সচিবালয়ে মুজাহিদের নামে কালি, ‘অক্ষত’ যুদ্ধাপরাধী নিজামী

মহিউদ্দিন মাহী, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ১৩ মে ২০১৭, ১১:১৫ | প্রকাশিত : ১৩ মে ২০১৭, ০৮:৪৭

মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসি হওয়া জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের নাম সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অনার বোর্ড থেকে মুছে দেয়া হয়েছে। অথচ একই দণ্ড পাওয়া জামায়াতের সাবেক আমির মতিউর রহমান নিজামীর নাম এখনও কৃষি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর তালিকায় স্বাভাবিক নিয়মেই রয়ে গেছে। নিজামীর আরেক মন্ত্রণালয় শিল্পের ওয়েবসাইটেও তার নাম আছে অন্য সব মন্ত্রীর মতই। তিনি যে যুদ্ধাপরাধী সেটার উল্লেখ নেই।

মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি হিসেবে খুনি বাহিনী আলবদরের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর নানা ঘটনাপ্রবাহে দুই জনই জামায়াতের নেতৃত্বে চলে আসেন আর ২০০১ সালে বিএনপির সঙ্গে জামায়াত জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করার পর মন্ত্রী হয়ে যান দুই আলবদর নেতা। মুজাহিদ হন সমাজকল্যাণ মন্ত্রী, আর নিজামী প্রথমে কৃষি এবং পরে হন শিল্পমন্ত্রী।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরের বছর গ্রেপ্তার হন মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত দুই জন। ২০১৬ সালের ১০ মে একাত্তরের খুনে বাহিনী আলবদরের নেতা নিজামীর ফাঁসি কার্যকর হয়। আপিল বিভাগ ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে নিজামীকে বলা হয়েছে ‘একাত্তরে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের নকশাকার’ হিসেবে।

ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অনার বোর্ড (মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের নামের তালিকা) এ মুজাহিদের নাম কালো কালিতে মুছে দেয়া হয়, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর নামের আসে বসেছে ‘যুদ্ধাপরাধী’। সেখানে কৃষি মন্ত্রণালয়ে নিজামীর নাম আছে অন্য মন্ত্রীদের মতই। শিল্প মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটেও তার নাম আছে স্বাভাবিক ভাবেই। যদিও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে মুজাহিদের নামের আগে ‘যুদ্ধাপরাধের দায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত’ লেখা আছে। তার ফাঁসি কার্যকরের সময়ও সেখানে উল্লেখ রয়েছে।

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০১ সালের ১০ অক্টোবর থেকে ২০০৩ সালের ২২ মে পর্যন্ত নিজামী ছিলেন কৃষিমন্ত্রী। ওই বছর এই মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে তাকে শিল্প মন্ত্রণালয়ে। ২০০৩ সালের ২৫ মে থেকে ২০০৬ সালের ২৭ অক্টোবর সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়া পর্যন্ত তিনি এই পদেই ছিলেন।

মুজাহিদের নাম সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অনার বোর্ডে মুছে দেয়া এবং ওয়েসবাইটে নামের আগে যুদ্ধাপরাধী লেখা থাকলেও এবং নিজামীর ক্ষেত্রে আলাদা নীতি কেন- জানতে চাইলে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ মঈনউদ্দিন আবদুল্লাহ ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে ভাবা হয়নি। এখন দেখা হবে।’

জানতে চাইলে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সুষেণ চন্দ্র দাস ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘এক সপ্তাহ সময় দেন, ওই নাম কেটে ফেলবো। আজ (এই প্রতিবেদন লেখা হয়েছে শুক্রবার) রাতেই মন্ত্রী মহোদয়ের সঙ্গে কথা বলব।’

স্বাধীনতার পর কৃষি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে যারা ছিলেন তাদের নামের তালিকার মধ্যে ২২ নম্বরে রয়েছে যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামীর নাম। আর শিল্প মন্ত্রণালয়ের তালিকায় ২৪ নম্বরে রয়েছে নিজামীর নাম।

বাংলাদেশের সংবিধানের ৬৬ ধারার ২ (ঘ), (ঙ) উপধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ১৯৭২ এর বিশেষ ট্রাইব্যুনাল কিংবা আদালত কর্তৃক মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে থাকে সেই ক্ষেত্রে তার সংসদপদ বাতিল হয়ে যায়।

৩ নম্বর উপধারায় বলা হয়েছে, যদি কেউ এই ধরনের অভিযোগে অভিযুক্ত হয় সেই ক্ষেত্রে সে যদি রাষ্ট্রপ্রতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, একজন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী হোন তারা প্রজাতন্ত্রের কোনো সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারবেন না।

সংবিধানের এই অনুচ্ছেদের কথা উল্লেখ করে একাত্তরে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘ওদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা দেওয়ায় আমরা যে কলঙ্ক পেয়েছি, তা ভবিষ্যতে আর চলতে দেয়া যায় না। তাদের আর বাংলাদেশের মন্ত্রী পদের মর্যাদা থাকতে পারে না। মন্ত্রণালয় ও জাতীয় সংসদে তাদের নাম রাখা মানে রাজাকারদের মনে রাখা। আমরা চাই না এই জাতি আর এই কলঙ্কিত মানুষদের মনে রাখুক।’

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর্যবেক্ষণে যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রী হওয়ার বিষয়ে বলা হয়ছিল, ‘তৎকালীন সরকার কর্তৃক এই অভিযুক্তকে মন্ত্রী হিসাবে নিয়োগ দেওয়া একটা বড় ধরনের ব্লান্ডার (বিরাট ভুল) ছিল। পাশাপাশি এটা ৩০ লাখ শহীদ ও সম্ভ্রম হারানো দুই লাখ নারীর প্রতি ছিল সুস্পষ্ট চপেটাঘাত। এই লজ্জাজনক ঘটনা পুরো জাতির জন্য অবমাননাকর।’

২০০০ সালে নিজামীই হন মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী দল জামায়াতের প্রধান বা আমির। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায়ও নিজামীর মৃত্যুদণ্ডাদেশ হয়েছিল। ২০১৪ সালের ৩০ জানুয়ারি চট্টগ্রামের মহানগর দায়রা জজ আদালত এই রায় দেন। মামলাটি হাইকোর্টে বিচারাধীন।

স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত দায়িত্বে ছিলেন যারা

দেশ স্বাধীনের পর থেকে এ পর্যন্ত কৃষি মন্ত্রণালয়ের অনার বোর্ডে নাম আছে মোট ২৭ জনের। তবে দায়িত্ব পালন করেছেন ২৫ জন। বর্তমান কৃষি মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা মতিয়া চৌধুরী ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রথম মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পান বাবু ফণিভূষণ মজুমদার। তিনি ১৯৭১ সালের ২৯ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর শেখ আবদুল আজিজ ও আবদুস সামাদ আজাদ হন কৃষিমন্ত্রী।

বঙ্গবন্ধু হত্যার পর আজিজুল হক হন মন্ত্রীর মর্যাদায় উপদেষ্টা। পরে মন্ত্রী হন নুরুল ইসলাম এবং আমিরুল ইসলাম কালাম।

১৯৮১ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত দায়িত্বে ছিলেন ফসিহ উদ্দিন মাহতাব। পরের দুই বছর এ জেড এম ওবায়দুল্লাহ খান। এরপর মন্ত্রী হন আবদুল হালিম চৌধুরী।

এরশাদ আমলে এম এ মুনিম, মির্জা রুহুল আমিন, মাহবুব-উজ-জামান, মাহমুদুল হাসান, এম এ মুনিম ও সরদার আমজাদ হোসেন নানা সময় সামলেছেন কৃষি মন্ত্রণালয়। ১৯৯১ সালে এক বছরের জন্য দায়িত্ব পালন করেন এ এম আনিসুজ্জামান।

বিএনপি সরকারের আমলে ১৯৯১ থেকে চার বছর মজিদ-উল এবং এক বছর কৃষিমন্ত্রী ছিলেন আব্দুল মান্নান ভুঁইয়া। ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে উপদেষ্টা ছিলেন এ জেড এম নাছিরউদ্দিন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের পাঁচ বছর কৃষিমন্ত্রী ছিলেন মতিয়া চৌধুরী।

২০০১ সাল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী। ২০০১ সাল থেকে ২০০৩ সাল পর্যণ্ত এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন মতিউর রহমান নিজামী, ২০০৩ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন এম কে আনোয়ার।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় এই মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার দায়িত্বে ছিলেন সি এম শফি সামী, সফিকুল হক চৌধুরী ও চৌধুরী সাজ্জাদুল করিম। ২০০৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করছেন মতিয়া চৌধুরী।

এখন পর্যন্ত শিল্প মন্ত্রী যারা

স্বীনতার পরে এই মন্ত্রণালয়েল প্রথম মন্ত্রী হন এম মনসুর আলী। তিনি ১৯৭১ সালের ২৯ ডিসেম্বর থেকে পরের বছর ১৩ জানুয়ারি পর্যন্ত পদে ছিলেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম ১৩-০১-৭২ থেকে ২৬-০১-৭৫ পর্যন্ত সামলেছেন এই মন্ত্রণালয়।

৭৫ এর ২৬ জানুয়ারি দায়িত্ব পাওয়া আবুল হাসনাত মোহাম্মদ কামরুজ্জামান ছিলেন বঙ্গবন্ধু হত্যা পর্যন্ত। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর মির্জা নুরূল হুদা (উপদেষ্টা)২৬-১১-৭৫ থেকে ২৩-০১-৭৬, এ. কে এম হাফিজউদ্দিন (উপদেষ্টা) ২৩-০১-৭৬ থেকে ১০-০৭-৭৭, জামালুদ্দিন আহম্মেদ (উপদেষ্টা) ১০-০৭-৭৭ থেকে ১২-০২-৮২ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।

জিয়াউর রহমান হত্যার পর ইউসুফ আলী, এস এম শফিউল আজম ছিলেন উপদেষ্টা। এরপর সুলতান মাহমুদ, মওদুদ আহমদ, এ ছাত্তার পালন করেন মন্ত্রীর দায়িত্ব।

এরশাদের পতনের পর উপদেষ্টা হন এ কে এম মুসা। ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর মন্ত্রী হন শামসুল ইসলাম খান, এ এম জহিরউদ্দিন খান এবং লুৎফর রহমান খান। ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় উপদেষ্টা ছিলেন শেগুফতা বখত চৌধুরী। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত মন্ত্রী ছিলেন তোফায়েল আহমেদ। ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় উপদেষ্টা ছিলেন মইনুল হোসেন চৌধুরী।

২০০১ সালে বিএনপি জামায়াত জোট সরকারের আমলে প্রথমে এম কে আনোয়ার ও পরে নিজামী সামলান মন্ত্রীর দায়িত্ব। ২০০৬ সালে ইয়াজউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সুলতানা কামাল উপদেষ্টা হন। তিনি পদত্যাগ করলে উপদেষ্টা হন মঈন উদ্দিন খান। সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে প্রথমে গীতিয়ারা সাফিয়া চৌধুরী ও পরে মাহবুব জামিল হন উপদেষ্টা।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রথমে দিলীপ বড়ুয়া ও পরে তোফায়েল আহমেদ হন শিল্পমন্ত্রী। আওয়ামী লীগের বর্তমান আমলে আমির হোসেন্ আমু এই দায়িত্ব সামলাচ্ছেন।

ঢাকাটাইমস/১৩মে/এমএম/ডব্লিউবি

সংবাদটি শেয়ার করুন

জাতীয় বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

জাতীয় এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :