লেখাপড়া চালাতে জীবনযুদ্ধে সোনিয়া-সুমনা

প্রকাশ | ২০ মার্চ ২০১৭, ১০:৫৭

সৈয়দ মাহ্ফুজ রহমান, পিরোজপুর

পিরোজপুরের কাউখালী উপজেলার ১ নম্বর সয়না রঘুনাথপুর ইউনিয়নের সোনাকুর গ্রামের হতদরিদ্র এক পরিবারের দুটি মেয়ে সোনিয়া ও সুমনা। সমাজকর্ম বিভাগে অনার্স প্রথম বর্ষে অধ্যায়নরত সোনিয়া আর একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী বোন সুমনা আক্তার। পিতা মাটিশ্রমিক বাবুল খন্দকার। এক ছেলে ও দুই মেয়ের জনক।

পাঁচ জনের সংসার তার। বড় ছেলে হাসান খন্দকার, পেশায় বর্তমানে পোশাকশ্রমিক। কাউখালীর সন্ধ্যা নদীর ভাঙনে ভিটেমাটি হারান বাবুল খন্দকার। জীবিকা নির্বাহের তাগিদে পরবর্তীতে সন্ধ্যা নদীতে ট্রলারে যাত্রী পারাপারের (মাঝি) কাজ শুরু করেন। তিন সন্তানসহ পাঁচ জনের সংসারে সন্তানদের দু’বেলা দু-মুঠো খাবার জোগাতেই হিমশিম খেতে হয় তাকে। সংসারের বড় ছেলে বিয়ে করে পরিবার নিয়ে ঢাকায় বসবাস করছে। এমন প্রতিকূলতার মাঝেও অনার্স ও একাদশ শ্রেণি পড়ুয়া মেধাবী শিক্ষার্থী দুই বোন দারিদ্র্যের কাছে হার মানেননি। নিজেদের শ্রম ও মেধায় এগিয়ে যাচ্ছেন তারা।

চরম দরিদ্রতা, শ্রমজীবী পরিবারের সঙ্গে বসবাস করে সোনিয়া ও সুমনা দুই বোন জীবন সংগ্রামে পরাস্ত হননি। শ্রম দিয়ে উপার্যনকৃত অর্থ দিয়ে শিক্ষার আলোয় আলোকিত হতে সোনিয়া ও সুমনার অদম্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। একদিকে সহায় সম্বলহীন পরিবারের সদস্য হয়েও লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া জীবন সংগ্রাম আর সুবিধাবঞ্চিত যে কোন নারী শিক্ষার্থীর জন্য এক অনন্য দৃষ্টান্ত।

পাঁচ সদস্যের দরিদ্র পরিবারে দুটি বোন বোঝা হওয়ার কথা থাকলেও তাদের বেলায় তা ঘটেনি। মাটি দিয়ে টালি (জৈষসপত্র) তৈরি করে উপার্জনের অর্থ দিয়ে আজ কলেজ গণ্ডিতে পৌঁছেছেন দুই বোন। পিরোজপুর জেলার কাউখালী মহাবিদ্যালয়ে সমাজকর্ম বিভাগের অনার্স প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী সোনিয়া আক্তার ও একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী সুমনা আক্তার। দরিদ্র শ্রমজীবী হলেও শিক্ষায় অদম্য মেধাবী মুখ। জীবনকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে দারিদ্র্যতার কাছে হার না মেনে প্রতিনিয়ত লড়াই করছেন তারা।

হতদরিদ্র পিতা মাটিশ্রমিক বাবুল খন্দকারের দিকে তাকিয়ে না থেকে নিজেদের চেষ্টায় লেখাপড়ার পাশাপাশি সংসারে বাড়তি আয়ের জন্য সেই শিশু বেলা থেকেই মাটির টালি বানানোর কাজ করছেন এই দুই বোন।

কলেজছাত্রী সোনিয়া জানান, সেই স্কুলজীবন থেকে সোনাকুরের পালপাড়া এলাকায় মাটিশ্রমিক হিসাবে কাজ করছেন। পড়ালেখার পাশাপাশি অবসরে মাটির জিনিসপত্র তৈরিতে শ্রম দেয়। মাটির সাথেই সখ্য আর এ দিয়ে উপার্জন। এক হাজার মাটির টালি তৈরির মজুরি দেড়শ টাকা। এ দিয়ে যে আয় হয়, তা দিয়েই চলে দুই বোনের পড়ালেখার খরচ। অবশিষ্ট টাকা থাকলে বাবাকে দেই। উপজেলার সদরে গিয়ে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ ও যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকেও বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছে আর সুযোগ পেলেই কাজে চলে যায় বলে জানান সোনিয়া।

একাদ্বশ শ্রেণির শিক্ষার্থী সুমনা আক্তার বলেন, ছোট বেলা থেকে শখের বশে মাটির টালি তৈরি করতাম। সেই কাজ থেকেই এখন উপার্জন করছি, তা লেখাপড়ায় ব্যয় করি। শত প্রতিকূলতা, অভাব-অনটনের মাঝেও লেখাপড়া ছাড়িনি। লেখাপড়া করে জীবন গড়ার স্বপ্ন দেখছি। জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করে এ পর্যন্ত এসেছি।

দরিদ্র হয়েও মেধা আর ইচ্ছাশক্তির এক অনন্য দৃষ্টান্ত ওরা দুই বোন। ওরা স্বপ্ন দেখছে স্বচ্ছন্দময় এক জীবনের। লেখাপড়া করে নিজেদের পায়ে দাঁড়িয়ে পরিবারের অভাব মোচন করতে চায় ওরা।

ওদের পিতা বাবুল খন্দকার বলেন, ওদের ঠিকভাবে ভরণ-পোষণই কষ্ঠকর, সেখানে পড়াশুনার খরচ চালানো অসম্ভব ছিল। ওরা নিজেরা কাজ করে আয় করে লেখাপড়া করছে, ওরা আমার মাইয়া না, ওরা আমার দুই ছেলের চেয়ে বেশি কিছু।

কাউখালী মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ মো. সাইদুর রহমান বলেন, সোনিয়া ও সুমনা মেধাবী শিক্ষার্থী। ওরা অতি দরিদ্র পরিবারের মেয়ে। শত কষ্টেও ওরা শিক্ষা থেকে ঝড়ে পড়েনি। ওরা পরিবারের বোঝা নয়, সম্ভাব্য সম্পদ।

কাউখালীর শিক্ষানুরাগী আব্দুল লতিফ খসরু ঢাকাটাইমসকে বলেন, এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে আমার সাথে কেউ যোগাযোগ করেনি। আপনি করলেন। সোনিয়া ও সুমনার বিষয়ে তিনি বলেন, আমি অবাক হয়েছে দারিদ্র্যতা তাদের ছুঁতে পারেনি। তাদের লেখাপড়া আর জ্ঞানসঞ্চারের আগ্রহ আমাকে দারুণভাবে উৎফুল্ল করেছে। পীড়া দেয় ওদের দারিদ্র্যতা। ওরা দুই বোন মাটির ঢালি (চারা রোপনের জন্য ‘নার্সারির ব্যবহৃত’) (তৈষসপত্র) তৈরি করে যে আয় হয়- তা দিয়ে লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছে।

আমি আমার সাধ্যানুযায়ী ওদের শিক্ষা উপকরণ (খাতা-কলম) দিয়ে সহযোগিতা করছি। আমি এটুকুই চেষ্টা করছি- ওরা যাতে ঝড়ে না পড়ে।

কাউখালী উপজেলা চেয়ারম্যান এসএম আহসান কবির ঢাকাটাইমসকে বলেন, পরিবারটি নিতান্তই গরিব। মেয়ে দুটি অনেক কষ্ট করে, সংগ্রাম করে লেখাপড়া করছে। ওরা অবসরে ওর বাবার সাথে কাজ করে। ওরা কখনো আমার কাছে আসেনি। আমি শুনেছি, ওরা উপবৃত্তির টাকা পায়, তবে নিশ্চিত নই। খোঁজ নিয়ে দেখব। ওরা উপবৃত্তি না পেলে পাওয়ার ব্যবস্থা করব।

(ঢাকাটাইমস/২০মার্চ/প্রতিনিধি/এলএ)