বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পরাশক্তিগুলোর দ্বন্দ্বমুখর অবস্থানের নেপথ্যে- ৩

প্রকাশ | ১৫ ডিসেম্বর ২০১৬, ০৮:৪৯ | আপডেট: ১৫ ডিসেম্বর ২০১৬, ১০:২১

আমিনুল ইসলাম

বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যত কাণ্ড হোয়াইট হাউসে

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন রিপাবলিকান দলের রিচার্ড নিক্সন। রিপাবলিকান কিংবা ডেমোক্র্যাট যে দলই ক্ষমতায় থাকুক, আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতির খুব একটা হেরফের হয় না। তবু রিপাবলিকানদের মধ্যে যুদ্ধপ্রীতি বা অ্যাডভেঞ্চারিজমের গন্ধ একটু বেশি আছে।

নিক্সন কেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঠেকাতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন, তার প্রধান কারণটি রাজনৈতিক। তবে ব্যক্তিগত কারণটিও গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক কারণটি হলো- পুরনো মিত্র পাকিস্তানের প্রতি বন্ধুত্ব এবং নতুন মিত্র চীনের সাথে তাল মিলিয়ে চলা। আর ইন্দিরা গান্ধীকে তিনি ব্যক্তিগতভাবে অপছন্দ করতেন। তাই ইন্দিরার বিরোধিতা করা তার জন্য ছিল অবশ্যসম্ভাবী।

নিক্সনের সঙ্গে ইন্দিরার প্রথম সাক্ষাৎ ১৯৫৩ সালে। নিক্সন বিশ্বভ্রমণের অংশ হিসেবে ভারত ও পাকিস্তান সফর করেন সে বছর। নিক্সন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেহেরুকে ‘আনফ্রেন্ডলি’ বলে বর্ণনা করেন। আইয়ুব খানের সাথেও নিক্সনের দেখা হয়। আইযুবকে তিনি ‘আমার বন্ধু’ বলে সম্বোধন করেছিলেন। ১৯৬৭ সালে আবার  নিক্সন ভারত বেড়াতে আসেন। তত দিনে পাকিস্তানের প্রতি তার অন্ধপ্রেম সর্ম্পকে ভারত অবগত। ইন্দিরা তার সঙ্গে স্পষ্ট দূরত্ব বজায় রাখেন, বিশেষ কোনো আতিথেয়তা পাননি নিক্সন। ১৯৬৯ সালে রিচার্ড নিক্সন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর পাকিস্তানের প্রতি ঝুঁকে পড়লেন। কূটনৈতিক ভাষায় যাকে বলা হয় ‘Tilt Policy’- কোনো নির্দিষ্ট দেশের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করা। ১৯৭০ সালে ইয়াহিয়া খান যখন আমেরিকায় বেড়াতে আসেন, হোয়াইট হাউসে এক বৈঠকে সে সময় নিক্সন তাকে অযাচিতভাবে বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানের প্রতি তার চেয়ে অধিক সদয় এমন আর কেউ কখনোই এই ভবনে অর্থাৎ হোয়াইট হাউসে ঢোকেনি।’ তাই বলা যায়, পাকিস্তানের এমন সদয় বন্ধু পাকিস্তানের সব বর্বর কাণ্ড নির্লজ্জভাবে সমর্থন তো করবেই।

হলোও তাই। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিল রজার্সকে উপেক্ষা করে নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জারকে নিয়ে ভারতবিরোধী এই বলয় গড়ে তুললেন। ভারতবিরোধিতার জন্য কুখ্যাত হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে আদাজল খেয়ে লেগে গেলেন।

বিবেককবান মার্কিন জনগণ ও স্টেট ডিপার্টমেন্ট পাশে ছিল

২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানের তাণ্ডবের পরপরই ২৭ মার্চ নিউইয়র্ক টাইমসের সংবাদদাতা সিডনি শ্যানবার্গ পাকিস্তানিদের গণহত্যা শুরুর খবর পাঠান। ঢাকার মার্কিন কনসাল জেনারেল আর্চার ব্লাডও প্রায় প্রতিদিন গণহত্যার বিস্তারিত বিবরণ পাঠাতে থাকেন। তাতে ব্লাড পাকিস্তানি সেনা কার্যকলাপকে ‘নির্বাচিত গণহত্যা’ বলে অভিহিত করে তার তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করেন। ঢাকায় গণহত্যা শুরু হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কিসিঞ্জার অ্যাকশন গ্রুপের বৈঠক ডাকলেন। কিসিঞ্জারের সাফ কথা, এই মুহূর্তে পাকিস্তানের নিন্দা করলে বা ইয়াহিয়ার ওপর চাপ দিলে কোনো কাজ হবে না।

আরও পড়ুনঃ- মুক্তিযুদ্ধে পরাশক্তিগুলোর দ্বন্দ্বমুখর অবস্থানের নেপথ্যে-১

২৮ ও ২৯ তারিখে নিক্সন ও কিসিঞ্জারের মধ্যে এ নিয়ে টেলিফোনেও মতবিনিময় হয়। তাতে নিক্সন পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতিকে নাইজেরিয়ার বিচ্ছিন্নতাবাদী বায়াফ্রার সঙ্গে তুলনা করে বললেন, বাঙালিদের শাসন করা বরাবরই কঠিন। কিন্তু এখন সবচেয়ে বেশি যা দরকার তা হলো মাথা ঠান্ডা রাখা।

কিন্তু নিক্সন ও কিসিঞ্জারের মাথা ঠান্ডা থাকেনি। ৬ এপ্রিল মার্কিন কনসাল জেনারেল অফিসের মোট ২০ জন সদস্য যৌথভাবে পাঠানো এক টেলিগ্রামে পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ বিষয়ে মার্কিন প্রশাসনের নীরবতার প্রতিবাদ করেন। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির ছোট ভাই এডওয়ার্ড কেনেডি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে সমর্থন দিয়ে নিক্সন প্রশাসনের কঠোর সমালোচনা করেন।

মার্কিন জনগণ ও সুশীল সমাজ পাকিস্তানিদের বর্বরতায় সোচ্চার হয়। এদিকে ভারত-সোভিয়েত রাশিয়া মৈত্রীবন্ধনে আবদ্ধ হয়। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পাকিস্তানের বর্বরতার খবর ছড়িয়ে পড়ে। নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ারে ‘বাংলাদেশ কনসার্ট’ অনুষ্ঠিত হয়। যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করে।

৩ ডিসেম্বর শুরু হয় সর্বাত্মক ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ। ভারতÑপাকিস্তান যুদ্ধের একপর্যায়ে পাকিস্তানের পরাজয় যখন নিশ্চিত, তখন কিসিঞ্জার তার সবচেয়ে বিপজ্জনক খেলা শুরু করলেন। সোভিয়েত ইউনিয়নকে এই বলে ধমক দিলেন যে- সে যদি ভারতকে নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়, তাহলে প্রেসিডেন্ট নিক্সন পরের বছর তার মস্কো ভ্রমণ বাতিল করবেন। অন্যদিকে চীনকে তদবির করা শুরু করলেন, চীন যেন পাকিস্তানের পক্ষে সেনা ব্যবহারের হুমকি দেয়।

১০ ডিসেম্বর ওভাল অফিসে নিক্সন ও কিসিঞ্জারের মধ্যে এ নিয়ে সরাসরি কথা হলো। নিক্সন জানতে চাইলেন, ‘পাকিস্তানকে সাহায্য করা যায়, এমন আর কী করা যায়?’। তিনি জানতে চাইলেন, চীন ভারতকে সাবধান করে দিয়েছে কি না।

কিসিঞ্জার বললেন, ‘আজ রাতেই আমি সে কথা জানতে পারব।’

নিক্সন বলেন, ‘খুব ভালোভাবে চেষ্টা করো, হেনরি। অনেক আগেই চীনাদের উচিত ছিল ভারতকে ধমক দেওয়া। চীন যে সেনা পাঠাচ্ছে, সে কথাটা বলতে হবে। খুব বেশি কিছু না, কয়েক ডিভিশন সেনা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় সরালেই হবে। বুঝলে না, কয়েক ট্রাক, গোটা কয়েক প্লেন আর কি। মানে প্রতীকী একটা কিছু।’

আরও পড়ুনঃ- মুক্তিযুদ্ধে পরাশক্তিগুলোর দ্বন্দ্বমুখর অবস্থানের নেপথ্যে-২

এই আলোচনার এক দিন পর ১১ ডিসেম্বর কিসিঞ্জার যুদ্ধমন্ত্রী মেল লেয়ার্ডকে নির্দেশ দিলেন আণবিক অস্ত্রসজ্জিত সপ্তম নৌবহর ‘এন্টারপ্রাইজ’কে বঙ্গোপসাগরের দিকে অগ্রসর হতে।

১২ ডিসেম্বর পাকিস্তানের দোসর চীনা রাষ্ট্রদূত হুয়াং হুয়া কিসিঞ্জারের সাথে দেখা করেন। নির্লজ্জ কিসিঞ্জার হুয়াং হুয়াকে বললেন ‘আমেরিকা প্রয়োজনে আণবিক অস্ত্র ব্যবহারেও দ্বিধা করবে না।’

অথচ হাস্যকর ব্যাপার হলো কাপুরুষ পাকিস্তানি বাহিনী তখন আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আর সাধের সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করে ১৫ ডিসেম্বর শুধু তার উপস্থিতি জানানোর জন্য, পাকিস্তানকে কোনো সাহায্য করার অভিপ্রায়ে নয়। ১৬ ডিসেম্বর জন্ম হলো রক্তস্নাত বাংলাদেশ।

যুদ্ধপরবর্তী বাস্তবতায় পরাজিত খেলোয়াড়েরা

১৯৭১ সালে বাংলাদেশকে ঘিরে মার্কিন কূটনীতির ব্যর্থতা প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও তার নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা কিসিঞ্জারের জন্য ছিল প্রবল পরাজয়। ২৩ ডিসেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিল রজার্স নিক্সিঞ্জার জুটিকে দায়ী করে বসেন। বাংলাদেশ নিয়ে এই বিপর্যয় নিক্সন কিসিঞ্জারের ব্যক্তিগত সর্ম্পকেও চিড় ধরে। নিক্সন সব দোষ চাপাতে চাইলেন কিসিঞ্জারের ওপর। অবসাদগ্রস্ত ও হতাশ কিসিঞ্জার তার ওপর এই অব্যাহত চাপ সহ্য করতে না পেরে পদত্যাগ করতে চান বলে তার সহকর্মীদের কাছে মন্তব্য করেন।

১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে নিক্সন ও কিসিঞ্জার বিশাল এক সরকারি দল নিয়ে পিকিং সফরে আসেন। আমাদের মেরুদণ্ডহীন বামদের প্রিয় নায়ক মাও সে তুং, প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই, নিক্সন ও কিসিঞ্জার- এই চার নেতা মুখোমুখি আলাপে বসেন। বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে এই চার নেতা গভীর হতাশা ব্যক্ত করে মেনে নিতে বাধ্য হন। তবে মুক্তিযুদ্ধকালে আমাদের সহায়তাকারী ভারত ও সোভিয়েত রাশিয়ার প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করতে পিছপা হননি।

লখেক: বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক

আগামীকাল পড়ুন: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পরাশক্তিগুলোর দ্বন্দ্বমুখর অবস্থানের নেপথ্যে- ৪