বেলা শেষে!

প্রকাশ | ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১১:২৯

দিলরুবা শারমিন

যশোর আমার জন্মস্থান। হয়তো সে জন্যেই সুযোগ পেলেই ছুটে আসি। কখনো মন অশান্ত হলে, কখনো বা ঘুম দিতে ইচ্ছে হলে। বিশ্রামের শ্রেষ্ঠ জায়গা হিসেবে বার বার এখানেই আসতে ইচ্ছে করে। এখানে ঘুমিয়ে আছে আমার মা-বাবা-বোন-ভাই- শ্বশুর-শাশুড়িসহ আরও কতজন পরমাত্মীয়, নিকটাত্মীয়। এখানে জড়িয়ে অছে আমার শৈশব-কৈশর-তারুণ্য, স্কুল-কলেজ, সুরবিতান সঙ্গীত একাডেমি, আমার নৃত্যশিল্পী সংস্থাসহ আরো কত কি। আমার বন্ধুরা। রক্তিয় আত্মীয়-স্বজন। আমার ভাঙ্গা পথের রাঙ্গা ধূলোয় কত স্মৃতি। কত ব্যথা!

ভালো লাগে শহরের সরু গলি-ভাঙ্গা রাস্তা-ঘাট। ভালো লাগে যত্রতত্র এলোমেলো বাজার ঘাট- এবড়ো থেবড়ো পরিকল্পনাহীন ঘরবাড়ি। ভালো লাগে ট্রেনের হুইসেল। ভালো লাগে গায়ে গায়ে লাগা অটোরিকশা আর চালকের এই প্রশ্ন-নতুন আইছেন? সবই ভালো লাগে। ঘুরে বেড়াই এখানে সেখানে-গন্তব্য হীন। আমার তো এখন আর এই শহরে কোন গন্তব্য নাই।

মাঝে মাঝে উঁকি দেই আমার স্কুলে-কলেজে বা সেই সব স্মৃতিময় শৈশবের বাগানে। যেই শহরে একা তো দূরের কথা, কারো সাথেই ঘোরার স্বাধীনতা ছিল না সেই শহরে আজ আমি কত স্বাধীন! স্বাধীনতা শব্দটা কত যে মধুর তা আজ জীবন সায়াহ্নে এসে বুঝলাম। এটা যখন প্রয়োজন তখনই মনে হয় মানুষ পায় না। অথচ সময়মতো ঠিকই মানুষ স্বাধীন হয়ে যায়।

সেই পাবলিক লাইব্রেরি-যশোর সাহিত্য পরিষদ- সেই দড়াটানার মোড় বা চৌরাস্তা অথবা রামকৃষ্ণ আশ্রম। কতই না পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছে। অথচ আমার কাছে সেই সবই যে একই আছে। সেই দুলু দা’র সাথে আশিষের ”সায়মন টাসকার” ব্যাট হাতে ক্রিকেট প্রাকটিস থেকে ফিরে আসা-এত প্রিয় সেটা কবে জানলাম?

বেলা শেষে?

শৈশব-কৈশর কেটেছে ভাইদের কড়া শাসনে। আমার ভাইয়েরা সেকেলে একেবারে সেকেলে। যার জন্য ভাবিদের কোনদিন জোরে নিঃশ্বাস নিতে দেখিনি। তাই যে শহরে জন্মেছি বা বেড়ে উঠছি সেই শহরটা কেমন তা আমাদের কোনদিন দেখার সুযোগ হয়নি।

অচলায়তনে যেটুকু আলো ঢুকে পড়েছিল সেটুকু আমার মায়ের জন্য। সেখানে আর কারো বিশেষ অবদান মনে পড়ে না। বরং ভাইদের স্বৈরশাসনে আমাদের অনেক প্রতিভাই নষ্ট হয়েছে।

সেই ছোট্ট মিষ্টি মফস্বল শহরটি থেকে আমাকে বের করে দিতে পারলেই যেন মা বেচে যেত এমন ভাবেই জোর করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো। সেদিন মাকে শত্রুই ভেবেছিলাম। আমি মা’কে ছেড়ে থাকতে পারতাম না। কিন্তু আজ?

আইন নিয়ে পড়ার সুবাদে এন্টার্নিশিপ করতে যশোর বারে আসি। মা’ই আমাকে নিয়ে আসে আমার ফুফা প্রয়াত নুরুল ইসলামের কাছে। সৌম্যকান্তি ফুফাকে দেখে মানুষ শ্রদ্ধাই করতেন। তিনি প্রকৃত অর্থেই একজন বিজ্ঞ আইনজীবী ছিলেন। জ্ঞানে-মানে-শিক্ষায়-ধ্যান ধারনায় তিনি ছিলেন তুলনাহীন মানুষ। সামান্য ছয় মাসের এন্টার্নশিপে কিই বা শেখা যায়? কিন্তু তার যিনি মহুরি ছিলেন শামসু ভাই যে কত কিছু যে শিখিয়েছিলেন আমাকে! অসাধারণ ব্যক্তিত্ব আর আভিজাত্যের মোড়কে মোড়ানো নুরুল ইসলাম ফুফার সামনে আমি কেঁচো হয়েই থাকতাম। মৃদুভাষী-সুমধুর বাঙ্গময়তায় পটু নুরুল ইসলাম ফুফা চাইতেন আমি মনে প্রাণে আইনজীবী হই আর তার সত্যিকারের ডানহাত হয়ে উঠি। উনি হয়তো বুঝতেন এই পথ আমার ভালো লাগে না! অথচ সেই পথেই আমি হাঁটছি কিন্তু তিনি দেখলেন না।আফসোস!

যশোর এলে আমি একবার হলেও যশোর বারে যাই। পুরাতন মানুষজনের সাথে দেখা হয়। অসংখ্য নবীনের ভিড়ে পুরাতন বিজ্ঞ আইনজীবীরা গুটি শুটি হয়ে আছেন। যত না আইনজীবীর দাপট তার চেয়ে অধিক মহুরি আর দালালদের দাপট। মাঝে মাঝে আদালতগুলোতেও যাই। কোনো কারণ ছাড়াই আমার বসে থাকতে ভাল লাগে। সকলের কথা শুনতে ভাল লাগে। আমার ফুফা নুরুল ইসলাম ছিলেন মূলত ক্রিমিন্যাল প্রাকটিশনার। প্রচুর নাম-যশ-খ্যাতি ছিল তাঁর। বিজ্ঞ আদালতও মেপেই চলতেন।

আমি বিয়ে করেছি এই শহরেই। আমার শ্বশুর ও ছিলেন একজন খুব ভালো এবং বড় মাপের আইনজীবী। তবে সিভিল প্র্যাকটিস করতেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর আদলে গড়া এই মানুষটা আমার অনেক বড় বন্ধু ছিলেন। আমি কোনদিনই তার কাছে প্রথাগত ছেলের বউ ছিলাম না। প্রচণ্ড ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন এই মানুষটা আমাকে একটু বেশি প্রশ্রয়ইদিতেন। তার সাথে আড্ডা দেয়া আর আমার পছন্দের খাবারের যোগান দেয়াই ছিল তাঁর কাজ। জ্ঞ্যানী এই মানুষটি আমাকে নিয়ে কি স্বপ্ন দেখতেন? সেটাও জানিনি কোনদিন। তুমুল বিতণ্ডা হতো রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে। এরশাদের রাজনীতি করবেন না বলে এক কথায় জেলা প্রশাসকের পদটি তিনি ছেড়ে দেন। ক্ষমতা বা টাকা তাকে কোনদিন টেনেছে বলে মনে হয়নি। চমৎকার গান গাইতেন। আমার সাথে তিনি বা তাঁর সাথে আমি। পিতৃতুল্য এই শ্বশুর নাসিরউদ্দীন আহমেদ এর বিপুল জনপ্রিয়তার পরও দেখিনি বারের সভাপতি বা কোন পদে যাবার জন্য কোন আকুলতা। বা মক্কেলদের সাথে কোন ঝুট ঝামেলা।

একে একে চলে গিয়েছেন ফুপা-আমার শ্বশুর। আমি আজো তাদের খুঁজে বেড়াই। যশোর এলেই। আমার জীবনের সেই সব দিন রাত্রি-সেই সময় খুঁজে বেড়াই! কোথায় পাবো তাদের? তবু ছুটে যাই যশোর আদালত পাড়ায়। মুগ্ধ হয়ে শুনি, হাসান ইমাম ভাই, লাল ভাইদের মত বিজ্ঞ আইনজীবীদের সাক্ষীর জেরা বা যুক্তি তর্ক। এই সব শুনতে শুনতেই দিন কেটে যায়। হঠাৎ অনুভব করি বিসিএস দিয়ে যারা সদ্য বিচারক হয়ে আসছেন তাদের অসহায়ত্ব। বাঘা বাঘা এই সব আইনজীবীদের কাছে তারা কি প্রশ্ন করবেন বা কোনটি নিবেন না সেটা হিসাব কষতে বেচারাদের বেশ কষ্ট হয়।

হঠাৎ করেই কিছু আইনজীবী এই সব ক্ষেত্রে তাদেরকে বাঁচিয়ে দেন! যেমন সেদিন একটি মামলা ফাইল হলো পারিবারিক আইনে, ছেলেরা বয়স্ক মা’কে খেতে পড়তে দেয় না। আমি দেখলাম একজন  বয়স্ক মহিলা যার শরীর ও পোশাক জীর্ণ-শীর্ণ-দীর্ণ! তিনি আদালতের ডকে দাঁড়িয়ে শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে মিহি স্বরে বলেই যাচ্ছেন, ”খাইত দেয় না ছেলেরা আমারে খাইত দেয় না’। নবীন আইনজীবী বলেই যাচ্ছেন আর তরুণ বিচারক তরতর মামলা লিখে বৃদ্ধা ও টিপ সই নেবার নির্দেশ দিলেন।

বাধ সাধলাম। বিজ্ঞ আদালতের অনুমতি নিয়েই বললাম, স্যার এটা আপনি চাইলে ‘পিতামাতার ভরণ পোষণ আইনের অধীনে নিতে পারেন দুটি কারণে। প্রথমত উনি যা বলছেন তাতে এই আইনের আওতায়ই মামলাটি হবে আর দ্বিতীয়ত পারিবারিক মামলাটির দীর্ঘসূত্রিতার হাত থেকে উনি বাঁচবেন।’ এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন বিজ্ঞ আদালত।

আমার পরনে আইনজীবীর পোশাক থাকায় একটু সময় নিয়ে বললেন, এটা নিলাম। যদি উনি চান (বৃদ্ধা) তবে না হয় আরেকটি মামলা করবেন। মানেটা কি দাড়াঁলো?

বিস্মিত-হতভম্ব আমি! আমরা আইনজীবীরাই যেখানে ভুল আইনের ধারায় মামলা দায়ের করছি আর বিজ্ঞ আদালত হয়তো পিতামাতার ভরণ পোষণ আইন বিষয়টি নিয়ে ইতোপূর্বে কোনো মামলা করেননি বলেই নতুন করে আর কোনো ঝামেলা বাড়াতে চাইছেন না কিন্তু এই ব্দ্ধৃার কি হবে? তিনি কি একের পর এক মামলা করেই যাবেন নাকি মামলা করার জন্যই কোনো আইন কলেজে এখন ভর্তি হবেন? বা আইনজীবীর শিক্ষানবিশ হবেন? কি হবে এই রকম আইনজীবী দিয়ে? যিনি সম্পূর্ণ ভুল আইনে মামলাটি করলেন তাকে কে কি শিক্ষা দিবে? অথবা মামলায় শেষঅব্দি বিজ্ঞ বিচারক কি আদেশ দেবেন? অথবা বেলাশেষে এই বৃদ্ধাই বা কি বিচার পাবেন। অদ্ভুত আধাঁর এক ঘিরে ফেলছে আমাদের চারিদিক থেকে! এর থেকে মুক্তি কবে, কিভাবে ?

আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী