‘ক্ষুদে আইনস্টাইন’ আইজ্যাক কি পাবে শেখ হাসিনার সাক্ষাৎ?

প্রকাশ | ০৮ মে ২০১৭, ০৮:২৮ | আপডেট: ০৮ মে ২০১৭, ১০:৫৮

শেখ আদনান ফাহাদ

পাঁচ বছরের একটি ছেলে একের পর এক পিএইচডি লেভেলের গণিত সমস্যার সমাধান করে চলেছে! যারা গণিত বোঝেন না, তারাও এই দৃশ্য দেখে অবাক হবেন। আইজ্যাক সুবর্ণ নামের এই বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বালক শুধু গণিত না, পদার্থ ও রসায়নের নানা জটিল সমস্যারও উত্তর দিয়ে দেয় অবলীলায়।

আইজ্যাক সুবর্ণের জন্ম ২০১২ সালের ৯ এপ্রিল, যুক্তরাষ্ট্রে। বিজ্ঞানের দুনিয়ায় বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আইজ্যাক সুবর্ণকে ডাকা হচ্ছে ‘ক্ষুদে আইনস্টাইন’ হিসেবে। এই বিস্ময় বালকের কীর্তিতে ইতোমধ্যে মুগ্ধ হয়ে তারিফ করেছেন সদ্য সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, নোবেল বিজয়ী অলিভার হার্ট এবং ড. মুহম্মদ ইউনূসসহ বিশ্বখ্যাত ব্যক্তিরা। নিজেদের মুগ্ধতা প্রকাশ করতে সুবর্ণকে জন্মদিনের উপহার পাঠিয়েছে অক্সফোর্ড ও পেনসেলভেনিয়া ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ।

বাবার মাতৃভূমি বাংলাদেশে আসতে চায় সুবর্ণ। বিস্ময়কর বিষয় হলো, বাংলা না বুঝলেও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ শুনে বঙ্গবন্ধুর ছবিতে চুমু দিয়ে সে বলেছে, ‘আই লাভ ইউ বঙ্গবন্ধু’। ই-মেইল করে চিঠি পাঠিয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ৩ এপ্রিল ওয়াশিংটনের বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে দুজন অফিসার নিউইয়র্কের ব্রংস-এ সুবর্ণদের বাসায় গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করে এসেছেন।

সুবর্ণের বাবা রাশিদুল বারী নিজেও একজন আলোচিত ব্যক্তি। তিনি গত সপ্তাহে বিশ্বের মধ্যে অন্যতম শীর্ষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত শিক্ষায় ডক্টরাল লেভেলে ভর্তি হয়েছেন। কর্মজীবনে শুরুতে সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি করেছেন রাশিদুল বারী। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়েই ভর্তি হবেন এমন স্বপ্ন পূরণে বিভিন্ন বিষয়ে পাঁচটি ব্যাচেলর ডিগ্রি এবং দুটি মাস্টার্স ডিগ্রি নিয়েছেন বারী। খ্যাতিতে বাবাকে ইতোমধ্যে ছাড়িয়ে গেছেন ‘ক্ষুদে আইনস্টাইন’ সুবর্ণ।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের  সদ্য সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ক্ষমতায় থাকাকালীন সুবর্ণকে একবার চিঠি লিখলেন। সেখানে বারাক ওবামা লিখলেন, ‘তোমার মতো ছাত্রের বড় দরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। তুমি একজন এমন ছাত্র যে কঠোর পরিশ্রম করছ, পাশাপাশি বড় স্বপ্ন দেখছ আর কমিউনিটির উন্নয়নে কাজ করছ’।

গত ১৬ ফেব্রুয়ারি অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ভাইস-চ্যান্সেলর প্রফেসর লুইজ রিচার্ডসন এক চিঠিতে লিখেছেন, ‘প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার মতো আমিও চাই তুমি বড় বড় স্বপ্নপূরণে কঠোর পরিশ্রম করে যাও’। তোমার পঞ্চম জন্মদিনে উপস্থিত থাকতে পারবনা। তাই আমরা অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির প্রফেসররা তোমার জন্য জন্মদিনের উপহার পাঠালাম’।

মার্চের ২ তারিখে নোবেল বিজয়ী ডক্টর অলিভার হার্ট সুবর্ণকে লেখা এক চিঠিতে  বলেন, ‘ তোমার জীবনগল্প শুনে আমি মুগ্ধ। এই বয়সে তোমার অর্জন অসাধারণ। আমি বিশ্বাস করি, ভবিষ্যতে অনেক আগ্রহ নিয়ে তোমার কীর্তি প্রত্যক্ষ করতে পারব’।

গত ফেব্রুয়ারি মাসের ৩ তারিখে পেনসেলভেনিয়া ইউনিভার্সিটির প্রেসিডেন্ট অ্যামি গুটম্যান সুবর্ণকে লিখেন। ‘ তোমার যাত্রা নিয়ে আরও বেশি কিছু জেনে আমি খুব খুশি হবো। চল আমরা গণিত এবং বিজ্ঞানের প্রেমে পড়ি’।

আইজ্যাক চার বছর বয়সে কী করতে পারত? অথবা তারও আগে? এত বিস্ময় জড়িয়ে থাকতে পারে একটা ছোট বাবুর জীবনে? যার সাথে সুবর্ণের তুলনা হচ্ছে, অর্থাৎ বিজ্ঞানী আইনস্টাইন ছোটবেলায় কী করতে পেরেছিলেন? আইনস্টাইন নাকি চার বছর বয়সের আগে কথাই বলতে পারতেন না। স্যুপ খেয়ে গরম লাগায়, আইনস্টাইন নাকি প্রথম কথা বলে অভিযোগ করেছিলেন  যে, তার গরম লাগে।

২০১৬ সালে সাংবাদিক দেবব্রত ভৌমিক দেবু এবং সুমিত্র নাথ তাদের এক প্রতিবেদনে লিখেছেন, মাত্র দুই বছর বয়সে সুবর্ণ রসায়নের ‘পিরিয়ডিক টেবিল’ মানে ‘পর্যায় সারণী’ মুখস্ত বলে দিয়েছিল। এই বয়সেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই অঙ্ক শাস্ত্র, রসায়ন ও পদার্থবিদ্যায় সমানভাবে পারদর্শিতা দেখিয়ে দেয় সুবর্ণ। প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা ছাড়াই অনর্গল ইংরেজি বই পড়তে পারে সুবর্ণ।

সাংবাদিক দেবব্রত এবং সুমিত্র নাথ লিখেছেন, ‘দুই বছর বয়স চলাকালীন সময় একদিন তার বাবা জিজ্ঞেস করলেন, ১+১=?, ১-১=?, ১*১=?, ১/১=?। খুব দ্রুতই উত্তর দিয়ে দিলো সুবর্ণ। সবগুলো প্রশ্নের উত্তর সহজ বলে সাথে সাথে উত্তর দিয়ে দিলো সে, বাবা রীতিমতো বিস্মিত হলেন। বিজ্ঞানী নিউটনের সাথে নামের মিল থাকলেও কাজের ক্ষেত্রে বেশ মিল পাওয়া যায় আইনস্টাইনের সাথে। অবশ্য আইনস্টাইন তো জন্মের পর থেকে চার বছর পর্যন্ত কথাই বলেননি, আর সুবর্ণ এই বয়সেই মুগ্ধ করছে সবাইকে। পেয়ে গেছে ক্ষুদে আইনস্টাইন খেতাব। যে কারণেই হয়তো বিশ্বে ইতিহাস সৃষ্টি করবে বলে মনে করেন দ্য সিটি কলেজ অব নিউইয়র্কের প্রেসিডেন্ট লিসা কইকো। তিনি নিজেও একবার শিশু সুবর্ণের সাক্ষাতকার নিয়েছেন। কাগজে, গ্লাসে কিংবা বোর্ডে বিভিন্ন জায়গায় গাণিতিক সমাধান করছে চার বছরের এই বিস্মিত বালক। আর সন্তানের এমন অবাক করা বিষয়গুলো দেখে বেশ আশাবাদী বাবা-মা। মাত্র দুই বছরেই ভয়েস অফ আমেরিকায় সাক্ষাৎকার দিয়েছে। সাবরিনা চৌধুরী ডোনা তার সাক্ষাৎকার নেন এবং যেটি ছিল এ যাবতকালে ভয়েস অফ আমেরিকায় সবচেয়ে কনিষ্ঠজনের সাক্ষাৎকার। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশি অনলাইন টেলিভিশন ‘টাইম টেলিভিশন’-এ প্রচারিত হয় তার একটি সাক্ষাৎকার। নিউইয়র্কের মেডগার এভারস কলেজের (Medgar evers college) ভাইস প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক জেরল্ড পোসম্যান ছোট্ট এ শিশুটির রসায়নের পর্যায় সারণীর ওপর দখল দেখে বেশ মুগ্ধ হন। নিজেই কিছু রাসায়নিক সঙ্কেত জিজ্ঞেস করেন, আর সুবর্ণ সেগুলোর খুব দ্রুত উত্তর দেওয়ায় অবাক হন তিনি। সুবর্ণর একটি নিজস্ব ওয়েবসাইট রয়েছে। সেখান থেকে উত্তর পাওয়া যায় বিজ্ঞানের প্রতি তার আকাঙ্ক্ষা দিন দিন কী পরিমাণ বাড়ছে। সাড়ে তিন বছর বয়স থেকেই বাবার ল্যাবরেটরিতে বিভিন্ন প্রজেক্টের কাজ শুরু করে। যার মধ্যে একটি হচ্ছে লেবুর সাহায্যে ব্যাটারি তৈরি। যার মাধ্যমে ইলেক্ট্রিক সার্কিট বানিয়ে পোটেনশিয়াল ডিফারেন্সের মাধ্যমে বাতি জ্বালানো যায়। মাত্র তিন বছর বয়সে অর্থাত্ ২০১৫ সালে এটি আবিষ্কার করে সে। শুধু চারটি লেবু, চারটি পেরেক, চারটি মুদ্রা ও পাঁচটি এলিগেটর কিপ ব্যবহার করেই বানানো হয় এ ব্যাটারি। লিমন কলেজের ফিজিক্সের চেয়ারম্যান ড. ড্যানিয়েল কাবাট সুবর্ণর বানানো এই ব্যাটারি দেখে মুগ্ধ হন। আর সুবর্ণ দেখছে মাত্র ১০ বছর বয়সেই হার্ভার্ডে ভর্তি হওয়ার স্বপ্ন। আর এ জন্যই উচ্চ মাধ্যমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে যে SAT পরীক্ষা দিতে হয় সেই প্রস্তুতি নেওয়ার অপেক্ষায় আছে সুবর্ণ’।

আইজ্যাক শুধু গণিত, পদার্থ কিংবা রসায়নকে ভালোবেসে বড় হচ্ছে তা নয়, বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকেও ভালবাসতে শিখেছে সে। বাবা রাশিদুল বারী একবার তাকে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ দেয়া জাতির জনকের ভাষণ শুনিয়েছিলেন। সেই থেকে বঙ্গবন্ধুকে চিনতে শেখে সে।

আইজ্যাক এর বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার বিষয়ে  বাবা রাশিদুল বারী ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আইজ্যাক বাংলা বুঝে না, বলে না। আমি যখন তাকে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শুনতে দিলাম, কিছুক্ষণ শোনার পর সে ভিডিওটা পজ করে দিল। পর্দায় বঙ্গবন্ধুর ছবিতে সে চুমু খেল এবং বলল, আই লাভ ইউ, বঙ্গবন্ধু!’

আইজ্যাক বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে বাংলাদেশে যাওয়ার বায়না ধরল। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জানার চেষ্টা করতে থাকল। বাংলা ভালো বুঝে না বিধায় বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন একটি ডকুমেন্টারি বানিয়ে তাকে বাংলাদেশ সম্পর্কে জানাবেন। এর ফাঁকে একদিন সে বাবাকে বলল, বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চিঠি লিখবে সে।

রাশিদুল বারী ঢাকাটাইমসকে জানিয়েছেন, ‘আইজ্যাক-এর একটি চিঠি আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবর মেইল করি। উত্তর পাওয়ার আশা করিনি। এত ব্যস্ত থাকেন উনি। কিন্তু বিস্ময়কর বিষয় হলো একদিন দেখলাম, আমার ঠিকানায় ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে একটি মেইল এসেছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ড. সামিয়া ইসরাত রনি। সেখানে তিনি লিখেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে লেখা সুবর্ণর চিঠিটি তাদের হস্তগত হয়েছে। এ বিষয়ে তারা সরাসরি কথা বলতে বাসায় আসতে চান। এপ্রিল ৩ তারিখ ইসরাত এবং আরেকজন অফিসার  আব্দুল্লাহ আল মামুন আমার বাসায় আসে। শরীর খারাপ ছিল আইজ্যাকের। এরপরেও সে অফিসারদের সামনে একের পর এক গণিত সমস্যার সমাধান করে গেছে। অফিসাররা মুগ্ধতা নিয়ে ফিরে গেছেন’।

এখন রাশিদুল বারী আশায় আছেন, তার ছেলে, বিস্ময় বালক, ক্ষুদে আইনস্টাইন আইজ্যাক সুবর্ণ শেখ হাসিনার সাথে দেখা করে বঙ্গবন্ধুর প্রতি তার ভালোবাসার কথা বলতে পারবে। এ ক্ষেত্রে তাদের পছন্দ বাংলাদেশে এসে এই কাঙ্ক্ষিত সাক্ষাৎটি হবে। বাংলাদেশও দেখা হবে, বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে আরও জানতে পারবে। শেখ হাসিনার সাথেও নিজ দেশে কথা বলা যাবে।

(ঢাকাটাইমস/০৮মে/এসএএফ/জেবি)