দুরারোগ্য ব্যাধি: চারজনের মৃত্যু চেয়ে প্রশাসনের কাছে আবেদন

প্রকাশ | ২০ জানুয়ারি ২০১৭, ২০:১৯ | আপডেট: ২০ জানুয়ারি ২০১৭, ২০:২০

মাহাবুব আলম, মেহেরপুর থেকে

দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত পরিবারের চার সদস্য। চিকিৎসার সামর্থ্য নেই। এই অবস্থায় নিরুপায় হয়ে মৃত্যু চাইছেন সবাই। কিন্তু আইন অনুযায়ী, আত্মহত্যা করা যায় না। তাই প্রশাসনের কাছে আবেদন করলেন তারা স্বেচ্ছামৃত্যুর।

ঘটনাটি ঘটেছে মেহেরপুরে। বৃহস্পতিবার জেলা প্রশাসনের কাছে জমা দেয়া আবদনে পরিবারপ্রধান তোফাজ্জেল হোসেন বলেছেন, ‘হয় তাদেরকে মরে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হোক, নতুবা তাদের চিকিৎসার খরচ বহন করা হোক।’

তোফাজ্জেলের স্ত্রী বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। ডুফিনি মাসকুলার ডিসট্রোফি নামে বিরল রোগে আক্রান্ত হয়ে দুই ছেলে ২৪ বছর বয়সী আবদুর সবুর এবং আট বছর বয়সী রায়হান হোসেনও শয্যাশায়ী। মেয়ের একমাত্র ছেলে সৌরভ হোসেনও একই রোগে আক্রান্ত। দেশে ও ভারতে চিকিৎসা করাতে গিয়ে দোকানসহ সহায়-সম্বল সব বিক্রি করেছেন তোফাজ্জেল। এখন চিকিৎসা দূরের কথা, তাদের মুখে ভাত তুলে দিতেই পারছেন না।

চিকিৎসকরা জানান, ‘ডুসিনি মাসকুলার ডিসট্রোফি’ প্রাণঘাতি এই রোগের কোন ওষুধ আজো বিশ্বে আবিষ্কার হয়নি। ফলে আক্রান্ত ব্যক্তির নিশ্চিত পরিণতি পঙ্গুত্ব থেকে মৃত্যু।

তোফাজ্জেল হোসেন জানান, দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় তার বড় ছেলে আবদুস সবুরের শরীরে রোগটি দেখা দেয়। প্রথমে পায়ের শক্তি হারিয়ে যায়। আস্তে আস্তে শরীরের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দুর্বল হয়ে আসতে থাকে।

ছোট ছেলে রায়হান হোসেনও একই অবস্থার দিকে। সে পায়ে কিছুটা বল পেলেও তেমন হাঁটাচলা করতে পারে না। একমাত্র মেয়ের ছেলে সৌরভ হোসেনও বর্তমানে একই রোগে আক্রান্ত।

মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ এইচ এম হাসান আলী মাসুম জানান, ক্রোমজমগত কারণে ছেলেদের এ রোগ হয়। ছেলেদের ১৮-১৯ বছরের মধ্যে এই রোগ দেখা দিতে পারে উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রথম ভর দিয়ে হাঁটতে পারবে না। উপরে উঠতে পারে না। আস্তে আস্তে পঙ্গু হয়ে যাবে। এক পর্যায়ে বিছানাগত এবং ৩০ বছরের মধ্যে মারা যেতে পারে।

সাধারণত মায়েদের কাছ থেকে ছেলেরা এই রোগে আক্রান্ত হয়। মায়েদের থেকে মেয়ে সন্তান আক্রান্ত হয় না। তবে ওই মেয়ের গর্ভের পুত্র সন্তানও একই রোগে আক্রান্ত হতে পারে। যা এই পরিবারে ঘটেছে।

দুই ছেলেকে চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশের বিভিন্ন হাসপাতালের পাশাপাশি ভারতের কয়েকটি হাসপাতালে গিয়েছেন তোফাজ্জেল হোসেন। ভারতের কেয়ার হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ গৌরাঙ্গ মণ্ডল, তপন কুমার বিশ্বাস, ভারতের কোঠারি মেডিকেল সেন্টারের শিশু বিশেষজ্ঞ স্বপন মুখার্জি সবুরের মলমূত্র, রক্ত, কফ পরীক্ষা করে নিশ্চিত হন 'ডুসিনি মাসকুলার ডিসট্রোফি' ডিজিজ হয়েছে। দেশের কয়েকজন চিকিৎসক একই কথা বলেছেন।

সন্তানদের চিকিৎসার জন্য তোফাজ্জেল হোসেন দেশের বিভিন্ন ধনাঢ্য ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, দূতাবাসেও ছুটে গেছেন। ঢাকায় ফ্রান্স দূতাবাস সহযোগিতা দিতে উদ্যোগী হয়েছিল। ইন্টারনেটের মাধ্যমে এই রোগের চিকিৎসা সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের কাছে তথ্য চায়। কিন্তু শত শত চিকিৎসক ইন্টারনেটে জানিয়েছেন, এখনো এই রোগের কোনো ওষুধ আবিষ্কার হয়নি। ফলে তোফাজ্জেল হতাশ হয়ে পড়েন।

ক্যান্সারের চেয়েও এই রোগ ভয়াবহ উল্লেখ করে কয়েকজন শিশু বিশেষজ্ঞ বলেছেন, আক্রান্তের শরীরে সব অংশের মাংসপেশী আস্তে আস্তে জমাট বেঁধে যাবে। চলাফেরা বন্ধের সঙ্গে সঙ্গে কথা বলার শক্তিও হারিয়ে যাবে। তাই চিকিৎসায় সুফল মিলবে না। বয়স বাড়ার সাথে সাথে বাড়বে যন্ত্রণাও।

ভারতের একটি স্বনামধন্য হোমিও চিকিৎসক তোফাজ্জেল হোসেনকে বলেছেন, দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসায় এ রোগ সারিয়ে তোলা সম্ভব। কিন্তু অর্থের অভাবে সেখানে তিনি সন্তানদের নিয়ে যেতে পারছেন না। শেষ চেষ্টা হিসেবে তিনি সেখানে যেতে চান। তাই সন্তানদের ভরণ-পোষণ ও চিকিৎসার জন্য সহৃদয় ব্যক্তিদের কাছে সাহায্যের আবেদন করেছেন তোফাজ্জেল হোসেন।

জেলা প্রশাসকের পরিদর্শন

তোফাজ্জেল হোসেনের আবেদনের প্রেক্ষিতে শুক্রবার দুপুরে তার বাড়ি পরিদর্শন করেন মেহেরপুর জেলা প্রশাসক পরিমল সিংহ। তিনি পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে তাদের কিছু চিকিৎসা ব্যয় বহনের ঘোষণা দেন।

জেলা প্রশাসক বলেন, ‘বিষয়টি অত্যন্ত মানবিক ও হৃদয়বিদারক। আবেদনটি পড়ে চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। এই পরিবারের জন্য আমি সাধ্যমত চেষ্টা করবো।’ সমাজের সকলকেই অসহায় পরিবারটির পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান তিনি।

ঢাকাটাইমস/২০জানুয়ারি/প্রতিনিধি/ডব্লিউবি