শেষ বেলায় স্বতন্ত্র পরিচয় মুছলেন তারা নির্বাচনের ভাবনায়

প্রকাশ | ০৭ মে ২০১৭, ০৮:৪৩

তানিম আহমেদ, ঢাকাটাইমস

দশম সংসদ নির্বাচন বিএনপি বর্জন করায় আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলে কার্যত দলের সিদ্ধান্ত না মেনে স্বতন্ত্র হিসেবে দাঁড়ানো কয়েকজন নেতা। সরকারের মেয়াদের প্রায় সাড়ে তিন বছর তারা স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য হয়েই কাটিয়েছেন। তবে এই পরিচয় আর ভালো লাগছে না তাদের। ঘরের ছেলে ঘরে ফেরার মতো করেই ১১ জন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য হিসেবে নিজেদের পরিচয় দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তারা সবাই যোগ দিয়েছেন দলে। আজ রবিবার দলের সংসদীয় দলের সভায় প্রথমবারের মতো যোগ দিচ্ছেন তারা।

এই ১১ জন ছাড়াও বিএনপি ও জাতীয় পার্টির সাবেক সংসদ সদস্য রুস্তম আলী ফরাজীও যোগ দিয়েছেন আওয়ামী লীগে। তবে তিনি বিদেশ থাকায় আজকে ক্ষমতাসীন দলের সংসদীয় দলের সভায় যোগ দিতে পারছেন না।

দশম সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নিলেও একাদশ সংসদ নির্বাচনে তারা অংশ নেবে ধরেই ছক কষছে ক্ষমতাসীন দল। স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরাও এই হিসাবের বাইরে নন। বিএনপি অংশ নিলে দুই দলের শক্তিশালী প্রার্থীকে ডিঙিয়ে স্বতন্ত্র হিসেবে জিতে আসা কঠিন হবে বলেই ধারণা তাদের। এ কারণেই তারা দলে ফিরেছেন বলে জানিয়েছেন একাধিক নেতা।

একাধিক স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য বলছেন, বিএনপি অংশ না নেয়ায় তাদের সমর্থকদের ভোট, পাশাপাশি আওয়ামী লীগের একাংশের সমর্থনও পাওয়া গেছে গত নির্বাচনে। তবে বিএনপি ভোটে এলে এর কোনোটাই পাওয়া যাবে না। আর গত নির্বাচনে জিতে নিজেদের জনপ্রিয়তার প্রমাণ দেয়া গেছে বিধায় আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়া কঠিন হবে না বলেই ধারণা স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের। তাই নিজেদের অবস্থানকে নিরাপদ করতে চাইছেন।  

এ তো গেল সংসদ সদস্যদের দিক থেকে। আওয়ামী লীগের দিক থেকেও একটা সমীকরণ আছে। ২০১৮ সালের শেষ দিকের নির্বাচন সামনে রেখে প্রার্থী বাচাইয়ের কাজ এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে। এ জন্য স্বতন্ত্র হিসেবে পাস করা জনপ্রিয় নেতাদের দলে ফেরাতে চাইছে তারাও।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর একজন নেতা ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘তৃণমূলের মানুষের কাছে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের জনপ্রিয়তা এবং গ্রহণযোগ্যতা আছে বলেই তারা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। এসব এমপি আবার আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথেও জড়িত দীর্ঘদিন ধরে। তাই আগামী নির্বাচনের প্রার্থী বাচাইয়ে সুবিধার জন্যই তাদের দলে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।’

এই নেতা বলেন, ‘স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের দলে ফিরিয়ে আনা হলে দলের জন্য তাদের আগামীর চিন্তাভাবনাও জানা যাবে। নেতাকর্মীদের সাথে তাদের একটা ভালো সম্পর্কও গড়ে উঠবে। আর যদি এখন ফিরিয়ে আনা না হয়, তাহলে তাদের আগামী দিনের প্রার্থী বাছাইয়ে হিমশিম খেতে হবে।’

স্বতন্ত্ররা ফেরায় ক্ষোভও আছে দলে

আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, স্বতন্ত্ররা ফিরে আসায় সবচেয়ে ক্ষুব্ধ হয়েছেন তাদের সাথে পরাজিত নেতারা। বিদ্রোহী নেতাদের দলে ফিরিয়ে নেওয়ায় মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেছে বলেই ধারণা তাদের। বিষয়টি নিয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে কয়েকজন অনুযোগও করেছেন বলে জানিয়েছে দলের সূত্র।

ক্ষুব্ধ এসব নেতার কয়েকজন ঢাকাটাইমসকে বলেন, আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ প্রকাশ করে এরা নির্বাচিত হয়েছে। এটা দলের শৃঙ্খলা বিরোধী। তাই তাদের বিদ্রোহের শাস্তি না দিয়ে দলে ফেরানোর উদ্যোগ দলের ভেতর বিশৃঙ্খলাকে আরও উস্কে দেবে।

নওগাঁ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল মালেক বলেন, নওগাঁ-৩ থেকে স্বতন্ত্র নির্বাচিত ছলিম উদ্দিন তরফদার ছিল আমার রাজনৈতিক শিষ্য। তিনি বলেন, ‘২০১৪ সালের নির্বাচনে দল থেকে আকরাম হোসেন চৌধুরীকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। কিন্তু বিদ্রোহ প্রকাশ করে ছলিম নির্বাচন করায় আমি তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করি।’ তিনি বলেন, নেত্রী  (শেখ হাসিনা) যদি তাকে ক্ষমা করে দেন আমাদের কিছু করার নাই।’

গাইবান্ধা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সৈয়দ শামসুল আলম হিরু ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আবুল কালাম আজাদ (গাইবান্ধা-২ আসনে স্বতন্ত্র হিসাবে নির্বাচিত সংসদ সদস্য) আগেও আওয়ামী লীগে ছিল, মাঝখানে তিনি বিদ্রোহী হিসাবে নির্বাচন করেছেন। কেন্দ্র হয়তো মনে করেছেন তিনি ভুল স্বীকার করে শোধরে নিয়েছেন, আর আগামীতে তাকে দরকার হতে পারে সেই বিবেচনায় কেন্দ্রীয় কমিটি হয়তো তাকে ক্ষমা করে দিয়েছে। কেন্দ্র এখন সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেই বিষয়ে আমাদের কোনো কিছু বলা ঠিক হবে না।’

কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সদর উদ্দিন খান বলেন, রেজাউল হক চৌধুরী ( কুষ্টিয়া-১ আসন থেকে স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচিত সংসদ সদস্য) বিগত নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসাবে বিজয়ী হয়েছেন। তিনি আগেও আওয়ামী লীগ করতেন, এখনো তিনি আওয়ামী লীগে আছেন। রেজাউল হক জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান কমিটির সদস্য এবং দৌলতপুর উপজেলা আওয়ামী সিনিয়র সহ-সভাপতি। তার আওয়ামী লীগে ফিরে আসায় স্থানীয় রাজনীতিতে কোনো সমস্যা হবে না বলে আমি মনে করি।’

যা বলছেন স্বতন্ত্ররা

আওয়ামী লীগে ফেরার বিষয়টি আসলে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের কাছে একটু অন্য রকম। কারণ, তারা সংসদে স্বতন্ত্র পরিচয়ে থাকলেও নিজ এলাকায় আওয়ামী লীগার হিসেবেই কাজ করেছেন আগে থেকেই। কেউ কেউ দলের পদেও আছেন। ঢাকা-৭ আসনের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য হওয়ার পরও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সদস্য পদ যায়নি হাজী মো. সেলিমের। একই অবস্থা নরসিংদী-৩ আসনের সিরাজুল ইসলাম মোল্লার। স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য পরিচয়ধারী এই নেতার রাজনৈতিক পরিচয় যুবলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য। অন্য নয়জনের অবস্থাও একই রকম।

নওগাঁ- ৩ আসনের সংসদ সদস্য ছলিম উদ্দিন তরফদার ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমরা আওয়ামী লীগে ছিলাম, এখনও আওয়ামী লীগই করি। এত দিন আমরা স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য ছিলাম এ কারণে আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের বৈঠকে উপস্থিত হতে পারতাম না। এখন পারব। জননেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে আমাদের দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাহেব বৈঠক করে এ সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন।’

বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ায় তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সাথে কোনো দূরত্ব ছিল কি না এমন প্রশ্নের জবাবে এই সংসদ সদস্য বলেন, ‘কিছু নেতাকর্মীর সাথে তো একটু দূরত্ব ছিলই। কিন্তু দলের এ সিদ্ধান্তের কারণে সেই দূরত্ব আর থাকবে না।’

ছলিম উদ্দিন জানান বিগত নির্বাচনে দলের প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তা না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হন। বলেন, ‘নির্বাচনকে অর্থবহ করার জন্যই এ নির্বাচনে অংশ নিয়েছি।’

নরসিংদী-৩ আসনের সিরাজুল ইসলাম মোল্লা বলেন, ‘আমি এখনও আওয়ামী যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য। আর আওয়ামী লীগে যাওয়া নিয়ে তো কোনো প্রশ্ন উঠতে পারে না। এতদিন আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের বৈঠকে যেতে পারতাম না, দলের এ সিদ্ধান্তের কারণে এখন যেতে পারব।’

বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়া প্রসঙ্গে সিরাজুল বলেন, ‘দেশের তৎকালীন পরিস্থিতি কারণেই বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছি। নির্বাচন করা মানে এ না যে আমি আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছি।’

নরসিংদী-২ আসনের সংসদ সদস্য কামরুল আশরাফ খান বলেন, ‘আমি তো পলাশ উপজেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি। আওয়ামী লীগে ছিলাম, আছি, থাকবো।’

কুষ্টিয়া-১ আসনের সংসদ সদস্য রেজাউল হক চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের সেই দিন বৈঠকে ডাকা হয়েছিল। আমরা যোগ দিয়েছিলাম। বৈঠকে আমি বলেছি, জনগণের দাবির কারণেই আমি প্রার্থী হয়েছিলাম, সেটা নৌকার বিরুদ্ধে ছিল না, ছিল প্রার্থীর বিরুদ্ধে।’

যশোর-৫ আসনের সংসদ সদস্য স্বপন ভট্টাচার্য্য ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘দল তো আমাকে কখনই বহিষ্কারও করেনি। তাই যোগদানের প্রশ্নও নাই। বিদ্রোহী হিসাবে নির্বাচন করায় আমরা আওয়ামী লীগের সংসদ ছিলাম না। এখন দল আমাদের স্বীকৃতি দিয়েছেন।’

দলে থেকে দলের প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা কতটুকু নৈতিক-জানতে চাইলে স্বপন বলেন, ‘জনগণের দাবির প্রেক্ষিতে আমি নির্বাচন করেছিলাম। কারণ তৎকালীন সংসদ খান টিপু সুলতানের জনসমর্থন ছিল না। মানুষ পরিবর্তন চেয়েছে। আর বিরোধী দলে নির্বাচনে না আসায় আমি সুযোগটা নিয়েছি। আমি নৌকার বিরুদ্ধে নয়, খানি টিপু সুলতানের বিরুদ্ধে নির্বাচন করেছি।’ 

দুই দল ঘুরে আওয়ামী লীগে রুস্তম

পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার রুস্তম আলী ফরাজী একদিন যত নির্বাচন করেছেন, তার প্রতিটিতেই তিনি লড়াই করেছেন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে। উপজেলা থেকে শুরু করে সংসদ সদস্য প্রতিটি নির্বাচনেই তিনি আওয়ামী লীগকে আক্রমণ করে কথা বলেছেন। সেই নেতাই এখন দলে যোগ দিচ্ছেন। এ নিয়ে পিরোজপুরে প্রতিক্রিয়া আছে মিশ্র।

জানতে চাইলে পিরোজপুর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল হাকিম হাওলাদার বলেন, ‘রুস্তুম আলী ফরাজী স্বতন্ত্র হিসাবে বিগত নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। এখন তিনি আওয়ামী লীগে জয়েন করতেছেন। আর তার আগামী দিনে কর্মকাণ্ডেই বিষয়টি মূল্যায়ন হবে এতে ক্ষতি হয়েছে না লাভ হয়েছে।’

জনাব হাওলাদার বলেন, ‘মঠবাড়িয়ায় রুস্তুম আলী ফরাজী সাহেবের একটা সমর্থন আছে সেটা অস্বীকার করবো না। এ কারণেই তিনি গতবার আমাদের প্রার্থীকে পরাজিত করেছেন। তবে তাঁর যোগদানে যারা এ আসন থেকে নির্বাচন করতে চেয়েছেন তারাতো বিক্ষুব্ধ হবেন সেটাই স্বাভাবিক।’

কেন্দ্রীয় নেতারা যা বলছেন

দলের প্রার্থীর বিরোধিতা করে নির্বাচন করা নেতাদেরকে দলে ফেরানোর বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহমান ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমাদের গত কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে তোদের সাধারণ ক্ষমা করে দেয়া হয়েছিল। এখন তারা আওয়ামী লীগের প্রাথমিক সদস্য হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হবেন। যেহেতু দল তাদের ক্ষমা করে দিয়েছেন তাই এতে কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে না বলে আমি মনে করি।’

আবদুর রহমান বলেন, ‘আগামী নির্বাচনে প্রার্থী বাচাইয়েরও একটি বিষয় রয়েছে। এ নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার জন্য যেখানে যা করার প্রয়োজন আমরা তা করবো।’

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘যারা স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য আছেন তারা দীর্ঘদিন ধরেই আমাদের দলের সাথেই আছেন। তারা দলের আদর্শের প্রতিও অনুগত। স্বতন্ত্র সংসদদের মধ্যে অনেকের জনপ্রিয়তাও রয়েছে। তাই তাদের এ যোগদান দলের জন্য ভালোই হবে বলে আমি মনে করি।’

আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘বিগত জাতীয় নির্বাচন স্বাভাবিক নির্বাচনের থেকে একটু ব্যতিক্রম ছিল। ওই সময় পরিস্থিতিও ভিন্ন ছিল কিন্তু স্বভাবিক সময়ে যারা বিদ্রোহ করছেন তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।’।

ঢাকাটাইমস/০৭মে/টিএ/ডব্লিউবি