মাদ্রাসায় আগ্রহ কমছে ছেলেদের

প্রকাশ | ০৩ মে ২০১৭, ০৮:১৯

মহিউদ্দিন মাহী, ঢাকাটাইমস

আব্দুর রহিম ২০১৬ সালে মাদ্রাসা থেকে দাখিল পাস করেছেন। তার স্বপ্ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে পড়াশোনা করার। তাই উচ্চমাধ্যমিকে আলিমে ভর্তি হননি। এখন পটুয়াখালীর বাউফলের একটি কলেজে পড়ছেন তিনি।

মাদ্রাসা ছেড়ে কলেজে ভর্তি হওয়ার ব্যাপারে রহিম ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘মাদ্রাসায় আরবি বেশি পড়ানো হয়। ইংরেজির ওপর গুরুত্ব কম। কিন্তু কলেজে ইংরেজির ওপর গুরুত্ব বেশি। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হলেও ইংরেজিতে দক্ষ হতে হয়। এ কারণেই কলেজে ভর্তি হওয়া।’

তার মতো আরো অনেকে মাদ্রাসা ছেড়ে কলেজের দিকে ছুটছেন বলে জানিয়েছেন রহিম।

শিক্ষা ও পরিসংখ্যার ব্যুরো-বেনবেইজের সবশেষ তথ্য বলছে, শিক্ষার্থীর সংখ্যার বিবেচনায় ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছে মাদ্রাসা শিক্ষা। গত ১৫ বছরের পরিসংখ্যান বলছে, এই শিক্ষায় ছাত্রীর সংখ্যা বাড়লেও ছাত্র সংখ্যা বাড়ার বদলে কমেছে। তবে এই সময়ে মাদ্রাসার সংখ্যা বেড়ে হয়েছে অন্তত দেড়গুণ।  

বাংলাদেশে সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে শুরু থেকেই সমান্তরালভাবেই চলছে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা। এই দুই ধরনের শিক্ষা নিয়ে এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব ও বিতর্ক চলে আসছে শুরু থেকেই। তবে গত ১৫ বছরের পরিসংখ্যান বলছে, এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে নিজেদের গুটিয়ে রাখতে চাইছে বিশেষ করে ছেলেরা।

জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (মাদ্রাসা ও কারিগরি বিভাগ) এ কে এম জাকির হোসেন ভু্ইয়া ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষার্থী কমবে এটা স্বাভাবিক। কারণ অনেকেরই স্বপ্ন থাকে উচ্চশিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নেবে। আবার কেউ কেউ বিদেশেও পড়াশোনা করতে চায়। পরিবারের ভালো ছেলেটিকে তো কেউ আর মাদ্রাসায় দেয় না। তাই মাদ্রাসায় শিক্ষার্থী কমার প্রবণতা খুবই স্বাভাবিক।’

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বিষয়টি সম্পর্কে বলেন, ‘আমাদের দেশের গ্রামাঞ্চলে মাদ্রাসায় পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি। শহরে কম। দিন দিন মানুষের মধ্যে পরিবর্তন আসছে। এর প্রভাব পড়ছে শিক্ষায়ও। পরিবর্তনের একটি দিক হচ্ছে মাদ্রাসায় শিক্ষার্থী সংখ্যা কমা।’

সংখ্যার হিসাব

ব্যানবেইজের পরিসংখ্যান বলছে, ২০০০ সালে মাদ্রাসায় এসএসসি সমমানের দাখিল, এইচএসসি সমমানের আলিম, ডিগ্রি সমমানের ফাজিল এবং মাস্টার্স সমমানের কামিল মিলিয়ে মোট ছাত্র সংখ্যা ছিল ১৮ লাখ ৮৫ হাজার ৯৯৬ জন। আর ২০১৫ সালে এই সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ১৮ লাখ ৭৯ হাজার ১৩৮ জনে। অর্থাৎ এই ১৫ বছরে শিক্ষার্থী কমেছে মোট ছয় হাজার ৮৫৮ জন।

এই ১৫ বছরে চার ধাপের মধ্যে মাদ্রাসায় ছাত্র সংখ্যা কমচেয়ে কমেছে ডিগ্রি সমমানের ফাজিলে, মোট ৯৮ হাজার ৭৪৫ জন। এরপর কমেছে এসএসসি সমমানের দাখিলে, মোট ১৯ হাজার ৮১১ জন। তবে বেড়েছে এইচএসসি সমমানের আলিমে, মোট দুই হাজার ৮৯৩ জন এবং মাস্টার্স সমমানের কামিলে, মোট ৭৮ হাজার ৭২৯ জন।

মাদ্রাসা শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই দুই ধাপে ছাত্র সংখ্যা বৃদ্ধির কারণ এসএসসি ও ডিগ্রি সমমানে পাসের হার বৃদ্ধি। দুই ধাপেই পাসের হার ১৫ বছর আগের তুলনায় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ থেকে বেড়ে ৮০ শতাংশের কাছাকাছি বা তার চেয়ে বেশি হয়েছে।

২০০০ সালে এসএসসি সমমানের দাখিলে মোট ছাত্র সংখ্যা ছিল ১০ লাখ ১৬ হাজার ৮৮৭ জন। ২০১৫ সালে এই সংখ্যা কমে দাঁড়ায় নয় লাখ ৯৭ হাজার ৭৬ জনে।

এই সময়ে মাদ্রাসায় প্রায় ২০ হাজার শিক্ষার্থী কমলেও স্কুলে মাধ্যমিক পর্যায়ে সাধারণ শিক্ষায় ছাত্র সংখ্যা বেড়েছে ৯ লাখ ২২ হাজার ৪৬২ জন। ২০০০ সালে সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থায় ছাত্র সংখ্যা ছিল ৩৬ লাখ ২৬ হাজার ৬৪৮ জন। আর ২০১৫ সালে এই সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৪৫ লাখ ৪৯ হাজার ১১০ জন।

২০০০ সালে এইচএসসি সমমানের আলিমে ছাত্র ছিল তিন লাখ ৩১ হাজার ৭৫২ জন। ১৫ বছর পর এই সংখ্যা হয় তিন লাখ ৩৪ হাজার ৬৪৫ জন।

মাদ্রাসা শিক্ষায় ছাত্র সবচেয়ে বেশি কমেছে ডিগ্রি সমমানের ফাজিলে। ২০০০ সালের চার লাখ ৬৩ হাজার ৮৩১ জনের তুলনায় ২০১৫ সালে কমে হয় তিন লাখ ৬৫ হাজার ৮৬ জনে।

এই সময়ে মাদ্রাসায় ছাত্র সংখ্যা সবচেয়ে বেশি বেড়েছে এই শিক্ষার সর্বোচ্চ পর্যায় কামিলে। ১৫ বছরে প্রায় ৮০ হাজার শিক্ষার্থী বেড়ে এক লাখ তিন হাজার ৫৭২ থেকে বেড়ে হয়েছে এক লাখ ৮২ হাজার ৩০১ জনে।

ব্যানবেইজের কাছে গত দুই বছরের হালনাগাদ তথ্যটি নেই। তবে প্রবণতা বলছে, মাদ্রাসার শিক্ষার্থী এই দুই বছরে আরও কমেছে।

মাদ্রাসায় এসএসসির সমমানের দাখিল পরীক্ষায় ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে ১০ হাজার। ২০১৫ সালের পরীক্ষায় অংশ নেয় দুই লাখ ৫৬ হাজার ৩৮০ জন আর ২০১৬ সালে অংশ নেয় দুই লাখ ৪৬ হাজার ৩৩৬ জন। আর চলতি বছর এই সংখ্যা আবার কিছুটা বেড়ে ২০১৫ সালের পর্যায়ে পৌছে। চলতি বছর পরীক্ষা দিয়েছে দুই লাখ ৫৬ হাজার ৫০১ জন। 

ছেলে কমলেও বেড়েছে মেয়ের সংখ্যা

মাদ্রাসায় ছেলের সংখ্যা কমলেও এই ১৫ বছরে মেয়ের সংখ্যা বেড়েছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে। এই ১৫ বছরে মেয়ের সংখ্যা বেড়েছে মোট সাত লাখ ৭৮ হাজার ২৩৯ জন। ২০০০ সালে ১২ লাখ ২৬ হাজার ২০৯ জন মেয়ে শিক্ষার্থীর বিপরীতে ২০১৫ সালে এই সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ২০ লাখ চার হাজার ৮৪৪ জন। আসলে ২০১৫ সালে ছেলে শিক্ষার্থীদেরকে সংখ্যার দিক দিয়ে ছাপিয়ে যায় মেয়ে শিক্ষার্থীরা।

তবে মাদ্রাসার তুলনায় সাধারণ শিক্ষায় মেয়েদের অংশগ্রহণ বেড়েছে আরও বেশি হারে। এই সময়ে কেবল মাধ্যমিকেই সময়ে ছাত্রী সংখ্যা ১১ লাখ ৭৩ হাজার ৭২৫ জন।

ছেলে শিক্ষার্থী কমলেও বেড়েছে মাদ্রাসা

মাদ্রাসার মোট শিক্ষার্থী সংখ্যা মূলত মেয়েদের জন্য বাড়লেও এই ১৫ বছরে মাদ্রাসার সংখ্যা বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৬ সালে সারা দেশে দাখিল, আলিম, ফাজিল ও কামিল মিলিয়ে আধাসরকারি মাদ্রাসা ছিল ৬ হাজার ৬৫০টি। পরের বছর এ সংখ্যা বেড়ে হয় ৬ হাজার ৮৫১। ১৯৯৮ সালে ৬ হাজার ৯৫৬টি। ২০১৫ সালে আধাসরকারি মাদ্রাসার সংখ্যা বেড়ে হয় নয় হাজার ৪৪১টি।

(ঢাকাটাইমস/০৩মে/এমএম/ডব্লিউবি)