একজন সার্জেন্ট শাহানা আক্তার

প্রকাশ | ০৬ এপ্রিল ২০১৭, ০৮:১৬

শেখ সাইফ

কাকরাইল মোড়। একজন ট্রাফিক পুলিশ একটি মাইক্রোবাস থামালেন। তারপর কাগজপত্র দেখাতে বললেন চালককে। পাশেই কেতাদুরস্ত ইউনিফর্ম পরে দাঁড়িয়ে আছেন একজন নারী পুলিশ কর্মকর্তা। তার হাতে কাগজপত্র পৌঁছে দেয়ার পর তিনি সেগুলো খতিয়ে দেখে  ছেড়ে দিলেন গাড়িটি।

ওই মোড়ে রাস্তা পার হওয়ার জন্য আমি দাঁড়িয়ে থেকে দৃশ্যটি দেখছিলাম। ঢাকার রাস্তায় নারী সার্জেন্ট নামানোর খবর বেশ কিছুদিন আগে পত্রিকায় জেনেছিলাম। কিন্তু কড়া রোদের মধ্যে ব্যস্ত রাস্তায় কর্মরত কোনো নারী সার্জেন্ট আমার চোখে পড়েনি এত দিন। আজই প্রথম দেখলাম এমন একজনকে। তাই একটু কথা বলার আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে গিয়ে নিজের পরিচয় দিলাম আমি। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক সার্জেন্ট শাহানা আক্তার আমাকে নিয়ে বসলেন পুলিশ বক্সে।

শুরুতেই জানতে চাই পুলিশের মতো কঠোর পরিশ্রমের চাকরি কেন বেছে নিলেন তিনি। উত্তরটা শুনে একটু চমকেই উঠতে হয়। ছোটবেলা থেকেই নাকি পুলিশের ইউনিফর্মের প্রতি তার প্রবল ভালোবাসা। পুলিশ-আর্মির ইউনিফর্ম, অস্ত্র ইত্যাদির প্রতি আকর্ষণ তো সাধারণত থাকে ছেলেশিশুদের ক্ষেত্রে।

শাহানা আক্তার বলেন, 'ইউনিফর্মের প্রতি ভালোবাসা থেকেই এখানে এসেছি। বলতে পারেন ছোটবেলা থেকেই পোশাকটির প্রতি দুর্বলতা ছিল আমার। একদিন পত্রিকায় পুলিশে চাকরির বিজ্ঞাপন দেখে চোখে জ্বলজ্বল করে ওঠে স্বপ্নটা। আবেদন করি। তারপর তো জবটা হয়ে গেল।’

অথচ তিনি রাজশাহী কলেজে থেকে স্নাতকোত্তর করেছেন হিসাববিজ্ঞানে। নানা অঙ্কের জটিল হিসাব-নিকাশ রপ্ত করেছেন পাঁচ বছর ধরে। এর সঙ্গে যে চাকরির ধরনটা যায় না। সার্জেন্ট শাহানা বলেন, ‘স্বাভাবিকভাবেই ব্যাংকিং সেক্টরে জব করার কথা। কিন্তু ওই যে, ছোটবেলা থেকেই পুলিশের ইউনিফর্মের প্রতি ভালো লাগা। তাই অন্য কোনো চাকরির কথা ভাবিনি। বলতে পারেন ভাবার অবকাশও পাইনি। কারণ কোনো চাকরির জন্য আমার আবেদন ছিল এটিই প্রথম। আর প্রথম আবেদনেই চাকরিটি হয়ে গেল। যেন স্বপ্ন পূরণ।

এই স্বপ্ন পূরণে কোনো ধরনের বাধা ছিল না? কিংবা পারিবারিক সাপোর্ট কেমন পেয়েছিলেন? জানতে চাই সার্জেন্ট শাহানার কাছে।

আব্বা আমাকে সব সময় সাপোর্ট দিয়ে গেছেন। মা যে বাধা দিয়েছেন তা না। তবে মায়ের একটু সংশয় ছিল, মেয়ে হয়ে পুলিশের চাকরি করতে গিয়ে ঝামেলা হবে কি না। সবকিছু সামলাতে পারব কি না। এসব নিয়ে চিন্তা করতেন। এ ধরনের দুশ্চিন্তা সব মা-ই তাদের মেয়ের জন্য করে থাকেন। মা চাইতেন আমি ব্যাংকিং বা শিক্ষকতার মতো কোনো পেশা বেছে নিই।

মায়ের দুশ্চিন্তা এখন নিশ্চয় দূর হয়েছে। তো সংসার ও কর্মজীবন- কীভাবে সমন্বয় করেন?

আমাদের সাংসারিক জীবন আট মাস হতে চলেছে। আমার স্বামী উপপরিদর্শক (সাব-ইন্সপেক্টর), ধানমন্ডি থানায় কর্মরত। না, প্রেম করে নয়, আমাদের বিয়েটা হয়েছে  পারিবারিকভাবে। তবে কিছুটা পূর্বপরিচয় ছিল। দুজন একই পেশায় আছি বলে আমরা পরস্পরের কাজ সম্পর্কে জানি-বুঝি। এটি আমাদের সাংসারিক জীবনের জন্য আরো সহায়ক হয়েছে। আমার ডিউটি যেমন এখন। বেলা আড়াইটা থেকে রাত সাড়ে দশটা পর্যন্ত। কিন্তু আমার স্বামীর ডিউটি ২৪ ঘন্টাই। সব সময় অন ডিউটিতে থাকতে হয় তাকে।

আমি কিন্তু সংসারের সব কাজ নিজেই করি। রান্নাবান্না থেকে শুরু করে ঘরের সব কাজ। সময় পেলে আমার স্বামীও সহায়তা করে। আর কথায় আছে না- 'যে রাঁধে সে চুল ও বাঁধে।' সো সবকিছু স্বাভাবিকভাবেই করি।

আমরা দুজনই পরস্পরের প্রতি হেল্পফুল। আমার বেতন আমি খরচ করি। আমার স্বামী এখন পর্যন্ত আমার কাছে কোনোদিন বেতনের ব্যাপারে কথা বলেনি। তবে ঢাকা শহরে একজনের উপার্জনে সংসার চালানো কঠিন। আমার বেতন তো আমি খরচ করি, উপরন্তু স্বামীর কাছ থেকেও খরচ করি। আবার প্রয়োজনের সময় আমার বেতন নেবে স্বামী। এ অলিখিত নিয়মে চলছে আমাদের সংসার।

পুলিশে এখন পর‌্যন্ত অভিজ্ঞতাটা কেমন?

আগেই বলেছি ইউনিফর্মের প্রতি দুর্বলতা কাজ করত আমার মাঝে। ছোটবেলায় দেখতাম পুলিশ সরাসরি জনগণের সেবা করে। একদম জনগণের কাছে যাওয়ার সুযোগ আছে এখানে। এ জন্যই মূলত পুলিশে আসা। তবে খুব বেশি ভালো লাগে যখন কেউ ধন্যবাদ দেয়। আপনি দেখবেন, অনেক সময় প্রচুর ট্র্যাফিক জ্যাম হয়। চারদিক ব্লক হয়ে যায়। যাত্রীরা চিল্লাচিল্লি করে। গালিগালাজ করে। আমরাও কিন্তু কখনো না কখনো সাধারণ যাত্রী হই। ট্রাফিক জ্যামের কবলে পড়লে কেমন হয় সেটা বুঝি। কিন্তু কিছু করার থাকে না। এ সময় একটু খারাপ লাগে।

আমাদের কাজের ক্ষেত্রটা কিন্তু দায়িত্ববোধের জায়গা। এটা শতভাগ পালন করতেই হয়। এর মাঝেও কিন্তু আমরা আর দশজনের মতো মানুষ। আমাদেরও পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন আছে। বন্ধুবান্ধব আছে। এখন তাদের সময় দেওয়া হয় মুঠোফোনের মাধ্যমে।

দিনভর ব্যস্ত রাজপথে দায়িত্ব পালন করতে হয়। মজার কিংবা স্মরণীয় নানা ঘটনা নিশ্চয় এত দিনে জমা হয়েছে স্মৃতিতে।

একসময় আমি শাড়ি-চুড়ি পরে সেজেগুজে পহেলা বৈশাখ, পহেলা ফাল্গুন, ভ্যালেন্টাইন ডে প্রভৃতি উদযাপন করতাম। আর এখন এই সময়গুলো অন্যদের রাস্তা পার হতে সহায়তা করি। এভাবেই উদযাপন হয় দিবসগুলো। মজার না!

একটি স্মরণীয় ঘটনা বলি আপনাকে। আমার তখন ডিউটি রমনা থানার মোড়ে। প্রতিদিনের মতো ডিউটি করছি। একদিন এক বয়স্ক দম্পতি এল কাছে। তারা প্রতিদিন সকালে মর্নিং ওয়ার্কে বের হতেন। আমাকে অনেক দিন ধরে ওনারা ফলো করেছেন। তো সেদিন কাছে এসে আমার পরিচয় জানতে চেয়ে বললেন, 'আমাদের এক মেয়ে আছে। আমরা চাই আমাদের মেয়ে তোমার মতো হোক। তোমাকে দোয়া করি। দীর্ঘজীবী হও।' এই কথাটা আমার খুব মনে পড়ে।

আমাদের এ পেশায় নারীর সংখ্যা কিন্তু খুবই কম। পুরুষদের সঙ্গে কাজ করতে হয়। এ ক্ষেত্রে কলিগদের কাছ থেকে অনেক সহায়তা পাই। আরো বড় কথা, আমার সিনিয়র স্যারের আচরণ এক কথায় বন্ধুর মতো। খুব স্নেহ করেন। মানসিক সহায়তা করেন।

নারীরা এখন নানা ক্ষেত্রে সফল হচ্ছে। তবে দেশে এখনো চাকরিক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ আশাব্যঞ্জক নয়। একজন নারী হিসেবে আপনি নারীদের নিয়ে কী ভাবছেন?

আমি মনে করি, আগে আমাকে জানতে হবে আমি কী করতে চাই বা আমি কী হতে চাই। তারপর সেদিকে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। তাহলে সবাই সফল হবে। তবে যে যে-ই কাজই করুক না কেন, সততার সঙ্গে করতে হবে। তাহলে জীবনে সফল হওয়া যাবে।

আমাদের দেশে নারীরা বর্তমানে অনেক এগিয়ে গেছে। তারপরও বলব, এখনো তারা অনেকাংশে  নির্ভরশীল। এ ক্ষেত্রে নারীরা যদি শিক্ষিত হয়, তাহলে তাদের কারোর করুণার পাত্রী হয়ে বেঁচে থাকতে হবে না। নারীকে আরো বেশি কর্মক্ষেত্রে আসতে হবে। আর তার জন্য শিক্ষা হতে পারে বড় হাতিয়ার। শিক্ষা দিয়েই নিজেকে তৈরি করতে হবে।

তবে বাবা-মা, ভাই-বোন সবার সহনশীল ভূমিকাও প্রয়োজন। মেয়েদের ইচ্ছার মূল্যায়ন করতে হবে তাদের। সাহস দিতে হবে। মোট কথা, ‘তুমি পারবে। তোমার দ্বারা সব সম্ভব’ এই প্রত্যয় জাগাতে হবে ভেতরে।

(ঢাকাটাইমস/৬মার্চ/এসএস/মোআ)