প্রসঙ্গ: গ্যাং কালচার ও কিশোরদের অপরাধ প্রবণতা

প্রকাশ | ১৯ জানুয়ারি ২০১৭, ১৩:৪৫

এস এম কায়উম

সম্প্রতি উত্তরায় স্কুলপড়ুয়া কিশোর আদনান কবির খুনের ঘটনার মধ্য দিয়ে গ্যাং কালচার বিষয়টি আবার আমাদের সামনে চলে এসেছে।  যদিও গ্যাং কালচার আমাদের দেশে বেশ আগে থেকেই ছিল, তবে এই মর্মান্তিক হত্যার মধ্য দিয়ে এর সহিংস রূপটি আবার আমরা দেখতে পেলাম।

যতদূর জানা যায় যে, উত্তরা ১৯ নম্বর সেক্টরে দুটি গ্রুপের দ্বন্দ্বের জেরে এই হত্যা ঘটে, যার একটি নাইন স্টার গ্রুপ (ফেসবুক আইডি নাইনএমএম বয়েজ) এবং অপরটি ডিসকো বয়েজ (ফেসবুক আইডি ডিসকো বয়েজ উত্তরা)।  কিশোর ও উঠতি তরুণরাই মূলত গ্যাং দুটোর সদস্য, যাদের বেশিরভাগই স্কুলপড়ুয়া কিশোর। আর কিছু অছাত্র তরুণও রয়েছে। এদের অনেকেই এলাকায় চিহ্নিত অপরাধী, যাদের বিরুদ্ধে ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ রয়েছে। 

এসব গ্রুপে উচ্চবিত্ত পরিবারের সদস্য ছাড়াও মধ্যবিত্ত, এমনকি নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলেরা রয়েছে। জোরে হর্ন বাজিয়ে মোটরসাইকেল চালানো, রেস করা, মেয়েদের উত্যক্ত করা, ভয় বা দাপট দেখানো, পার্টি করা ও এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, এসবই এদের মূল কাজ। এসব  বিষয়ে দ্বন্দ্বের জের ধরেই নবম শ্রেণি পড়ুয়া এই কিশোর খুন হয়েছে বলে গণমাধ্যমে জানা যাচ্ছে।

তবুও বর্তমান প্রেক্ষাপটে যে প্রশ্নগুলো সামনে চলে আসছে,  কীভাবে একটি স্কুল ছাত্র এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়? কীভাবেই বা এদের মনে এ চিন্তার উদ্রেক হবে যে ভয় দেখানোর মাধ্যমে আধিপত্য বিস্তার করা যায়? কেনই বা এ বয়সের কিশোরদের মধ্যে প্রতিহিংসামূলক হত্যার প্রবৃত্তি হবে?  আমরা যদি এ প্রশ্নগুলো নিয়ে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা বা ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ না করি, তবে সামনে আমাদেরকে আরও মূল্য দিতে হতে পারে।

আমাদের দেশে বিভিন্ন এলাকায় পাড়া-মহল্লাতে বিভিন্ন ধরনের গ্রুপিং বা এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করার প্রবণতা নতুন নয়। তবে এত কম বয়সে আধিপত্য বিস্তারের এই সহিংস রূপ ইতিপূর্বে কখনো দেখা যায়নি। জানা যায়, ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েই এই খুন করে কিশোররা।

অর্থাৎ এটি একটি পরিকল্পিত খুন। এই বয়সের ছেলেদের মধ্যে এ রকম অপরাধপ্রবণতা সমাজের জন্য অশুভ বার্তা দেয়। শিশু-কিশোরদের মানস ও চরিত্র গঠনে পারিবারিক ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

পারিবারিক দৃঢ় বন্ধন শিশু-কিশোরদের সমাজে দায়িত্বশীল আচরণ করতে শেখায়। কিন্তু  পারিবারিকভাবে আমরা আমাদের সন্তানদের সঠিক শিক্ষা দিতে ব্যর্থ হচ্ছি। আমরা আমাদের সন্তানদেরকে ঠিকমতো সময় দিতে পারছি না। তাদের মনোভাব বুঝতে চেষ্টা করি না। তাদের চিন্তা-চেতনার খোঁজ আমরা নিই না। ফলে আমাদের চেনা সন্তানেরা অচেনা আচরণ করছে। তারা চরাঞ্চলে ট্রেনিং নিয়ে ধর্মের দোহাই দিয়ে গুলি করে মানুষ হত্যা করছে। সমাজে দৌরাত্ম প্রদর্শন করছে। অসহিষ্ণু ও সহিংস আচরণ করছে। তার দায়ভার পরিবার কোনভাবে অস্বীকার করতে পারে না।

প্রত্যেক বাবা-মাকেই সন্তানের দিকে মনোযোগী হতে হবে। তাদেরকে বুঝতে হবে। তাদের আরও সময় দিতে হবে। পরিবারকে সন্তানের পড়াশোনার পাশাপাশি অন্যান্য সামাজিক ও সাংস্কৃতি কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ কারার জন্য উৎসাহিত করতে হবে। সন্তান কাদের সঙ্গে মিশছে, সে বিষয়ে নজর রাখতে হবে। তা না হলে এই কিশোরদেরকে আমরা মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবো না।

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এখন অনেক বেশি ফলাফলকেন্দ্রিক। সেখানে শিক্ষার গূঢ় মাহাত্ম্য অনেকটাই অনুপস্থিত। প্রতিষ্ঠানগুলোতে পাঠদানের পাশাপাশি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড নেই, ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো ছাত্রদের চারিত্রিক গঠনে ভূমিকা রাখতে পারছে না। আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এখন শুধু ভাল ছাত্রছাত্রী তৈরিতে ব্যস্ত, ভাল মানুষ তৈরিতে ততটা নয়।

বাণিজ্যিক মনোভাব পরিহার করা প্রয়োজন নতুবা পরোক্ষভাবে আমরা আমাদের শিশু-কিশোরদের বিকাশ ব্যহত হবে। স্কুলপড়ুয়া কিশোরদের ওপর এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে উচ্চপ্রযুক্তিগত বিভিন্ন গেমস, মুভি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অতিনির্ভর হয়ে পড়ছে আমাদের শিশু কিশোরেরা। এখন খেলাধুলা করার সুযোগ নেই বললেই চলে। প্রয়োজনীয় খেলার মাঠ খুবই অপ্রতুল। ফলে নানা ধরনের বিরূপ প্রবণতা দেখা যাচ্ছে উঠতি কিশোরদের মধ্যে ।

ঢাকা শহরের অনেক এলাকাতেই  এই গ্যাং কালচার ছড়িয়ে পড়েছে। ক্ষমতা দেখানোর প্রবণতা, ভয় দেখানোর মাধ্যমে আধিপত্য বিস্তার, সহিংস আচরণের কারণে গ্যাং কালচার সমাজজীবনের জন্য এখন হুমকিস্বরূপ। বিভিন্ন কম্পিউটার গেমসের সহিংসতা ও ধ্বংসাত্মক প্রক্রিয়া তাদেরকে নানাভাবে এসব হিরোইজমে উদ্বুদ্ধ করছে। অনেকে আছে যারা ইচ্ছার বিরুদ্ধে শুধু মাত্র টিকে থাকার জন্যও গ্যাং কালচারের সাথে যুক্ত হচ্ছে, যাদের অনেকেই আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। মানুষ এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে বাস করছে। এসবের পেছনে দুর্নীতির, ক্ষমতার ভূমিকা রয়েছে।

সমাজে দুর্নীতিবাজদের চাকচিক্যময় জীবন তাদেরকে প্ররোচিত, প্রভাবিত করছে। আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীও দায় এড়াতে পারে না। দীর্ঘদিন থেকে এলাকায় গড়ে ওঠা গ্যাং কালচার সম্পর্কে তারা অবহিত হওয়া সত্ত্বেও কোন ধরনের কার্যকরী পদক্ষেপ তারা ব্যর্থ হয়েছেন। জানা যায়, দুই গ্রুপের পারস্পরিক সংঘাতে উত্তরা থানায় পর্যন্ত পাঁচটি মামলা দায়ের হয়েছে। কিন্তু প্রশাসন যথাসময়ে যথাযত ব্যবস্থা নিতে পারেনি। দুঃখজনক হলেও সত্য যে এক শ্রেণির স্বার্থান্বেষী মহলও রয়েছে যারা এসব কিশোর অপরাধীদের আশ্রয় দিচ্ছে। তাই এসব গডফাদারদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনতে হবে। এবং প্রতিটি অপরাধের বিচার কার্যকর করার প্রক্রিয়ায় চালু রাখতে হবে। নতুবা অপরাধের মাত্রা বাড়তেই থাকবে সমাজে এবং  গ্যাং কালচার চলতেই থাকবে। তাই গ্যাং কালচারের নামে উঠতি কিশোরদের ভয়ঙ্কর অপরাধ প্রবণতা প্রতিরোধে  পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীভাবে এখনই ব্যবস্থা নেওয়া অবশ্যকর্তব্য। এবং এই সামাজিক ব্যধি রোধকল্পে আমাদের একযোগে কাজ করতে হবে।

লেখক: ফ্রিল্যান্স লেখক