কবিতায় নন্দিত বৈশাখ

প্রকাশ | ১৩ এপ্রিল ২০১৭, ১৭:৩৬ | আপডেট: ১৩ এপ্রিল ২০১৭, ১৭:৩৯

হাবিবুল্লাহ ফাহাদ

বাইশে চৈত্র, ১৪২৩। লিখতে বসেছি এমন একটি পরিবেশেÑ যখন বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। দুপুরেই নেমেছে সন্ধ্যা। বৃষ্টি হচ্ছে। থেমে থেমে মেঘের গর্জন। বৈশাখ আসতে এখনো বেশ বাকি। কিন্তু হঠাৎ ঝড়ো হাওয়া আর ছন্দময় জল পতন জানিয়ে দিচ্ছে বৈশাখ আসছে। একবার মনে হলো লেখা রেখে বাইরের খোলা জানালার পাশে দাঁড়াই। মেঘের গা থেকে ঝরে পড়া রুপার কণার দিকে তাকিয়ে থাকি। বৃষ্টির আহ্লাদি ছিটেফোঁটায় শিহরিত হই। কিন্তু লিখতেও যে হবে। সময় নেই হাতে। কদিন বাদে বৈশাখ। লেখাটা এ নিয়েই।

বৈশাখের নান্দনিকতা কতটুকু ছুঁতে পারে সাধারণের মন? হঠাৎ ঝড়ো হাওয়া কতটা কাঁপাতে পারে ভেতর জগৎ? তবে যারা শব্দ দিয়ে শিকার করেন তারা খুব কাছ থেকে হরণ করেছেন বৈশাখের রূপ। কখনো ঘোর, তরঙ্গরাশি, নতুন প্রভাত। কখনো ধবধবে বালুচরে ফসলের থান। আবার নটরাজের নাচনÑদোলায় কালবৈশাখীর আহ্বান। এই কোমল বৈশাখ হঠাৎ উত্তাল। দুর্ধর্ষ এক ডাকাতের বেশে হানা ফসলের মাঠে, বাড়ির উঠোনে, দেউরির ছাউনিতে। বাংলা কবিতায় বৈশাখ এসেছে নানারঙে, নানারূপে। কবির চোখ কখনো উর্বশীর দেখা পেয়েছে বৈশাখে। দেখেছে সবুজ মখমল প্রান্তরে বাতাসের খেলা। প্রকৃতির সুসময়-দুঃসময়। বর্ষবরণের আয়োজন। প্রিয়তমার অভিবাদন। মন উজাড় করে দিয়েও যেন কিছুই হয়নি দেয়া। গোয়ালে বাসর। লাঙ্গলের ফলায় সোনা-রুপার কাঁপা জলের চুমো। কেউ বলেন, বৈশাখের ধাক্কায় বুড়ো হয়ে যাচ্ছে পৃথিবী। কেউ আবার নতুন জীবনের খোঁজ পান ভোরের আলোয়। কবির কবিতায় বৈশাখ উন্মাদনার নান্দনিকতা যেভাবে ধরা আছে তা লিখে বোঝাবার নয়। বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করা এসব কবিতাই একমাত্র আশ্রয়। সেখান থেকেই না হয় খুঁজে নিচ্ছি আরাধ্যের বৈশাখ।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লিখে যাওয়া গানে সুর না তুলতে যেন মনে হয় না বৈশাখ এসেছে। কী গভীরের বাণী তিনি রেখে গেছেনÑ
‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো।
তাপস নিশ্বাস বায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক
যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে যাওয়া গীতি,
অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাব।
মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা,
অগ্নি¯œানে শুচি হোক ধরা
রসের আবেশ রাশি শুষ্ক করি দাও আসি,
আনো আনো আনো তব প্রলয়ের শাঁখ
মায়ার কুজ্ঝটিজাল যাক দূরে যাক।’

কবি নজরুল বিদ্রোহ খুঁজে পেয়েছেন বৈশাখেও। প্রলয়-নেশায় নৃত্য পাগল বৈশাখকে স্বাগত জানাতে জয়ধ্বনি করতে বলেছেন তিনি। বৈশাখের ঝড় আঘাতকে বড় করে দেখেছেন। মেঘের বজ্রে বিজলিকে মশালের সঙ্গে তুলনা করেছেন। দেখেছেন ভয়ংকর হাসি।
‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর!
তোরা সব জয়ধ্বনি কর!
ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কালবোখেশির ঝড়
তোরা সব জয়ধ্বনি কর!!
আসল এবার অনাগত প্রলয়-নেশায় নৃত্য-পাগল,
সিন্ধু-পারের সিংহ-দ্বারে ধমক হেনে ভাঙল আগল!
মৃত্যু-গহন অন্ধকূপে, মহাকালের চন্ড-রূপে ধূ¤্র-ধূপে
বজ্র-শিখার মশাল জ্বেলে আসছে ভয়ংকর!
ওরে ওই হাসছে ভয়ংকর!’

অতীতের সব সুখ-দুঃখ ভুলে নতুন করে শুরু করার বার্তা নিয়ে আসে নববর্ষ। বাঁচতে শেখায় নতুন করে। কর্মময় পৃথিবীতে কেউ কর্মহীন নয়। কবি কায়কোবাদ তাঁর ‘নববর্ষ’ কবিতায় এ সুরেই কথা বলেছেন। বলেছেন, কালের রথে ছুঁটে চলাদের গল্প।
‘ও হে পান্থ!Ñ
অতীতে সুখ- দুঃখ ভুলে যাও তুমি
অই যে ব্রহ্মা- জুড়ে
সম্মুখে রয়েছে পড়ে
তোমার সে কর্মক্ষেত্র-মহারঙ্গাভূমি।
অই ক্ষুদ্র জলবিন্দু
অথবা অসীম সিন্ধু
কর্মহীন নহে কেহ, কর্মময় সব!
উন্নত উন্নতি-পথে
ছুটেছে কালের রথে,
বিবর্তন-চক্র সাদা ঘুরিয়ে নীরব!’

আর পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের বর্ণনায় উঠে এসেছে গ্রাম-বাংলায় বৈশাখের বৈচিত্র্য। চৈত্রের প্রকৃতিকে তুলনা করেছেন সাদা শাড়ি পরা বিধবার সঙ্গে। নদীর পারে হাওয়ায় দোলা ধানের শীষকে তুলনা করেছেন শাড়ির সোনালি পাড়ের সঙ্গে। এতটা কাছ থেকে খুব কম চোখই প্রকৃতির রূপ দেখতে পায়।

‘বোশেখ শেষে বালুচরের বোরো ধানের থান,
সোনায় সোনা মেলিয়ে দিয়ে নিয়েছে কেড়ে প্রাণ।
বসন্ত সে বিদায় বেলায় বুকের আঁচলখানি,
 গেঁয়ো নদীর দুপাশ দিয়ে রেখায় গেছে টানি।
 চৈত্রদিনের বিধবা চরের সাদা থানের পরে,
নতুন বরষ ছড়িয়ে দিল সবুজ থরে থরে
না জানি কোন গেঁয়ো তাঁতি গাঙ চলিবার চলে,
জয়-ছোঁয়া তার শাড়ির কোণে পাড় বুনে যায় চলে।
মধ্য চরে আউশ ধানের সবুজ পারাবার,
নদীর ধারে বোরো ধানের দোলে দোলে সোনার পাড়।’


কালবৈশাখীর উন্মাদনাকে নটরাজের নাচনের সঙ্গে তুলনা করেছেন কবি বে-নজীর আহ্মদ। আকাশ আর পৃথিবীর বাঁধন ছেঁড়া প্রলয় দেখেছেন বৈশাখের ক্ষিপ্রতায়।
‘আকাশÑধরার বাঁধন ছিঁড়ি প্রলয় নাদে যাওরে ডাকি
নটরাজের নাচন-দোলায় আয় নেচে আয় কালবৈশাখী।’
(বৈশাখী)

কবির ভাষায় বৈশাখ দুর্বলদের জন্য উদ্দীপনা। তাদের জেগে ওঠার পাথেয়।
‘মূর্খ যারা সুপ্তি ঘুমে শান্তি-ঘন জীবন জানে
 তোমার বাণী বজ্রসম গর্জি উঠুক তাদের কানে।
আধমরারা উঠুক জাগি।’

বৈশাখের কৃষকের ব্যস্ততাও উঠে এসেছে বন্দে আলী মিয়ার কবিতায়। ধু-ধু প্রান্তরের ছবি কবি এঁকেছেন শব্দের তুলিতে। গাঁয়ের মানুষ কেউ কারো পর নয়, সবাই যেন একই পরিবারের আপনজনÑকবি সে কথাও বলেছেন ‘বোশেখের মাঠ’ কবিতায়।
‘বোশেখ শেষের মাঠে ঘিরে আছে তিন চারখানা গাঁও
এ-পারে ও-পারে ছড়াছড়ি ঢেরÑদেখাশুনা হয় তা-ও।
ও গাঁয়ের মেয়ে এই গাঁ এসেছে পরের ছেলের ঘরে
এ-পাড়ার মেয়ে গেছে ওই পাড়া চিরদিনেকের তরে।
 কেহ পানি নিতে, নাহিতে বা কেহ মেয়েরা আইসে ঘাটে
পুরুষেরা যায় হাল চষিবারে নারাণপুরের মাঠে;
 সেই খানে এরা সুখের দুখের ঘরের কাহিনী কয়
সকলের সাথে সকলেরি ভাব কেহ যেন পর নয়।’

বৈশাখের আগমন মানে চৈত্রের বিদায়। নতুন ভোরের আলো। নতুন বছর। নতুন আশা। অতীত ভুলে সুন্দর আগামীর প্রত্যাশা। কবি সুফিয়া কামাল তাই তো বলেছেনÑ
‘আবার প্রতীক্ষা করি নতুন দিনের এই প্রথম প্রহরে
কী সে এনেছে মুঠি ভরে?
সে কি ঘুচাইবে দৈন্য? মুছাবে কি নয়নের জল?
ক্ষুধার্ত মানব তরে আনিবে কি সোনার ফসল?
অশ্রুহীন হাহাকার নিরুদ্ধ প্রাণের ব্যথা নাশি
বিষাদ বিষাক্ত মুখে ফুটাবে কি হাসি?’
(নববর্ষে)

আবার কবি মূর্খতার অন্ধকার কাটিয়ে উঠতে বলেছেন। বলেছেন নতুন দিনে দ্বীপ্ত আলো জ্বালার শপথ নেয়ার কথাও।
‘লুপ্ত করো অজ্ঞানের তমি¯্রা অসুর,
আনো দীপ্ত আলো,
প্রাণের প্রদীপ্ত শিখা জ্বালো।
তোমরা লইয়ো নব জীবন গড়ার এ শপথ :
কোনো বাধা মানিব না, সৃজন করিয়া লব পথ।’
(নববর্ষে)

বৈশাখকে প্রেমিকার আসন দিয়েছেন কেউ কেউ। প্রিয়তমাকে খুঁজে নিয়েছেন বৈশাখের লাবণ্যের মাঝে। নতুন বছরকে বরণ করে নেয়ার অনেক সাধ কবি আহসান হাবীবের মনে। কিন্তু সাধ্য নেই। কী দিয়ে বরণ করবে বৈশাখকে?
‘মৃগনাভি-ছলনায় নিজেকেই নিজে মুগ্ধ করে রেখেছো।
ঊষার লালিত্যে
আর মধ্যদিনের আগুনে তুমি অকৃত্রিমÑ
 তোমাকে আমি কী দিতে পারি
কী দেব বলো হে বৈশাখ!’
(হে বৈশাখ)

 কবি ফররুখ আহমেদ বৈশাখকে দেখেছেন নানা চোখে। কখনো চৈত্রের বিশীর্ণ পাতায় গেল বছরের চিহ্ন। শস্য-শ্যামলিমাহীন ঊষর প্রান্তর। মৃত্যুর ভয়ঙ্কর রূপ। কখনো বিজয়ী বীরের সঙ্গে তুলনা করেছেন বৈশাখকে।
‘এস তুমি সাড়া দিয়ে বিজয়ী বীরের মতো, এস স্বর্ণ শ্যেন,
বাজায়ে নাকাড়া, কাড়া এস তুমি দিগি¦জয়ী জুলকার্নায়েন,
আচ্ছন্ন আকাশ নীলে ওড়ায়ে বিশাল ঝা-া শক্তিমত্ত প্রাবল্য প্রাণের,
সকল প্রকার, বাধা চূর্ণ করি মুক্ত কর পৃথিবীতে সরণি ত্রাণের,
সকল দীনতা, ক্লেদ লুপ্ত কর, জড়তার চিহ্ন মুছে যাক;
বিজয়ী বীরের মতো নির্ভীক সেনানি তুমি
এস ফিরে হে দৃপ্ত বৈশাখ।।’
(বৈশাখ)

আবার বৈশাখকে ডেকেছেন ধ্বংসের নকিব বলেও। ফিরে আসতে বলেছেন সুন্দর হয়ে। বিক্ষত প্রাণে পথ চিনে আসতে বলেছেন। বৈশাখের প্রাণের তাপে জীবনের সব ক্লেদ আর গ্লানি মুছে দিতে চেয়েছেন তিনি।

‘ধ্বংসের নকিব তুমি হে বৈশাখ! এসো ফিরে এসো তুমি অপূর্ব সুন্দর,
বৎসরের সূচনায় পিঙ্গল আকাশে দেখি অগ্নিবর্ণে তোমার স্বাক্ষর,
প্রচ- ঝড়ের সাথে অচ্ছেদ্য, অভিন্ন সত্তা, ধূলিরুক্ষ এ পাক জমিনে,
জরাগ্রস্ত পৃথিবীতে, অথবা বিক্ষত প্রাণে এসো তুমি পথে চিনে
 তোমার প্রাণের তাপে ব্যাধিগ্রস্ত জীবনের ক্লেদ, গ্লানি সব জ্বলে যাক;
পুরাতন বৎসরের প্রান্তর ছাড়ায়ে এসো;
এসো চির দুর্জয় বৈশাখ।’

তবে বৈশাখকে ঝড়ের তা-বলীলার সঙ্গে তুলনা হয়েছে বেশি। বৈশাখ মানেই যেন প্রকৃতির প্রলয় নিত্য। ঝড় পাখির নীলিমা জয়। সব ছুঁড়ে-ছিঁড়ে ফেলার এক ছিন্নভিন্ন ছবি। কবি সিকান্দার আবু জাফরের শব্দের বুননেÑ
‘উদ্দাম ঝড়ের পাখি দুই ডানা মেলে
পশ্চাতের পথ-প্রান্তে সম্মুখের ফেলে
ছুটে যায় গ্রহে উপগ্রহে
ক্ষুধিত আক্রোশ নিয়ে উদ্ধত বিদ্রোহে।
এক ডানা আনে তার শ্রাবণের স্নেহ-স্নিগ্ধ-ভাষা
অন্য ডানা মেলে দেয় বজ্রের জিজ্ঞাসা।’
(বৈশাখ)

 চৈত্রের স্মৃতির কান্না বুকে চেপে আসে বৈশাখ। চোখে তখন নতুন দিনের আলো জ্বলে। পথের পাশে ঝরে থাকা পাতায় ধূসর অতীতের দেখা মেলে, বৈশাখে। কবি শামসুর রাহমান বলেছেন কত সুন্দর করেই না বলেছেনÑ
‘হৃদয়ে জড়ানো চৈতি স্মৃতির কান্না
দৃষ্টিতে জ্বলে জীবন রাঙানোর পান্না
জীবন দৃপ্ত ধু-ধু প্রান্তর বলছে আজ।’
(বৈশাখের গান)
 বৈশাখে মেঘের কান্নায় আকাশ কেঁপে ওঠে। বাতাস ঝড়ের গন্ধ ছড়ায়। শূন্য ডালে হঠাৎ ঝাঁকি লাগে।
‘শূন্য ডালে হঠাৎ হাওয়ার লাগলো ঝাঁকি
এই তো আবার এসেছে দিন বৈশাখী।।
স্বপ্ন ছাওয়া মঞ্জু শাখে
অনেক কিছু চাওয়ার থাকে
এই কথাটি যায় বলে যায় নতুন পাখি।’

নতুন বছরে মঙ্গলই সবার কামনা। অতীতের সব ঝেরে ফেলে এগিয়ে যেতে চান নতুন উদ্দীপনায়। সব ক্লান্তি দূরে ঠেলে নতুন উদ্যম ফিরে পাওয়ার সেই কী আকুতি।
‘আমার দুচোখে তোমার দাহন জ্বালো
নয়া দিগন্তে আনো বৈশাখী আলো
হতাশার কালো মুছে যাক
এসো আশা নিয়ে বৈশাখ
সৃষ্টির দিকে মিছিলের মুখ
ঘুরিয়ে দাও।।’

 বৈশাখকে তুলনা করেছেন বিভেদের লাঙ্গলের সঙ্গে। প্রকৃতির সবকিছু যেন ভাগ দেয় নিমিষেই। কবি সৈয়দ শামসুল হক বলেছেন যথার্থই।
‘এ এক বৈশাখ, সমস্ত কিছুতে লাঙ্গল চালিয়ে
অনবরত দু’ভাগ করে চলেছে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে;
উড়ছে
বস্তু আর উদ্বেগের কণা বৈশাখের চুল্লির বাতাসে।’
(আবার বৈশাখ)

আবার গ্রামীণ আবহে বৈশাখের রূপ দেখেছেন নিবিড়ভাবে। কীভাবে ঝড় সব মুহূর্তেই এলোমেলো করে দেয়Ñ সে ছবিও তুলেছেন কবি শব্দের ফ্রেমে।
‘একদিকে গ্রাম একদিকে ব্রহ্মপুত্র;
এমন একটা ভূগোল আছে প্রত্যেকের
 যেখানে জল এবং স্থলের ভেতরে কোনো বিরোধ নেই।
আর কোথাও কোনো কুমারী বসে অনবরত বেছে চলেছে
নানা রঙের ফুলের ভেতরে
লাল কিছু ফুল, যার পাপড়িগুলো দৃঢ় আঙুলে ধরে রেখেছে ঘ্রাণ।
যতদূর চোখ যায় কোথাও তো কেউ ছিল না,
শব্দহীন ধাতব সংগীত,
আর ঠিক তখন
শঙ্খের হাওয়ার মতো ওরা এসে গোল হয়ে দাঁড়াল
আমার চারদিকেÑ
ব্রহ্মপুত্র থেকে শাদা ষাঁড়, গ্রীবা উৎসুক, শিঙ থেকে জলকণা,
কণার ভেতরে রঙধনু।’

শুধু ধ্বংস নয় বৈশাখকে সৃষ্টির প্রতীক হিসেবেও দেখেছেন কবি। পুরোনো ভেঙে নতুন গড়ার প্রত্যয় তাঁর আহ্বানে।
‘এখন তো বৈশাখ, লুপ্তি ও নির্মাণের মাস;
এখন তো বাহিত হয়ে আসছে তোমার শব ঐ পোড়া জমির ওপর দিয়ে;
এখন তো সত্যি সত্যি হাম্বাধ্বনি করে উঠছে ষাঁড়, কিন্তু প্রচ- তৃষ্ণায়,
কখনো তারা শুয়ে পড়ছে অদৃশ্য অযুত বল্লমের খোঁচায়,
কখনো চক্রাকারে পাক দিচ্ছে কেউ তাদের তাড়া করছে বলে।’

কবি আল মাহমুদ তার জীবন সায়াহ্নে এসে দাঁড়িয়েছেন। আঁটো হয়ে এসেছে দৃষ্টি। এই চোখে ঋতুর আনাগোনা দেখা যায় না। বুড়ো চামড়ায় যায় শুধু অনুভব করা। তাই কবির কাছে কেউ ঋতুর আনাগোনা জানতে চায় না।
‘আমি এখন যেখানে এসে দাঁড়িয়েছি সেখান থেকে শুধু যে বাইরের
দৃশ্যই দেখা যায় না এমন নয়। ঋতুর আনাগোনাও বোঝার কোনো
উপায় নেই। কে জানে এটা ঝড়ের মাস কিনা! শুধু চোখ বন্ধ করে
মনে হয় একটি বৃদ্ধ, অথর্ব গ-ার ধূলিঝড়ের মধ্যে চোখ বন্ধ করে
প্রকৃতির সর্বপ্রকার ঘূর্ণিবায়ু, বৃষ্টি বর্ষণ ও বিদ্যুতের ঝলকানিকে
চামড়ার ওপর বয়ে যেতে দিচ্ছে। পৃথিবীর চামড়া খসে যাচ্ছে,
পুড়ে যাচ্ছে, রক্তপাত হচ্ছে। কিন্তু গ-ারের শরীরে এর কোনো
প্রতিক্রিয়া নেই। কবি যদি গ-ার হয়ে যায়, তাহলে ঋতুর
আনাগোনা তাকে কে জিজ্ঞেস করে?’
(নববর্ষ)

এই বয়সে এসে নিজেকে কবি তুলনা করেছেন বৃদ্ধ অশ্বত্থ গাছের সাথে। যার পতন দেখার জন্য পৃথিবীর কোনো পাখি সাক্ষী থাকে না। বৈশাখ এখন আর কবির কাছে প্রতীক্ষার মাস নয়। বৈশাখকে আহ্বান জানানোরও কেউ নেই।
‘এই গ-ারের চামড়ার ওপর অনুভূতিরই বা প্রয়োজন কি? হে
বৈশাখ, হে প্রমত্ত ঝঞ্ঝায়বায়ু, তোমাকে এসো এসো বলে
আহ্বান জানাবার এখানে কেউ নেই।’

 বৈশাখের আগমনের বার্তা পেয়ে আকাশে উঠে যায় চৈত্রের হাওয়া। কবি বেলাল চৌধুরী তাই বলেছেন।
‘নিঃসঙ্গ আকাশে যায় উঠে যায় চৈত্রের হাওয়াÑ
পাতারা ওড়ে ঘরময় আনাচে কানাচে কানবে
আলো ছায়ায় নকশা ভাঙে সাদা কাগজে,’
 
আকাশে বৈশাখের বিভা দেখেছেন কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ। সূর্য আর মেঘের মিলন দৃশ্য তুলে এনেছেন শৈল্পিক বর্ণনায়।
‘পুবে সূর্য
পশ্চিম আকাশে কালো
উত্তর আকাশে তামা
এমনি করে এলো পয়লা বৈশাখ আমার
...পুব থেকে সূর্য যেন এক প্রবল ঘোড়ার পিঠে চড়ে
ক্রমাগত ছুঁড়ে মারছে রুপার তীর’
(পহেলা বৈশাখ ১৩৭৯)

পয়লা বৈশাখকে ঘিরে পারিবারিক বন্ধন ফুটে ওঠে কবি মহাদেব সাহার বর্ণনায়। বাঙালির ঐতিহ্যের এই দিনটি যে উৎসবের তাও পাওয়া যায় তার লেখা ‘বৈশাখে নিজস্ব সংবাদ’-এ। মা বলেছিলেন, পয়লা বৈশাখে বাড়ি যেতে। কিন্তু ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে যায় কবির সময় হয় না। জীবনের তার পয়লা বৈশাখ আসে না।
‘মা তুমি বলেছিলে পয়লা বোশেখে
বাড়ি আসবি তুই, আমার মনে আছে,Ñআমারও
ইচ্ছে করে পয়লা বোশেখ কাটাই বাড়িতে, প্রতি বছর মনে
করে রাখি সামনের বছর পয়লা বোশেখটা বাড়িতে কাটিয়ে
আসবো, খুব সকালে উঠে দেখবো পয়লা বোশেখের সূর্যোদয়
 দেখতে কেমন, কিন্তু মা সারাটা বছর কাটে, ক্যালেন্ডার পাল্টে যায়, আমার
জীবনে আর আসে না যে পয়লা বোশেখ।’

বাঙলা নতুন বছরে ব্যবসা-বাণিজ্যে হালখাতা, খেরো-খাতার কথা এসেছে কবি নির্মলেন্দু গুণের ‘খাজাঞ্চীবাবুর নববর্ষ’-এ। চৈত্রসংক্রান্তিতে মহাজনের হিসাব-নিকাশের আদ্যোপান্ত এসেছে সরল বর্ণনায়। মহাজনের খেরো-খাতার মতো চিত্রগুপ্তের খাতাটিও কি জীর্ণ সুতলিতে বাঁধা হবে? গদিতে বসে সেই চিন্তা করে খাজাঞ্চীবাবু। সামনে তার ভ্রুকুটি হেনে তাকিয়ে আছেন মহাজন। বাবুর মনে পড়ে দুই নাবালক ছেলে যদু-মধু আর স্ত্রী অন্নপূর্ণার কথা। সংসারের অভাব-অনটন। কোনোমতে চাকরিটা হলে অন্নপূর্ণাকে নববর্ষের লাল পাড়ের ঢাকাই শাড়ি কিনে দেবে।
‘...অন্নপূর্ণাকে দেবো টকটকে লাল পাড়ের
একখানি নববর্ষের শাড়ি।
আহ বেচারি হয়তো ভুলেই গেছে এদ্দিনে
নতুন লাল পাড়ের ঢাকাই শাড়িতে
কী সুন্দরই না ওকে মানাতো একদিন।’
খাজাঞ্চীবাবু ভাবেন এভাবে অর্থহীন সততা আর নির্ভুল নিষ্ঠায় মোড়া জীবনের বোঝা বাইতে বাইতে সে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, বীতশ্রদ্ধ। তিনি বিদ্রোহী হতে চান। নিজের স্ত্রীর জন্য জেগে ওঠে তার ভালোবাসা। সন্তানের জন্য অপার মমতা। সিদ্ধান্ত নেন এবার তিনি অন্য এক খেরো-খাতা লিখবেন। জীবনের নতুন ছবি আঁকবেন। চৈত্রসংক্রান্তির রাতে নিজেকে বদলে নেয়ার প্রতিজ্ঞা জাগে খাজাঞ্চীবাবুর মনে।

‘আকাশগঙ্গায় ঘুরপাক’Ñকবিতায় কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা তুলে এনেছেন ঋতু বদলের রঙ। ইতিহাস-ঐতিহ্যের মিলন ঘটিয়েছেন এখানে। স্বর্গ-মত্ত্ব একাকার করেছেন বৈশাখী আহ্বানে।
‘আজ য়ুসুফ জেগেছে জোলেখার সঙ্গে
নাচে রাধাশ্যাম গাঙ্গেয় বঙ্গে
পুরুষকেশর রমণীকেশরী
মনযমুনায় পারাণির কড়ি
দূরে ও বেদূরে বীজের ফারাক
আজ ভালোবাসা ঝোড়ো মৌচাক
সময়জমিন যাক ছিঁড়ে যাক

আসে বৈশাখ, এলো বৈশাখ।’
হাবিবুল্লাহ ফাহাদ : সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক