জীর্ণ কুঠিরে আশার আলো...

প্রকাশ | ০৮ মে ২০১৭, ১৩:৪৯

ফরহাদ খান, নড়াইল

শিশুকাল থেকেই বাবার আদর-স্নেহ বঞ্চিত আশা। নেই নিজেদের ভিটেমাটিও। সঙ্গতকারণে ঠাঁই হয়েছে মামাবাড়িতে। তবু জীবনযুদ্ধে হেরে যাননি আশা খাতুন। সবার মুখ উজ্জ্বল করে চারিদিকে ছড়িয়ে দিয়েছেন আশার আলো।

নড়াইলের তুলারামপুর আদর্শ মাধ্যমিক বালিকা থেকে এ বছর এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে বিজ্ঞান শাখায় পেয়েছেন জিপিএ-৫। তবে, আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে উচ্চশিক্ষা নিয়ে সংশয়ে আশা ও তার পরিবার।

নড়াইল সদরের চাঁচড়া গ্রামে ছোট্ট একটি ভাঙ্গা ঘরে আশা, তার মা ও ছোট ভাইয়ের বসবাস। পাটকাঠি ও কাঠের বেড়ার ঘরে টিনের চালা। তবে, টিনের চালার বেশির ভাগ ভাঙ্গাচোরা ও অসংখ্য ছিদ্রযুক্ত হওয়ায় রোদ এবং বৃষ্টি তাদের নিত্যসঙ্গী! আর এ ধরনের ভাঙ্গাচেরা এবং নড়বড়ে ঘরেই আশাদের বসবাস। এক্ষেত্রে পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের ‘আসমানী’ কবিতার নড়বড়ে ঘরের কথাই মনে পড়ে যায়। আশাদের ঘরে নেই বিদ্যুতের আলোও। তাই বেশির ভাগ দিনের বেলায় পড়ালেখা করেছেন তিনি।

আশা জানান, প্রতিদিন দুই থেকে তিন ঘণ্টা পড়ালেখা করতেন। পড়ার ফাঁকে নবম শ্রেণির চার শিক্ষার্থীকে টিউশনি করিয়ে মাসিক সম্মানী পেতেন মাত্র ৮০০ টাকা। এ টাকা দিয়ে নিজের পড়ালেখার খরচ যোগানোর চেষ্টা করতেন। মূল বইয়ের পাশাপাশি বিদ্যালয় থেকে সহায়ক বই, খাতা-কলম ও স্কুলড্রেস পেয়েছেন তিনি। পদার্থ ও রসায়ন ছাড়া কখনো প্রাইভেট পড়ার সৌভাগ্য হয়নি তার। আশা ভবিষ্যতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে চান। তবে, গোল্ডেন জিপিএ-৫ না পাওয়ায় অনেক দুঃখ তার। ইংরেজি বিষয়ে এ গ্রেড হওয়ায় ফল পুনঃনিরীক্ষার আবেদনের মাধ্যমে গোল্ডেন জিপিএ-৫ লাভের আশায় বুক বেঁধেছেন আশা।

আশার মা জোবেদা বেগম জানান, তার স্বামীর বাড়ি কুমিল্লা জেলায়। আশার বয়স যখন তিন বছর, তখন তার বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। মানসিক যন্ত্রণা ও নির্যাতনের কারণে কুমিল্লা থেকে বাবার বাড়ি নড়াইলের চাঁচড়া গ্রামে চলে আসেন তিনি। বাবার বাড়িতে ভিটেমাটি ছাড়া তেমন কিছু না থাকায় নেমে পড়েন জীবনযুদ্ধ। কাঠোর পরিশ্রম করেও সন্তানদের মুখে দুবেলা দুমুঠো খাবার জোটাতে অনেক বেগ পেতে হয় জোবেদা বেগমকে। তবু সন্তানদের পড়ালেখা শিখিয়ে মানুষের মতো মানুষ করার নিরন্তর চেষ্টা তার। প্রায় দুই বছর আগে বড় মেয়ে সামিয়া জামানকে শরীয়তপুরের জাজিরা এলাকায় বিয়ে দিলেও পড়ালেখা থেমে থাকেনি। সামিয়া এ বছর নড়াইল সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে বাংলা বিষয়ে অনার্স শেষবর্ষের পরীক্ষা দিয়েছেন।

এদিকে, আশার পাশাপাশি ছোট ভাই সৌরভ হোসেন পড়ছে স্থানীয় দারুল উলুম আলিম মাদরাসায় সপ্তম শ্রেণিতে। পড়ালেখার পাশাপাশি সৌরভও বিভিন্ন কাজ করে।

বড় মেয়ে সামিয়া জামান বলেন, বাবা মারা গেছেন; না জীবিত আছেন তা আর জানা হয়নি।

দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী চাঁচড়া গ্রামের লামিয়া খাতুন জানায়, শত বাধা পেরিয়ে আশা আপু আমাদের মাঝে আশার আলো ছড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি আমাদের এলাকার অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।

প্রতিবেশিরা জানায়, আশা খুব কষ্ট করে এ পর্যন্ত এসেছে। মামাবাড়ির ভিটায় জরাজীর্ণ টিনের খুপড়ি ঘর ছাড়া কিছু নেই আশাদের। তাদের রান্নার কাজটিও করতে হয় উঠোনের একপ্রান্তে খোলা জায়গায়। আশার দুই মামার আলাদা সংসার। আর নানা থাকেন এক খালার সঙ্গে।

বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শিউলি খাতুন বলেন, উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেয়ে আশা অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারবে। আশা জেএসসিতেও গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়েছিল।

তিনি জানান, এ বছর তাদের বিদ্যালয় থেকে একমাত্র আশা খাতুনই জিপিএ-৫ পেয়েছে।

(ঢাকাটাইমস/৮মে/প্রতিনিধি/এলএ)