তারচেয়ে পাঠ্যবই হেফাজতই লিখুক

আরিফ রহমান
| আপডেট : ০৫ জানুয়ারি ২০১৭, ১৩:৪৪ | প্রকাশিত : ০৫ জানুয়ারি ২০১৭, ১২:৫৯

হেফাজত আর তাদের সমমনারা বারবার দাবি করছিল ২০১৩ সালে প্রণীত বাংলা পাঠ্যপুস্তক নাকি হিন্দুত্ববাদী লেখায় পরিপূর্ণ। তাদের দাবির মুখে সরকার পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন এনেছে। মেনে নেয়া হয়েছে তাদের সবকয়টা দাবি। আমি দুই কিস্তির একটা লেখা লিখবো যেখানে দেখানোর চেষ্টা করবো প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম এবং ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তকে কী এমন লেখা আছে যা মুসলমানের ধর্ম পালনে বাঁধা দেয় কিংবা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয় কিংবা কোন একটা নির্দিষ্ট ধর্ম সম্পর্কে উৎসাহিত করে। NCTB -র ওয়েবে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত বই পেলাম। তাই প্রথম লেখা এই পাঁচটি বই নিয়ে। সিক্স থেকে টেন পর্যন্ত বইগুলো পেলে সেটা নিয়ে আলোচনা করা যাবে।

ক্লাস ওয়ান থেকে ফাইভের পাঠ্যপুস্তকে কিছু কিছু গল্প-প্রবন্ধে লেখকের নাম উল্লেখ করা হয় নাই। সেগুলো পরীক্ষা করেও দেখা গেলো তেমন একটা সাম্প্রদায়িক উপাদান নাই। আসুন দেখা যাক নতুন হেফাজতি পরিবর্তনের আগে আমাদের পাঠ্যপুস্তকে এমন কী ছিল যাতে ধর্মানুভূতির এমন ক্ষতি হয়ে গেলো-

প্রথম শ্রেণি (২০১৩ সংস্করণ)-

  • ইতল বিতল- সুফিয়া কামাল (কবিতা)
  • বাক বাকুম পায়রা- রোকনুজ্জামান খান (কবিতা)
  • হনহন পনপন- সুকুমার রায় (কবিতা)
  • মামাবাড়ি- জসিমউদ্দিন (কবিতা)
  • ভোর হলো- নজরুল (কবিতা)
  • ছুটি- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (কবিতা)

পর্যবেক্ষণ: প্রথম শ্রেণির পাঠগুলো পরীক্ষা করে দেখা যায় এখানে উল্লেখিত প্রতিটা কবিতাই পরিচিত বহুলপঠিত এবং অত্যন্ত মার্জিত। এই শ্রেণিতে দুটো কবিতা লিখেছেন হিন্দু কবি সুকুমার রায় এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কবিতা দুটোতে কোন নির্দিষ্ট ধর্মের প্রতি ইঙ্গিত বোঝা যায় না।

দ্বিতীয় শ্রেণি (২০১৩ সংস্করণ)-

  • আমার দেশ- আ ন ম বজলুর রশিদ (কবিতা)
  • আমি হব- কাজী নজরুল ইসলাম (কবিতা)
  • আমাদের ছোট নদী- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (কবিতা)
  • ট্রেন- শামসুর রাহমান (কবিতা)
  • দুখুর ছেলে বেলা ( বিদ্রোহী কবির সংক্ষেপিত জীবনী)
  • কাজের আনন্দ- নবকৃষ্ণ ভট্রাচার্য (কবিতা) (মৌমাছি, মৌমাছি, কোথা যাও নাচি নাচি...)
  • প্রার্থনা- সুফিয়া কামাল (কবিতা) (তুলি দুই হাত করি মোনাজাত...)

পর্যবেক্ষণ: দ্বিতীয় শ্রেণির পাঠগুলো পরীক্ষা করে দেখা যায় এখানে উল্লেখিত প্রতিটা কবিতাই পরিচিত বহুল পঠিত এবং অত্যন্ত মার্জিত। এই শ্রেণিতে দুটো কবিতা লিখেছেন হিন্দু কবি, নবকৃষ্ণ ভট্রাচার্যের বিখ্যাত কবিতা ‘মৌমাছি, মৌমাছি, কোথা যাও নাচি নাচি’ এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে...’ কবিতা দুটোতে কোন নির্দিষ্ট ধর্মের প্রতি ইঙ্গিত বোঝা যায় না। তবে এর বিপরীতে সুফিয়া কামালের ‘প্রার্থনা’ কবিতাটি একটি নির্দিষ্ট ধর্মের দিকে ইঙ্গিত করে।

তৃতীয় শ্রেণি (২০১৩ সংস্করণ)-

  • হাটে যাবো- আহসান হাবীব (কবিতা)
  • আমাদের এই বাংলাদেশ- শামসুল হক (কবিতা)
  • চল চল চল- কাজী নজরুল ইসলাম (কবিতা)
  • আমার পণ- মদনমোহন তর্কালঙ্কার (কবিতা) (সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি...)
  • আমাদের গ্রাম- বন্দে আলী মিয়া
  • আদর্শ ছেলে- কুসুমকুমারী দাশ (কবিতা) (আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে...)
  • ঘুড়ি- আবুল হোসেন
  • বড় কে?- ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্ত (কবিতা) (আপনাকে বড় বলে বড় সে নয়...)

পর্যবেক্ষণ: তৃতীয় শ্রেণির পাঠগুলো পরীক্ষা করে দেখা যায় এখানে উল্লেখিত প্রতিটা গল্প-কবিতাই পরিচিত বহুল পঠিত এবং অত্যন্ত মার্জিত। এই শ্রেণিতে তিনটি কবিতা লিখেছেন হিন্দু কবি। ‘আমার পণ’ মদনমোহন তর্কালঙ্কারের এক বিখ্যাত কবিতা যেটার ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি...’ বহু বছর ধরেই আছে আমাদের পাঠ্য পুস্তকে। ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে/ কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে’, ‘আদর্শ ছেলে’ কুসুমকুমারী দাশের অন্যতম সেরা এক কবিতা আছে এই শ্রেণির পাঠে এছাড়া ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্তের লেখা ‘বড় কে?’ কবিতাটির ‘আপনাকে বড় বলে বড় সে নয়/ লোকে যারে বড় বলে বড় সেই হয়’ এ’দেশে প্রবাদতুল্য জনপ্রিয়। উল্লেখিত কবিতা তিনটিতে কোন নির্দিষ্ট ধর্মের প্রতি ইঙ্গিত বোঝা যায় না।

চতুর্থ শ্রেণি (২০১৩ সংস্করণ)-

  • মুক্তির ছড়া- সানাউল হক (কবিতা)
  • বাংলার খোকা- মমতাজউদ্দিন আহমেদ
  • তিনজন বীরশ্রেষ্ঠ-কে নিয়ে একটি রচনা
  • নেমন্তন্ন- অন্নদাশঙ্কর রায় (কবিতা)
  • বেগম রোকেয়াকে নিয়ে আলোচনা
  • আবোল তাবোল- সুকুমার রায় (কবিতা)
  • মোদের ভাষা- সুফিয়া কামাল (কবিতা)
  • কাজলা দিদি- সতীন্দ্র মোহন বাগচী (কবিতা)
  • বীরপুরুষ- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (কবিতা)
  • পাঠান মুলুক- সৈয়দ মুজতবা আলী (ভ্রমণ)
  • মা- কাজী নজরুল ইসলাম

পর্যবেক্ষণ: চতুর্থ শ্রেণির পাঠগুলো পরীক্ষা করে দেখা যায় এখানে উল্লেখিত প্রতিটা গল্প-কবিতাই পরিচিত বহুল পঠিত এবং অত্যন্ত মার্জিত। এই শ্রেণিতে চারটি কবিতা লিখেছেন হিন্দু কবি। অন্নদাশঙ্কর রায়, সুকুমার রায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং সতিন্দ্র মোহন বাগচী। সতিন্দ্র মোহন বাগচীর ‘কাজলা দিদি’ কবিতাটি এ’দেশে প্রবাদতুল্য জনপ্রিয় কবিতা। উল্লেখিত কবিতা চারটিতে কোন নির্দিষ্ট ধর্মের প্রতি ইঙ্গিত বোঝা যায় না।

পঞ্চম শ্রেণি (২০১৩ সংস্করণ)-

  • ফেব্রুয়ারির গান- লুৎফর রহমান রিটন (কবিতা)
  • সংকল্প- কাজী নজরুল ইসলাম (কবিতা)
  • শব্দদূষণ- সুকুমার বড়ুয়া (কবিতা)
  • তিনজন বীরশ্রেষ্ঠ-কে নিয়ে একটি রচনা
  • বই- হুমায়ূন আজাদ (কবিতা)
  • স্বদেশ- আহসান হাবীব (কবিতা)
  • অবাক জলপান- সুকুমার রায় (গল্প)
  • ঘাসফুল- জ্যতিন্দ্রিয় মৈত্র (কবিতা)
  • দুই তীরে- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (কবিতা)
  • বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসুকে নিয়ে প্রবন্ধ
  • প্রার্থনা- গোলাম মোস্তফা (কবিতা) (অনন্ত অসীম প্রেমময় তুমি/বিচার দিনের স্বামী...)
  • ফুটবল খেলোয়াড়- জসিমউদ্দিন
  • এভারেস্ট জয়ী মূসা ইব্রাহীমকে নিয়ে প্রবন্ধ
  • রৌদ্র লেখে জয়- শামসুর রাহমান (কবিতা)
  • অপেক্ষা- সেলিনা হোসেন

পর্যবেক্ষণ: এই শ্রেণির পাঠগুলো পরীক্ষা করে দেখা যায়, এখানে উল্লেখিত প্রতিটা গল্প-কবিতাই পরিচিত বহুল পঠিত এবং অত্যন্ত মার্জিত। এই শ্রেণিতে তিনটি কবিতা লিখেছেন হিন্দু কবি, একটি রচনা বৌদ্ধ লেখকের। উল্লেখিত কবিতা চারটিতে কোন নির্দিষ্ট ধর্মের প্রতি ইঙ্গিত বোঝা যায় না। তার বিপরীতে কবি গোলাম মোস্তফার প্রার্থনা কবিতাটিতে নিঃসন্দেহে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় দৃষ্টি প্রাধান্য পেয়েছে।

এখন যদি একটু হাতে হাটে গুণতে বসি তাহলে দেখতে পাবো এই পাঁচটি শ্রেণির বাংলা বইয়ে ৫০-টির অধিক গল্প-কবিতা-জীবনী-প্রবন্ধ ইত্যাদির বিপরীতে লেখকদের ব্যক্তিগত ধর্ম হিসেব করলে দেখা যাবে মাত্র ১৬টি গল্প-কবিতা-জীবনী-প্রবন্ধ ইত্যাদি ভিন্ন ধর্মালম্বীদের লেখা। যার ভেতর একা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আছে পাঁচটি আর সুকুমার রায়ের আছে তিনটি। আর যে সমস্ত কবিতা-গল্প যুক্ত আছে এই ক্লাস ওয়ান থেকে ক্লাস ফাইভের পাঠ্যপুস্তকে, তার প্রতিটাই অত্যন্ত জনপ্রিয়। এসবের ভেতর দিয়ে কোন নির্দিষ্ট ধর্মের প্রতি আলাদা ভাবে ভালোবাসা কিংবা কোন নির্দিষ্ট ধর্মের প্রতি আলাদাভাবে বিদ্বেষ ছড়ানো হয়নি। সবগুলো রচনাই একটা শিশুকে মানবিক করে গোড়ে তোলার পক্ষে প্রয়োজনীয়।

তাহলে একেবারে টু-দ্যা পয়েন্ট এনালাইসিসে দেখা যাচ্ছে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তকে সমস্ত রচনার সাকুল্য চার-ভাগের এক-ভাগ মুসলমান ব্যতীত অন্য কোন ধর্মের লেখকের লেখা। অর্থাৎ এটা প্রমাণিত যে হেফাজতের দাবি করা ‘পাঠ্যপুস্তকে হিন্দু লেখকের ছড়াছড়ি’ কথাটি এই পাঁচ শ্রেণির জন্য সম্পূর্ণ অসাড় দাবি। একই ভাবে হেফাজতের দাবি করে ‘পাঠ্যপুস্তকে হিন্দুত্ববাদ ছড়ানো হচ্ছে’ এমন দাবিও অসাড়।

হেফাজতে ইসলাম একটি উগ্রবাদী সংগঠন।

এরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টে তৎপর।

এদের উদ্দেশ্য যে অসৎ এবং মিথ্যা সেটা উপরের লেখা প্রমাণ করে।

লেখক: অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :