বাগেরহাটের ১৪ রাজাকারের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন চূড়ান্ত

প্রকাশ | ২২ জানুয়ারি ২০১৭, ১৬:০৭

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় বাগেরহাটের কচুয়া ও মোড়লগঞ্জের ১৪ রাজাকারের বিরুদ্ধে তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা।

রবিবার রাজধানীর ধানমণ্ডির তদন্ত সংস্থার কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে ৪৫তম এ তদন্ত প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান খান, জ্যেষ্ঠ সমন্বয়ক সানাউল হক এবং এ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মো. হেলাল উদ্দিন সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।

১৪ আসামির মধ্যে চারজন গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে রয়েছেন। তারা হলেন- খান আকরাম হোসেন (৬০), শেখ মোহম্মদ উকিল উদ্দিন (৬২), ইদ্রিস আলী মোল্লা (৬৪) ও মো. মকবুল মোল্লা (৭৯)। গত বছরের ৯ নভেম্বর তাদেরকে সেফহোসে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।

পলাতক দশজন হচ্ছেন- খাঁন আশরাফ আলী (৬৫), সূলতান আলী খাঁন (৬৮), মকছেদ আলী দিদার (৮৩), শেখ ইদ্রিস আলী (৬১), শেখ রফিকুল ইসলাম বাবুল (৬৪), রুস্তম আলী মোল্লা (৭০), মো. মনিরুজ্জামান হাওলাদার (৬৯), মো. হাশেম আলী শেখ (৭৯), মো. আজাহার আলী শিকদার (৬৪) ও মো. আব্দুল আলী মোল্লা (৬৫)। আসামিরা মুসলিম লীগ ও পরে জামায়াতের সমর্থক হিসেবে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেন।

আসামিদের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা-গণহত্যা, নারী ধর্ষণ, অবৈধ আটক, নির্যাতন, অপহরণ, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগসহ সাতটি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনের অভিযোগে বলা হয়, দুইজন মুক্তিযোদ্ধাসহ ২২ জনকে হত্যা, ৪৫/৫০টি বাড়ির মালামাল লুণ্ঠনের পর আগুনে পুড়িয়ে সম্পূর্ণ ধ্বংস করা, দুইজনকে অমানুষিক নির্যাতনে গুরুতর জখম করা এবং চারজন নারীকে দীর্ঘদিন রাজাকার ক্যাম্পে আটকে রেখে পালাক্রমে ধর্ষণ করা। একাত্তরে মে থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বাগেরহাটের কচুয়া ও মোড়েলগঞ্জ উপজেলায় তারা এসব মানবতাবিরোধী অপরাধ করেন বলে অভিযোগে বলা হয়েছে। 

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, এ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মো. হেলাল উদ্দিন ২০১৫ সালের ৪ জুন থেকে আজ পর্যন্ত তদন্তকাজ সম্পন্ন করে সাতটি ভলিউমে মোট এক হাজার ৩০৯ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করেন। মোট ৬১ জন সাক্ষী দেবেন ১৪ আসামির বিরুদ্ধে। তাদের মধ্যে ৫৭ জন ঘটনার সাক্ষী, তদন্তকারী কর্মকর্তা এবং তিনজন জব্দ তালিকার সাক্ষী।

গত বছরের ২৬ জুলাই মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ওই ১৪ আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল। ওইদিনই সন্ধ্যায় বাগেরহাট ও খুলনার বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে চারজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

আসামিদের বিরুদ্ধে সাত অভিযোগ

এক নম্বর অভিযোগ: ১৯৭১ সালের ২৬ মে  রাজাকার খাঁন আশরাফ আলী, খাঁন আকরাম হোসেন, সুলতান আলী খাঁন, রুস্তম আলী মোল্লা, ইদ্রিস আলী মোল্লা, মকছেদ আলী দিদার, উকিল শেখ, ইদ্রিস আলী শেখ এবং শেখ রফিকুল ইসলাম ওরফে বাবুলগনের সঙ্গে ১৫/২০ জন রাজাকার ও ২৫/৩০ জন পাকিস্তান দখলদার সেনাবাহিনীর সদস্যসহ বাগেরহাট জেলার মোড়লগঞ্জ থানাধীন চাপড়ী ও তেলিগাতীতে নিরীহ নিরস্ত্র মুক্তিকামী মানুষদের ওপর অবৈধভাবে হামলা চালিয়ে ৪০/৫০টি বাড়ির সমস্ত মালামাল লুণ্ঠন করে, বাড়িঘর অগ্নিসংযোগে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে, দুইজন নিরীহ নিরস্ত্র মানুষকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুরুতর জখম করে এবং ১০ জন নিরীহ নিরস্ত্র স্বাধীনতার পক্ষের মানুষকে গুলি করে হত্যা করে।

দুই নম্বর অভিযোগ: ১৯৭১ সালের ৭ জুলাই রাজাকার কমান্ডার মো. মনিরুজ্জামান, রাজাকার সদস্য মো. হাশেম আলী শেখ, মো. আজাহার আলী শিকদার এবং মো. মকবুল মোল্লাগন বাগেরহাট জেলার কচুয়া থানাধীন হাজরাখালী ও বৈখালী রামনগরে হামলা চালিয়ে অবৈধভাবে নিরীহ নিরস্ত্র স্বাধীনতার পক্ষের চারজন লোককে আটক ও অপহরণ করে আবাদের খালের ব্রিজে হত্যা করে লাশ খালে ফেলে দেয়।         

তিন নম্বর অভিযোগ: ১৯৭১ সালের ১৩ নভেম্বর রাজাকার খাঁন আশরাফ আলী, খাঁন আকরাম হোসেন, সুলতান আলী খাঁন, রুস্তম আলী মোল্লা, ইদ্রিস আলী মোল্লা, মকছেদ আলী দিদার, উকিল শেখ, ইদ্রিস আলী শেখ এবং শেখ রফিকুল ইসলাম ওরফে বাবুলগন বাগেরহাট জেলার মোড়লগঞ্জ থানাধীন ঢুলিগাতী গ্রামে হামলা চালিয়ে দুইজন নিরস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাকে অবৈধ আটক, নির্যাতন ও গুলি করে হত্যা করে।

চার নম্বর অভিযোগ: ১৯৭১ সালের ১৭ নভেস্বর রাজাকার খাঁন আশরাফ আলী, খাঁন আকরাম হোসেন, সুলতান আলী খাঁন, রুস্তম আলী মোল্লা, ইদ্রিস আলী মোল্লা, মকছেদ আলী দিদার, উকিল শেখ, ইদ্রিস আলী শেখ এবং শেখ রফিকুল ইসলাম ওরফে বাবুল, রাজাকার কমান্ডার মো. মনিরুজ্জামান, রাজাকার মো. হাশেম আলী শেখ, মো. আজাহার আলী শিকদার এবং মো. মকবুল মোল্লাগন বাগেরহাট জেলার কচুয়া থানাধীন বিলকুল ও বিছট গ্রামে হামলা চালিয়ে চারজন নিরীহ নিরস্ত্র স্বাধীনতার পক্ষের লোককে আটক ও অপহরণ করে কাঠালতলা ব্রিজে এনে নির্যাতন করার পর গুলি করে হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দেয়।

পাঁচ নম্বর অভিযোগ: ১৯৭১ সালের ৩০ নভেম্বর রাজাকার খাঁন আশরাফ আলী, খাঁন আকরাম হোসেন, সুলতান আলী খাঁন, রুস্তম আলী মোল্লা, ইদ্রিস আলী মোল্লা, মকছেদ আলী দিদার, উকিল শেখ, ইদ্রিস আলী শেখ, শেখ রফিকুল ইসলাম ওরফে বাবুল, রাজাকার কমান্ডার মো. মনিরুজ্জামান, মো. হাশেম আলী শেখ, মো. আজাহার আলী শিকদার এবং মো. মকবুল মোল্লাগন বাগেরহাট জেলার কচুয়া থানাধীন বিলকুল গ্রাম হতে নিরস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা মুনসুর আলী নকীবকে অন্যায় আটক ও অপহরণ করে মোড়লগঞ্জ থানার দৈবজ্ঞহাটির গরুর হাঁটির ব্রিজের উপরে নিয়ে নির্যাতন করার পর গুলি করে হত্যা করে। 

ছয় নম্বর অভিযোগ: ১৯৭১ সালের ১৬ অক্টোবর রাজাকার কমান্ডার মো. মনিরুজ্জামান, মো. হাশেম আলী শেখ, মো. আজাহার আলী শিকদার, মো. মকবুল মোল্লা এবং আব্দুল আলী মোল্লাগন সঙ্গে আরও ৭/৮ রাজাকার বাগেরহাট জেলার কচুয়া থানাধীন উদানখালী গ্রামে হামলা চালিয়ে স্বাধীনতার পক্ষের নিরীহ নিরস্ত্র উকিল উদ্দিন মাঝিকে অবৈধভাবে আটক করে হত্যা করে এবং তার মেয়ে তাসলিমাকে অবৈধভাবে আটক ও অপহরণ করে কচুয়া রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে আসে। উল্লিখিত আসামি, কচুয়া রাজাকার ক্যাম্প ও আশেপাশের রাজাকার ক্যাম্পের আসামি রাজাকার খাঁন আশরাফ আলী, খাঁন আকরাম হোসেন, সুলতান আলী খাঁন, রুস্তম আলী মোল্লা, ইদ্রিস আলী মোল্লা, মকছেদ আলী দিদার, উকিল শেখ, ইদ্রিস আলী শেখ এবং শেখ রফিকুল ইসলাম ওরফে বাবুলগন দীর্ঘদিন অবৈধভাবে তাসলিমাসহ চারজনকে আটকিয়ে রেখে পালাক্রমে ধর্ষণ করে। ১৬ ডিসেম্বর বিকাল ৪টায় বাংলাদেশ দখলদার মুক্ত হলে মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকার ক্যাম্প তল্লাশি করে ভিকটিম তাসলিমাকে উদ্ধার করে তার বাড়িতে পৌঁছে দেন।

সাত নম্বর অভিযোগ: ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসের প্রথম দিকে রাজাকার কমান্ডার মো. মনিরুজ্জামান, মো. হাশেম আলী শেখ, মো. আজাহার আলী শিকদার, মো. মকবুল মোল্লা এবং আব্দুল আলী মোল্লাগন সঙ্গে আরও ৭/৮ জন রাজাকার বাগেরহাট জেলার কচুয়া থানাধীন গজালিয়া বাজারে হামলা চালিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের নিরীহ নিরস্ত্র শ্রীধাম কর্মকার ও তার স্ত্রী কমলা রানী কর্মকারকে অবৈধভাবে আটক করে নির্যাতন করতে থাকে। আসামিরা শ্রীধাম কর্মকারকে হত্যা করে কমলা রানী কর্মকারকে জোরপূবক অপহরণ করে কচুয়া রাজাকার ক্যাম্পে এনে আটকিয়ে রাখে। উল্লিখিত আসামিসহ কচুয়া রাজাকার ক্যাম্প ও আশেপাশের রাজাকার ক্যাম্পের খাঁন আশরাফ আলী, খাঁন আকরাম হোসেন, সুলতান আলী খাঁন, রুস্তম আলী মোল্লা, ইদ্রিস আলী মোল্লা, মকছেদ আলী দিদার, উকিল শেখ, ইদ্রিস আলী শেখ এবং শেখ রফিকুল ইসলাম ওরফে বাবুলগন, কমলা রানী কর্মকারসহ আটককৃত অন্যান্য চারজনকে দীর্ঘদিন রাজাকার ক্যাম্পে আটকিয়ে রেখে পালাক্রমে ধর্ষণ করে। প্রায় এক মাস শারীরিক নির্যাতনের পর কমলা রানী কর্মকার অসুস্থ হয়ে পড়লে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং তিনি সেখান থেকে পালিয়ে যান।             

(ঢাকাটাইমস/২২জানুয়ারি/এমএবি/জেবি)