‘লাশ নয় জীবিত মানুষে ভয় পাই!’

প্রকাশ | ১৩ এপ্রিল ২০১৭, ০৮:২৮ | আপডেট: ১৩ এপ্রিল ২০১৭, ১২:৩৭

শাহান সাহাবুদ্দিন
ঢাকাটাইমস

লাশকাটা ঘরের সর্দার ‘ডোম’। এ দেশের সরকারি হাসপাতালের মর্গ এদের কর্মস্থল। মর্গের আশপাশে ডোম দেখলে অনেকেই আঁতকে ওঠে। কেউ আবার নিরাপদ দূরত্বে থেকে ডোমদের দিকে কৌতূহলের দৃষ্টিতে তাকায়।  অথচ গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গের ডোম মোহাম্মদ আলীর নাকি লাশ নয় মানুষ দেখলে ভয় হয়।
তার সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ কথা হয় এই প্রতিবেদকের। আলাপচারিতা থেকে জানা গেল, সামাজিক বিভিন্ন কুসংস্কার এবং বাঁকা দৃষ্টির কারণে দেশে ডোম (মর্গ অ্যাটেনডেন্ট) পরিবারের সদস্যরা সব সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান থেকে বঞ্চিত। অবজ্ঞা, অবহেলা ও ঘৃণার পরও ডোমরা কর্মচঞ্চল জীবনের মাঝেই আপন জগৎ গড়ে তুলেছে।

লাশকাটা ঘরের ডোম ছাড়া হাসপাতালের মর্গ অচল। এ কারণে সরকারি চিকিৎসক ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ডোম পেশায় নিয়োজিতদের অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখেন। সকালে অফিসে হাজিরা খাতায় সই করে লাশকাটার কাজ শুরু। আবার বাড়ি ফেরার আগেও লাশকাটাই তার কাজ। কাজের মাঝে ডোমদের ছুটি যেন হারিয়ে গেছে।

ডোম মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে আলাপচারিতাটি পরে বয়ান করছি। তার আগে জেনে নিই তাদের নিয়ে প্রশাসন ও চিকিৎসা ক্ষেত্রের কর্তা ব্যক্তিরা কী বলেন।

গাজীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুুপার মো. গোলাম সবুর ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘ডোম পেশাকে আমি একটি মহৎ পেশা হিসেবে দেখি। ক্রিমিন্যাল মামলার রহস্য উদঘাটনে ডোমের ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ময়নাতদন্তের ক্ষেত্রে একজন ডোম যে ভূমিকা রাখে তাতে করে ডোমদের প্রতি আমাদের সমীহ ও শ্রদ্ধা দেখানো উচিত।

সামাজিক হীন দৃষ্টি আর সুযোগ-সুবিধার অভাবে ডোম পেশায় কেউ আসতে চায় না বলে জানান গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক প্রণয় ভূষণ দাস। তিনি বচলেন, ‘সরকারি পর্যায়ে ডোমদের আরো উন্নত প্রশিক্ষণের প্রয়োজন। তারা যাতে এই পেশায় উৎসাহ ও আগ্রহ নিয়ে থাকতে পারে তার জন্য ডোমদের বেতন-ভাতাসহ বাড়তি সুযোগ-সুবিধা দেওয়া উচিত। ডোমের সন্তানদের ভালো স্কুল-কলেজে লেখাপড়ার সুযোগের পাশাপাশি চাকরির ক্ষেত্রে কোটা ব্যবস্থা থাকা দরকার।’

প্রণয় ভূষণ আরো বলেন, ‘একজন ডোমের কোনো ছুটি নেই। তাদের সারা বছর দায়িত্ব পালন করতে হয়। এ ছাড়া ডোমদের সহযোগিতা করার জন্য সরকারিভাবে কোনো কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয় না। অথচ একটি মরদেহ শুধু ডোমের পক্ষে পুলিশের গাড়ি থেকে নামানো, কাটাছেঁড়া করা এবং মর্গে মরদেহ পাহারা দেওয়া সম্ভব নয়।’ ডোমের ব্যাপারে যে ভ্রান্ত ধারণা ও কুসংস্কার আছে তা থেকে মানুষের বের হয়ে আসা উচিত বলে মনে করেন তিনি। একই সঙ্গে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ডোমদের তৃতীয় শ্রেণিতে উন্নিত করা হলে সামাজিক ও আর্থিকভাবে তাদের অবস্থান দৃঢ় হবে।  

শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উত্তরদিকে হাসপাতাল মর্গে একটি অর্ধগলিত লাশের পাশে বসে পাহারা দিতে দেখা গেল ডোম মোহাম্মদ আলী ও তার কয়েকজন শিষ্যকে। মর্গে অর্ধগলিত একটি মৃতদেহ থেকে ভেসে আসছে উৎকট গন্ধ। মোহাম্মদ আলীর নবাগত এক শিষ্য কিছুক্ষণ পর পর এয়ার ফ্রেশনার ছড়িয়ে দুর্গন্ধ থেকে পরিত্রাণের চেষ্টা করেন।
ঢাকাটাইমসের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা হলো ডোম মোহম্মদ আলীর। সংলাপে উঠে এল তার নিত্যদিনের জীবনচিত্র।

প্রতিবেদক : এই পেশায় কীভাবে এলেন?

মোহাম্মদ আলী: আমার পিতা মো. শফিকুল ইসলাম এই হাসপাতাল মর্গে দীর্ঘদিন ডোম হিসেবে কাজ করেছেন। বাবার সূত্র ধরেই এই পেশায় এসেছি। বাবা অবসর নেওয়ার পর ১৩ বছর ধরে এখানে কাজ করছি আমি।

প্রতিবেদক : আপনার বাবা সম্পর্কে কিছু বলুন।

মোহাম্মদ আলী: আমার বাবা অত্যন্ত সাহসী মানুষ। বাবার কাছেই আমার লাশ কাটার খাতেখড়ি। বাবা অবসর নেওয়ার পর এই হাসপাতালে কোনো ডোম ছিল না। তাই বাধ্য হয়েই বাবাকে অবসর নেওয়ার পরও ডোমের কাজ করতে হতো। একদিন অনিচ্ছা সত্ত্বে¡ও একটি মরদেহ আনতে বাবাকে গাজীপুরের ধীরাশ্রম এলাকায় যেতে হয়। ফেরার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় বাবা একটি পা হারান। কিন্তু ওই দুর্ঘটনার পর সরকারের পক্ষ থেকে বাবাকে কোনোরকম আর্থিক সহযোগিতা করা হয়নি। পঙ্গু বাবাকে নিয়ে অর্ধাহার-অনাহারে দিন কাটার পর অবশেষে এই হাসপাতালে আমাকে ডোম হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।

প্রতিবেদক: সমাজের মানুষের অন্যদের সঙ্গে আপনার ও পরিবারের সদস্যদের সম্পর্ক কেমন?

মোহাম্মদ আলী: আমার সমাজ বলতে আমার পরিবার। মরদেহ কাটাছেঁড়ার পর বাড়িতে ফিরে যাই। আবার কর্মস্থলে ফিরে আসি। সমাজের অনেকেই আমাকে ঘৃণা করে। বাঁকা দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। অথচ আমিও মানুষ। আমি একজন মুসলমান পরিবারের সন্তান। যখন চাকরিতে যোগদান করি তখন মানুষের নিন্দা সহ্য হতো না। কিন্তু পঙ্গু বাবা ও পরিবারের সদস্যদের কথা ভেবে এই পেশাতেই থেকে যাই। এখন পরের নিন্দা আর গায়ে লাগে না। তবে খুব দুশ্চিন্তা হয় আমার স্কুলপড়–য়া সন্তানদের নিয়ে। স্কুলে প্রায় সময় অনেক ছাত্র ওদের ‘ডোমের ছেলে’ বলে কটাক্ষ করে। বাড়িতে ফেরার পর আমার সন্তানরা কান্নাকাটি করে। সমাজের অনেক পরিবারের কর্তা তাদের সন্তানদের সঙ্গে আমার সন্তানদের মিশতে দেয় না। তবে আমার স্ত্রী আমার এই পেশা নিয়ে গর্বিত। কারণ আমি যা পারি সমাজের অনেকেই তা পারে না। আমার সন্তানরা জীবনে যাই হোক অন্তত ডোম হিসেবে আমি দেখতে চাই না। আমার পরিবারের সবাই আমাকে খুব ভালোবাসে।

প্রতিবেদক: সরকারি সুযোগ-সুবিধা কেমন পাচ্ছেন?

মোহাম্মদ আলী: সরকারি কর্মচারীদের কোয়ার্টারে থাকি। বেতন থেকে মাসিক ঘর ভাড়া কেটে নেওয়া হয়। সংসারের খরচ, সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ জোগাতে নুন আনতে পান্তা ফুরায়। সন্তানরা যত বড় হচ্ছে দুশ্চিন্তা তত বাড়ছে। সরকার আমাদের কথা বিবেচনা করে অন্তত ঘরভাড়া যদি মওকুফ করে দিত তাহলে সংসারের অভাব-অনটন কিছুটা হলেও দূর হতো।

প্রতিবেদক: মরদেহ কাটাছেঁড়া করতে ভয় লাগে?

মোহাম্মদ আলী: চাকরির প্রথম দিকে খুব ভয় লাগত। একসময় রাতে ঘুমাতে পারতাম না। মরদেহগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠত। ঘুমের মধ্যে মনে হতো মরদেহগুলো আমাকে ডাকছে। এখন লাশ দেখে আর ভয় হয় না। মৃত মানুষ কারোও ক্ষতি করে না। তবে জীবিত মানুষ দেখে ভয় পাই। অনেকেই মর্গে এসে মরদেহের ছবি তোলে। কেউ আবার আমারও ছবি তোলে। তখন খুব কষ্ট পাই। মনে হয় পৃথিবীতে সবাই মানুষ, আমিই একমাত্র অমানুষ। তবে কারো সাথে রাগ করি না। মানুষ আমাদের যত ঘৃণা করে, ডোমরা তার চাইতে বেশি বিনয়ী।

প্রতিবেদক: মরদেহ কাটতে গিয়ে কখনো কি আপনার কষ্ট হয়েছে, বেদনাবোধ করেছেন?

মোহাম্মদ আলী: শিশুদের মরদেহ কাটাছেঁড়া করতে খুব কষ্ট হয়। নিষ্পাপ শিশুদের মুখের দিকে তাকালে নিজের সন্তানদের কথা মনে হয়। চিকিৎসকের সামনে লাশ কাটি। তাই চাইলেও কাঁদতে পারি না। তবে মনকে যতই পাথর বানাই না কেন, আমিও তো মানুষ। ভেতরে ভেতরে খুব কাঁদি। এই কান্না কেউ দেখে না। টের পাই শুধু আমি।

প্রতিবেদক : এ পর্যন্ত কতগুলো মরদেহ কাটাছেঁড়া করেছেন?

মোহাম্মদ আলী: কয়েক হাজার মরদেহ কাটাছেঁড়া করেছি। প্রায় প্রতিদিন মর্গে মরদেহ আসছে। তবে ট্রেনে কাটাপড়া মরদেহ যদি ঢামেক হাসপাতাল মর্গে পাঠানো না হতো তাহলে এত দিনে মনে হয় পাগল হয়ে যেতাম। অনেক মরদেহ অর্ধগলিত থাকে। নিহতের স্বজনরাও নাকে-মুখে কাপড় দেয়। কিন্তু আমি মুখ ঢাকতে পারি না। যতœ করে মরদেহ পুলিশের গাড়ি থেকে নামাই। মর্গে লাশ রেখে চিকিৎসকের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি।

প্রতিবেদক: সরকারের কাছে আপনার কিছু চাওয়ার আছে?

মোহাম্মদ আলী: আমাদের ঘরভাড়া মওকুফ করলে সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ জোগাতে সুবিধা হতো। সেই সঙ্গে ভাতা, বোনাস ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পেলে ঘুচে যেত অভাব-অনটন। এ ছাড়া ডোম নামটা শুনলে মানুষ ঘৃণা করে। এই নামটা পরিবর্তন করলে সমাজের মানুষের কাছে কিছুটা হলেও মূল্যায়ন পেতাম। সবাই ডোম হতে পারে না। ডোম হতে গেলে সাহস লাগে। সৎ ও দায়িত্বশীল হতে হয়। বেতনসহ সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি না করা হলে ভবিষ্যতে এই পেশায় চাকরি করার মতো মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না।

(ঢাকাটাইমস/১৩এপ্রিল/মোআ)