতে চাইলে লোকমান বলেন, দিনাজপুরের বীরগঞ্জে একটি শিশুকে ধর্ষণের পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসার ঘটনাটি তার জীবনে সবচেয়ে বড় দাগ কেটেছে। এরপর ভাবলেন, নারী ও শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে কিছু একটা হলেও করতে হবে।
লোকমান বলেন, ‘ওটা আমার আমার জীবনে সবচেয়ে বড় কলঙ্ক মনে হয়। ভাবলাম, মানুষকে কিছু একটা বার্তা দেয়া দরকার। কিছু একটা করি। মানুষের ভেতর একটু অনুভূতি হলো জাগাই।’

-১৩ দিনের এই যাত্রায় বাংলাদেশ বা মানুষকে কতটা দেখেছেন?
-লোকমান জবাব দেন, ‘এতো বেশি মানুষের সঙ্গে কখনও মিশিনি। পথে নেমে মানুষের সম্পর্কে আমার ধারণাই পাল্টে গেছে। চিন্তার দিক থেকে আমরা এখনও অনেক ভালো।’

-নির্জন পথে ভয় লাগে না?
-‘একটু ভয়-ভীতি লাগে তবে সেটা নিরাপত্তাহীনতার ভয় না, একাকীত্বের ভয়। তবে কোনো ধরনের বাজে সিচুয়েশনে পড়িনি। ’-বলেন লোকমান।
লোকমান বলেন, ‘এই পর্যন্ত যতদূর এসেছি খুবই ভালো অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার। আমি স্বাধীনভাবে হেঁটেছি।’
পুলিশ কী বলে?


-‘একবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দেখে আমাকে ডাক দিলো। তাদেরকে আমার উদ্দেশ্য বললাম। একটা লিফলেটও দিলাম। তারাও খুব প্রশংসা করেছে। বলেছে, আপনার উদ্যোগটা খুভ ভালো। কিন্তু এতদূর হেঁটে যেতে পারবেন?’


লোকমান বলেন, ‘বেশিরভাগ মানুষই এই কথাটিই বলে। আমার প্রতি সহানুভূমি জানায়। তিনি বলে, ‘পঞ্চগড়ে একটি স্কুলের শিক্ষক আপ্লুত হয়ে গেছেন। সবাই আমার প্রতি স্নেহ ও আন্তরিকতা প্রকাশ করেছে।’


লোকমান জানান, এই যাত্রায় তিনি একটি ডায়েরি রাখেন। এতে অনেকেই অনেক কিছু লিখে দেয়। বলেন, ‘ওই শিক্ষক আমাকে উদ্দেশ্য করে একটি বাণী লিখেছে। আমার খুব ভালো লেেেগছে। কেবল ওই শিক্ষক নন, বাংলাবান্ধায় যেখান থেকে যাত্রা শুরু করেছি, সেখানে বিজিবিও আমাকে একটি বাণী লিখে দিয়েছে। সিলও দিয়েছে তাতে। প্রতিটি বাণীতেই আমার মঙ্গল কামনা করেছে।’

-কোনো ধরনের কটূক্তি বা বাজে কথা কেউ বলেনি?

লোকমান বলেন, এক নারী শিক্ষক একবার বলেছিলেন, এই যাত্রায় কী লাভ? আমি বলেছিলাম একটু পরেই আপনার কাছে লাভ নিয়ে নেবো। কিছুক্ষণ পর একজন এসে আমার ডায়েরিতে আমার মঙ্গল কামনা করে লিখে দিয়েছেন। পরে আমি ওই নারীকে বললাম, দেখছেন কীভাবে লাভটা নিয়ে নিলাম? তিনি হাঁসলেন। নিজেও আমার জন্য মঙ্গল কামনা করলেন।


কবে নাগাদ টেকনাফ পৌঁছতে যান-জানতে চাইলে লোকমান বলেন, ‘আশা করি ৩১ ডিসেম্বর বা ১ জানুয়ারির মধ্যে পৌঁছতে পারবো।’

ঢাকাটাইমস/১২ডিসেম্বর/প্রতিনিধি/ডব্লিউবি