প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন রাজশাহীর নারীরা

প্রকাশ | ০৮ মার্চ ২০১৭, ২০:০৫

রাজশাহী ব্যুরো প্রধান, ঢাকাটাইমস

উরোশি মাহফিলা ফাতেহা রাজশাহীর একজন সফল নারী উদ্যোক্তা। এই সফল হয়ে উঠতে তাকে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। জয় করতে হয়েছে নানা প্রতিবন্ধকতা। তাই এ বছর তিনি সরকারের ‘জয়ীতা’ পুরস্কারও পেয়েছেন। উচ্চ শিক্ষিত উরোশি এখন অন্য নারীদের আদর্শ। অথচ তার শুরুটা মোটেও সুখকর ছিল না।

রাজশাহী মহানগরীর উপশহর এলাকার বাসিন্দা উরোশি ঢাকাটাইমসকে জানান, ২০০৬ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলায় ভর্তি হন। তারপর দেখেন, পড়াশোনার পরও হাতে প্রচুর সময় থাকছে। সময়টা কাজে লাগাতে তিনি বাসায় শাড়িতে নানা ধরনের অঙ্কন শুরু করেন। এরপর দিনে দিনে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে।

চাহিদা বাড়ে তার কাজের। মাত্র দুই হাজার টাকায় রঙ-তুলি কিনে উরোশি তার কাজ শুরু করেছিলেন। এখন ‘সি’জ’ নামে তার বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানটি অনেক বড়। দেশের গ-ি পেরিয়ে এখন বিদেশেও তার পণ্য রপ্তানি হয়। ২০ জন নারীকে মাসিক বেতনে চাকরি দিয়েছেন উরোশি। আরও এক হাজার নারী তার প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে। শুধু প্রচ- ইচ্ছা শক্তির ওপর ভর করে উরোশি নিজে এগিয়েছেন, অন্যদেরও এগিয়ে নিচ্ছেন।

তবে শুধু উরোশি একা নন। রাজশাহীর অর্থনীতির শক্তিশালী ভিত রচনায় এগিয়ে যাচ্ছেন আরও অনেক নারী উদ্যোক্তা। তারা আজ সমতাভিত্তিক সমাজ নির্মাণে ঘরকন্যার বাধ ভেঙে এক পা, দুই পা করে সফলতার চূড়ায় উঠতে চলেছেন। কৃষি পণ্য উৎপাদনেও সরাসরি জড়িত রাজশাহীর বিপুল সংখ্যক গ্রামীণ নারী।

এছাড়াও ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প, ব্যবসা, চাকরি এমনকি শিল্প কারখানায় পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কাজ করছেন এ অঞ্চলের নারীরা। দিন দিন তাদের সংখ্যা বাড়ছেই।

রাজশাহীতে প্রতিষ্ঠিত নিলয়-ওসমান মোটর ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মাহমুদুন্নবী জুয়েল ঢাকাটাইমসকে জানান, কারাখানাটির ফেব্রিকেশন বিভাগে ১৭২ জন পুরুষ কর্মীর পাশাপাশি ৩০ জন দক্ষ নারী কর্মীও কাজ করছেন। পুরুষ কর্মীদের পাশাপাশি তারাও ভারী কাজ করছেন। কারখানাটিতে এখন প্রতিঘণ্টায় একটি করে ‘নিতা টেম্পু’ তৈরি হচ্ছে। আর প্রতিদিন তৈরি হচ্ছে ১৬টি।

এভাবে রাজশাহীর অর্থনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। গ্রামীণ নারীদেরও অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতো। যদিও এ সূচকে এগিয়ে রয়েছেন শহরের নারীরাই।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ হিসেবে মতে, গত এক দশকে রাজশাহীর অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে ২ দশমিক ৪৯ শতাংশ। এর মধ্যে দশমিক ৪৪ শতাংশ গ্রামীণ এবং ৪ দশমিক ৪৪ শতাংশ শহুরে নারী।

বিভাগীয় পরিসংখ্যান কর্মকর্তা আশরাফুল আলম সিদ্দিকী ঢাকাটাইমসকে জানান, শিক্ষা-দীক্ষা ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা এগিয়ে নিয়েছে শহুরে নারীদের। ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ হারে বর্তমানে কর্মরত শহুরে নারীর সংখ্যা ২৫ হাজার ৫৭ জন। এক দশক আগেও এ সংখ্যা ছিল ৮ হাজার ৭১৮ জন। যা ছিলো মোট শ্রমবাজারের ৮ দশমিক ১২ শতাংশ। এক দশকে তা বেড়েছে ৪ দশমিক ৪৪ শতাংশ।

তিনি আরও জানান, বর্তমানে রাজশাহীতে মোট ৪ লাখ ৪৪ হাজার ৮১ জন কৃষি বহির্ভুত পেশায় জড়িত। এর মধ্যে ৪৯ হাজার ৯৬৯ জন নারী। এক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ ১১ দশমিক ২৫ শতাংশ। আর কৃষিখাতে মোট ৫ লাখ ৬৩ হাজার ১১৩ জন মানুষ কর্মরত। এরমধ্যে ৯৩ হাজার ৩৫৮ জন নারী। এক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ ৭ দশমিক ৯২ শতাংশ। এই হার প্রতিনিয়ত বাড়ছে।

জেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয়ের হিসাবরক্ষক নওশাদ আলী জানিয়েছেন, রাজশাহী মহানগররের নারীদের কর্মমুখী করে তুলতে তারা বছরে পাঁচটি ট্রেডে নারীদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে।

দর্জি বিজ্ঞান, বিউটিশিয়ান, মোবাইল সার্ভিসিং, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও শপিং ব্যাগ তৈরির এই প্রশিক্ষণে প্রতি তিন মাসে প্রতিটি ট্রেডে মোট ১০ জন করে মোট ৫০ জন নারীকে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। চারঘাট ও ও তানোর উপজেলাতেও এই প্রশিক্ষণ প্রকল্প চালু আছে। বাকি উপজেলাগুলোতেও শুরু করার পরিকল্পনা তাদের আছে। শহরের নারীরা এসব প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেরা কর্মমুখী হয়ে উঠছেন। অনেকেই ছোট ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলছেন।

তবে রাজশাহী উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি রোজিটি নাজনীন ঢাকাটাইমসকে বলছেন, এগিয়ে চলা নারী এসব উদ্যোক্তাদের পিছুটান দিচ্ছে ব্যাংক ঋণ। ঋণ পেতে এখনও পদে পদে হয়রানি ও ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন প্রশিক্ষিত নারী উদ্যোক্তারা। তাদের কেউ কেউ ঋণ পেলেও তা চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত নয়। নারী উদ্যোক্তাদের মধ্যে ঋণ নিয়ে ফেরত দেওয়ার হার পুরুষ উদ্যোক্তাদের চেয়ে ভালো হলেও ব্যাংকগুলো নারীদের ঋণ প্রদানে আগ্রহ দেখাচ্ছে কম। এ সমস্যার দূর না করলে নারীর অগ্রগতি বাঁধাগ্রস্থ হবে।

নারী অধিকার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে রাজশাহীতে কাজ করে আসছে বেসরকারি সংস্থা অ্যাসোসিয়েশন ফর কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট (এসিডি)। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক সালিমা সারওয়ার বলেন, রাজশাহী অঞ্চলের গ্রামীণ ক্ষুদ্র এবং কুটির শিল্পে এখন নারীর অংশগ্রহণ ব্যাপক। ব্যবসা-বাণিজ্যেও জড়িয়ে পড়ছেন নারীরা। তাই নারীদের সহজ শর্তে ঋণ দিতে হবে। তাহলে নারীরা আরও এগিয়ে যাবেন।

রাজশাহী মহিলা পরিষদের সভানেত্রী কল্পনা রায় ঢাকাটাইমসকে বলেন, এখনো গ্রামাঞ্চলে কুসংস্কার এবং সামাজিক বাধা আছে। তারপরেও নারীরা ঘর থেকে বের হচ্ছেন। ফলে অর্থনীতিতে এখন নারীদের অবদান বাড়ছে। তারপরেও অনানুষ্ঠানিক খাতে নারীদের মজুরি বৈষম্য এখনও প্রকট। তাই গ্রামীণ নারী শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার রক্ষায় প্রাতিষ্ঠনিক ব্যবস্থা এবং কৃষি তথ্য পৌঁছে দেয়ার বিশেষ উদ্যোগ নেয়ার তাগিদ দিয়েছেন এ নারী অধিকার কর্মী।

(ঢাকাটাইমস/০৮মার্চ/আরআর/ইএস)