পাঠ্যবই থেকে ‘বাংলাদেশের হৃদয়’ বাদ; জাতীয় সংগীত কি আশঙ্কামুক্ত?

আরিফ রহমান
| আপডেট : ০৯ জানুয়ারি ২০১৭, ১১:৫০ | প্রকাশিত : ০৭ জানুয়ারি ২০১৭, ১৫:০৬

আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি

তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী!

ওগো মা, তোমায় দেখে দেখে আঁখি না ফিরে!

তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে।

সাদি মহাম্মদের কণ্ঠে গানটা আমাদের অনেক অনেক বার শোনা। পাঠ্যপুস্তক থেকে রবিঠাকুরের ‘বাংলাদেশের হৃদয়’ কবিতাটি বাদ দেয়া হয়েছে। হেফাজত দাবি করেছিলো এই কবিতাটাতে হিন্দুদের দেবী দুর্গাকে প্রমোট করে হিন্দুত্ববাদ উসকে দিচ্ছে। দুর্গার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়ে আলোচনা করার মাধ্যমে সরকার ছোটছোট ছেলেদের মাথায় হিন্দুত্ববাদ ঢুকিয়ে দিচ্ছে। এটা নিয়ে ব্যাপক প্রচারণা চলতে থাকে। তেমন একটি উগ্র সাইট থেকে নিচের ছবিটি পাওয়া যায়-

এ ধরণের ছবি হরহামেশা আমরা দেখেছি ফেসবুকের বিভিন্ন পেইজে, বিভিন্ন ব্লগে। আমাদের সরকার এসব দাবি আমলে নিয়ে অনেক কবিতা গদ্যের সাথে সাথে এই কবিতাটাও সরিয়ে নিয়েছে।

যাক, খুবই ভালো কথা। এবারে আসুন একটু চুল-চিঁড়ে দেখি এই দাবির পেছনের সত্যতা। উপরের লাইনগুলো বাদেও যদি আরও কিছু লাইনকে আলোচনায় আনি তাহলে দেখার মত আরও কিছু লাইন এই কবিতায় আছে যেমন-

‘ডান হাতে তোর খড়্গ জ্বলে, বাঁ হাত করে শঙ্কাহরণ,

দুই নয়নে স্নেহের হাসি, ললাটনেত্র আগুনবরণ’

হাতের কথা আছে, মন্দিরের কথা আছে, চোখের কথা আছে, কপালের কথা আছে। এসব তো মানুষের থাকে। যতই ভুমিকায় বাংলাদেশ লেখা থাকুক, প্রত্যঙ্গগুলোতো মানুষের দেহের, আবার মন্দিরের কথাও আছে। মন্দিরের ভেতরে থাকা মানুষ যার ললাটে অগ্নি। ইয়েস নিঃসন্দেহে এটা দুর্গা। উপরের লাইন গুলকে যদি আক্ষরিক অর্থে নিয়ে দুর্গার হাতের সাথে তুলনা করে নিজের অনুভূতিকে আহত করতে চান তাহলে একটা পরিচিত গানের সাথে পরিচিত করাই-

আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি।

চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি।

ও মা, ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রানে পাগল করে--

মরি হায়, হায় রে ও মা, অঘ্রানে তোর ভরা খেতে,

আমি কি দেখেছি মধুর হাসি।

কি শোভা কি ছায়া গো,কি স্নেহ কি মায়া গো--

কি আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে, নদীর কূলে কূলে।

মা, তোর মুখের বাণী আমার কানে লাগে সুধার মতো--

মরি হায়, হায় রে মা, তোর বদনখানি মলিন হলে আমি নয়ন জলে ভাসি।

উপরের লাইন গুলো ভালো করে লক্ষ্য করুণ বন্ধুগণ। ভালো করে পরচিত গানটাকে দেখুন। দেখুন কি বলা হয়েছে। ৪৫ বছর ধরে বারবার শুনেও যে ভুল গুলো আপনার চোখ এড়িয়ে গেছে আর সেই চোখ দিয়েই আরেকবার দেখুন।

"কি আঁচল বিছায়েছ..."/

"আমি কি দেখেছি মধুর হাসি..."/

"মা, তোর মুখের বাণী..."/

"মা, তোর বদনখানি মলিন হলে..."

দেশের কি আঁচল আছে যে বিছাবে?

দেশের কি মুখ আছে যে হাসবে বা কথা বলবে?

দেশের বদন কিভাবে মলিন হয়, দেশ কি মানুষ?

তাহলে যতই সোনার বাংলা বলা হোক আসলে ভেতরে ভেতরে বোঝা যাচ্ছে এটা কোন হিন্দু দেবী। আচ্ছা যেহেতু মন্দিরের কথা বলা হয় নাই সুতরাং দেবী নাকি সেটা শতভাগ গ্যারান্টি দিয়ে বলা যাচ্ছে না। তবে হিন্দু নারী যে এটা নিশ্চিত। বলতে পারেন হিন্দু কিভাবে বলছি? সেই যুক্তি তে বলছি যেই যুক্তিতে ‘বাংলাদেশের হৃদয়’ কবিতার নারী সত্ত্বাকে অন্য কোন ধর্মের দেবী না বলে হিন্দু বলা হয়েছে (এটাকে সংক্ষেপে বলতে পারেন হেফাজত লজিক সিস্টেম ‘হেলসি’)।

অর্থাৎ উপরের আলোচনা প্রতীয়মান করে যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শুধু এক ‘বাংলাদেশের হৃদয়’ কবিতাই হিন্দুত্ববাদী কবিতা নয় বরং ‘আমার সোনার বাংলা’ গীতি-কবিতাটিও হিন্দুত্ববাদী (ঘটনাচক্রে এই গীতি-কবিতাটি দেশের জাতীয় সংগীত), হিন্দুত্ববাদ উস্কে দেয়।

তাই এই গানটি বাদ না দিয়ে পাঠ্যপুস্তক সংশোধন করে কোন লাভ হবে না। যদি প্রকৃতই হেফাজতের দাবি অনুসারে উক্ত কবিতা হিন্দুত্ববাদকে উস্কে দিয়ে থাকে তাহলে আমাদের জাতীয় সংগীতকেও একই যুক্তিতে কাঠগড়ায় তোলা যায় বৈ-কি।

আমরা সবাই জানি বুঝি যে এই গান গুলো এই কবিতা গুলো রুপক অর্থে লেখা। প্রতীকী অর্থে দেশের প্রতি মমতা প্রদর্শন। এসবের সাথে কোন ধর্ম জড়িয়ে নেই। আছে শুধু দেশের প্রতি ভালোবাসা। আসলে বলতে হয় ‘ছিল শুধু দেশের প্রতি ভালোবাসা’। স্বাধীনতার বিগত ৪৫ বছরে এসব গান-কবিতায় সাম্প্রদায়িক উপাদান খোঁজ করেনি কেউ। আজ এতদিন পরে এসব শিল্পকে যখন উগ্রবাদীরা আস্ফালনের উপাদান বানাচ্ছে তখন আমাদের সরকারও তাদের দাবি মেনে নিয়ে ঢোলে তাল দিয়ে যাচ্ছে।

তাহলে এখন উপায় কি? সামনের বাংলাদেশ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? যারা রবি ঠাকুরকে হিন্দুত্ববাদের প্রচারক হিসেবে পরিচিত করতে চায় তারাই যদি রাষ্ট্রের চোখে সঠিক হয়ে থাকে তাহলে জাতীয় সংগীতে আঘাত আসতে কি খুব বেশি সময় বাকি?

লেখক: অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :