লালমনিরহাটে শিক্ষক দম্পতির বোতল বাড়ি

প্রকাশ | ১০ মে ২০১৭, ১৩:১৫ | আপডেট: ১০ মে ২০১৭, ১৩:২৪

এস কে সাহেদ, লালমনিরহাট থেকে

পরিত্যক্ত প্লাস্টিকের বোতল দিয়ে স্বল্প খরচে পরিবেশবান্ধব বসবাসযোগ্য বাড়ি তৈরি করে সবাইকে তাক লাগিয়েছেন লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার চন্দ্রপুর ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী নওদাবাস গ্রামের এক শিক্ষক দম্পত্তি। ১৭শ’ স্কয়ার ফিট বাড়িটি তৈরি করতে তারা কোনো ইট ব্যবহার করেননি। ব্যতিক্রমী বাড়িটি দেখতে প্রতিদিন অসংখ্য উৎসুক মানুষ বাড়িটির সামনে ভিড় করছেন।

সরেজমিনে কথা বলে জানা যায়, রাশেদুল আলম ও তার স্ত্রী আসমা খাতুন বাড়িটি বানাচ্ছেন। দুজনেই ঢাকার শেখ বোরহান উদ্দিন পোস্ট গ্রাজুয়েট কলেজে পরিবেশ বিজ্ঞান বিষয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করতেন।

তাদের দুই ছেলের মধ্যে বড় ছেলে রাফিদুল মানসিকভাবে অসুস্থ। তাকে কোলাহলমুক্ত পরিবেশে রাখতে বাবা-মাকে পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা। এজন্য শহরের কোলাহল ছেড়ে প্রাকৃতিক পরিবেশে ছেলেকে বড় করতে ওই শিক্ষক দম্পত্তি ঢাকা ছেড়ে কালীগঞ্জ উপজেলার চন্দ্রপুর ইউনিয়নের নওদাবাস গ্রামের বাড়িতে স্থায়ীভাবে চলে আসেন। কিন্তু কী ধরনের বাড়ি করবেন বিষয়টি নিয়ে দুজনই চিন্তায় পড়েন। পরে ইন্টারনেট থেকে স্ত্রী আসমা খাতুন জানতে পারেন পরিত্যক্ত প্লাস্টিকের বোতল দিয়ে ইকো হাউস নামে চমৎকার বাড়ি তৈরি করছেন জাপানিরা। এতে উৎসাহিত হয়ে ওই দম্পত্তি প্লাস্টিকের বাড়ি নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন।দু’জন মিলে রপ্ত করতে থাকেন বাড়ি তৈরির কৌশল। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তারা বোতল সংগ্রহ করতে থাকেন।

এমন বাড়ি নির্মাণের পরিকল্পনার কথা জানতে পেরে রাশেদুলের বড় ভাই শফিউর রহমান বাধা দিলেও কোনো কাজ হয়নি। তার বাধা উপেক্ষা করে বাড়ি নির্মাণ শুরু করে ওই দম্পতি। শুরুর দিকে অনেকে উপহাস করলেও ওই দম্পতি থেমে থাকেননি। তারা চালিয়ে যেতে থাকেন বাড়ি নির্মাণের কাজ। এমন বাড়ি নির্মাণের খবর মিডিয়ায় প্রচার হলে বাড়িটি দেখতে অনেক মানুষ ভিড় করে। ইতোমধ্যে বাড়িটি ‘বোতল হাউজ’ সেবে পরিচিত লাভ করেছে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, বাড়িটিতে চার রুমের থাকার ঘর আছে। এছাড়া দুটি বাথরুম, রান্না ঘর, বারান্দা আছে। ১৭শ’ স্কয়ারফিটের বাড়িটি নির্মাণে বিভিন্ন সাইজের বোতল ব্যবহার করা হচ্ছে। এমনকি বাথরুমের সেফটিং ট্যাংক ও মেঝেতে ব্যবহার করা হয়েছে প্লাসটিকের বোতল। বাড়ির ভিত্তিমূলে এক লিটার এবং দেয়ালে ব্যবহার করা হয়েছে হাফ লিটার প্লাস্টিকের বোতল।

বোতলগুলো বালিতে ভর্তি করার পর সিমেন্ট দিয়ে তা দেয়ালে গাথা হয়। বোতলে বালি দেয়ায় স্বাভাবিক ইটের তুলনায় ১৫ থেকে ২০ গুন বেশি শক্ত হয় বলে দাবি করেন রাশেদুল। এছাড়া বালি গরমে তাপ শোষণ করে ঘরকে অপেক্ষাকৃত ঠাণ্ডা রাখে বলেও জানান তিনি।

পার্শ্ববর্তী গ্রামের বাসিন্দা আলিমুজ্জামান জানান, ‘এত কম ট্যাকায় মজবুত বাড়ি হয়, এটা আগোত জানলে হামরাও প্লাস্টিকের বোতল কুড়িয়ে বাড়ি কইরবার পানু হয়।’

বাড়ির রাজমিস্ত্রী রুদ্রেশ্বর রায় জানান, ‘সারা জীবনতো ইট দিয়া বাড়ি গড়ে দিছি মাইনষোক (মানুষকে), এবার প্লাস্টিকের বোতল দিয়া বাড়ি করছোং বাহে।’

বাড়িটির মালিক রাশেদুল জানান, ‘পরিবেশ রক্ষার ওপর দায়বদ্ধতা থেকে অভিনব এই বাড়ির কাজে হাত দেই। আর এ কাজে তার স্ত্রী আসমা খাতুন তাকে সার্বক্ষণিক সাহস জোগাচ্ছেন। পরিবেশ বান্ধব, তাপশোষক, অগ্নিনিরোধক ও ভূমিকম্প সহায়ক বাড়িটি ইটের তৈরি বাড়ি থেকে ৪০ শতাংশ টাকা কম খরচ হয় বলে জানান তিনি। আগামী এক মাসের মধ্যে অবশিষ্ট কাজ শেষ করে তারা বোতল হাউজে বসবাস শুরু করবে বলে জানায় এই দম্পত্তি।

রাশেদুল দম্পতি জানায়, ‘বাড়িটি করতে ৭৫ থেকে ৮০ হাজার প্লাস্টিকের বোতল (৪০ মণ বোতল) লাগবে। ইতোমধ্যে তারা ৬০ মণ বোতল কিনেছেন। প্রতি কেজি বোতল প্রকার ভেদে কিনতে হয়েছে ২৫ থেকে ৩০ টাকায়। টিনের চালা বাদে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকার মধ্যে বাড়ির পুরো কাজ শেষ হবে বলে আশা করছেন তারা। চলতি বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি বাড়ির কাজ শুরু করেন। এ পর্যন্ত ৮০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে।

ওই গ্রামের প্রবীন ব্যাক্তি শেখ আব্দুল আলিম জানান, ইটের বাড়ি হয় সেটা জানি কিন্তু ফেলে দেয়া বোতল দিয়ে যে বাড়ি করা যায় তা রাশেদুলের এই বাড়িটি না দেখলে বিশ্বাস হতো না। তার এই বাড়িটি দেখে এলাকার অনেকেই উদ্বুব্ধ হচ্ছেন আবার অনেকে তাদের কাছ থেকে বাড়ির নকশা করে নিয়ে যাচ্ছেন বাড়ি করবেন।

প্লাস্টিকের বোতল দিয়ে তৈরি বাড়ি পরিবেশবান্ধব হলেও এটি ব্যবহারের আগে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন হওয়া উচিত বলে মনে করেন কালীগঞ্জ উপজেলা প্রকৌশলী পারভেজ নেওয়াজ খান। তিনি বলেন, ‘দরিদ্র মানুষদের কাছে এ ধরনের বাড়ি মডেল হিসেবে কাজ করবে। বোতলের বাড়িটি নির্মাণে যদি আড়াই লাখ টাকা ব্যয় হয়, তবে ইটের তৈরি এ রকম বাড়ি করলে চার লাখের মত ব্যয় হবে।’

ঢাকাটাইমস/১০মে/প্রতিনিধি/এমআর