মেধাবী আশার পাশে আশার আলো

প্রকাশ | ১৬ মে ২০১৭, ২১:০৯

ফরহাদ খান, নড়াইল

মেধাবী আশার উচ্চশিক্ষার পাশে দাঁড়িয়েছেন নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার পাঁচুড়িয়া গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ হাসান ইকবাল। শত বাধা অতিক্রম করে পিতৃহীন আশা খাতুন এ বছর নড়াইলের তুলারামপুর আদর্শ মাধ্যমিক বালিকা থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে বিজ্ঞান শাখায় জিপিএ-৫ পেয়েছেন। তবে, আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে উচ্চশিক্ষার ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কিত ছিলেন আশা ও তার পরিবার।

আশার এই সাফল্যগাঁথার কথা গত ৮ মে ঢাকাটাইমস অনলাইনে ‘জীর্ণ কুটিরে আশার আলো...’ শিরোনামে সচিত্র সংবাদ প্রকাশিত হয়। এ খবরে পিতৃহীন আশার পড়ালেখার খরচ চালিয়ে নেয়ার দায়িত্ব নিলেন সৈয়দ হাসান ইকবাল।

সোমবার বিকালে নড়াইল সদরের চাঁচড়া গ্রামে আশাদের জীর্ণ কুটিরে গিয়ে তাদের পরিবারের খোঁজখবর নেন তিনি। উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তির জন্য আশাকে তাৎক্ষণিক ৫ হাজার টাকা প্রদান করেন সৈয়দ হাসান ইকবাল।

এ সময় উপস্থিত ছিলেন ঢাকাটাইমসের নড়াইল প্রতিনিধি ফরহাদ খান, বৈশাখী টেলিভিশনের নড়াইল প্রতিনিধি মিরাজ খান, চাঁচড়া গ্রামের লিটু বিশ্বাস, তুলারামপুর আদর্শ মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক মধুমঙ্গল চৌধুরী, শিউলি খাতুন, কাইয়ূম আলী, সুকুমার চন্দ্র বিশ্বাস, শিশির বিশ্বাস, সুনীতা রানী সরকার, বিজয় কুমার, অর্পিতা রানী, কর্মচারী মোনায়েম হোসেন, আনোয়ারা বেগম প্রমুখ। 

সৈয়দ হাসান ইকবাল বলেন, ‘মেধাবী আশার উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়ালেখার জন্য যাবতীয় বই-খাতা, পোশাকসহ অন্যান্য খরচ আমি বহন করব। আজ  থেকে আশার পড়ালেখার বিষয়ে তার মায়ের কোনো চিন্তা থাকবে না বলে আমি আশ্বস্ত করছি। ভবিষ্যতে বিশ্ববিদ্যালয় বা মেডিকেল কলেজে পড়ালেখা চালিয়ে নিতেও আমি সহযোগিতা করব।

এছাড়া আশাদের জীর্ণ বাড়িটির পরিবর্তে বসবাস উপযোগী একটি বাড়ি করে দেয়ার কথাও বলেন অবসরপ্রাপ্ত এই সেনা কর্মকর্তা। ভবিষ্যতে সুযোগ পেলে চিকিৎসক হয়ে আশাকে মানবসেবা করারও পরামর্শ দেন তিনি।

আশাকে নিয়ে এমন সংবাদ তুলে ধরার জন্য ঢাকাটাইমসের সাংবাদিক ফরহাদ খানসহ কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানান অবসরপ্রাপ্ত এই সেনা কর্মকর্তা।

এদিকে আশা বলেন, আমার সাফল্যে পিতৃতুল্য ইকবাল চাচা এগিয়ে এসেছেন। তার প্রতি কৃতজ্ঞ। আমি বড় হয়ে দেশের জন্য কিছু করতে চাই। এ সময় আশা ছাড়াও তার মা জোবেদা বেগম, বড় বোন সামিয়া জামান, দুলাভাই কামাল হোসেন ও ছোট ভাই সৌরভ হোসেনের খোঁজখবর নেন সৈয়দ হাসান ইকবাল। পরে তুলারামপুর আদর্শ মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় মিলনায়তনে শিক্ষকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন হাসান ইকবাল।

জানা গেছে, শিশুকাল থেকেই বাবার আদর-স্নেহ বঞ্চিত আশা খাতুন। নেই নিজেদের ভিটেমাটিও। তাই ঠাঁই হয়েছে মামাবাড়ি নড়াইলের চাঁচড়া গ্রামে। তবুও জীবনযুদ্ধে হেরে যাননি আশা। সবার মুখ উজ্জ্বল করে চারিদিকে ছড়িয়ে দিয়েছে আশার আলো। তুলারামপুর আদর্শ মাধ্যমিক বালিকা থেকে একমাত্র আশা খাতুনই এ বছর জিপিএ-৫ পেয়েছেন। চাঁচড়া গ্রামে ছোট্ট একটি ভাঙ্গা ঘরে আশা, তার মা ও ছোট ভাইয়ের বসবাস। পাটকাঠি ও কাঠের বেড়ার ঘরে টিনের চালা। তবে, টিনের চালার বেশির ভাগ ভাঙ্গাডেরা ও অসংখ্য ছিদ্রযুক্ত হওয়ায় রোদ এবং বৃষ্টি তাদের নিত্যসঙ্গী।

আশাদের ঘরে নেই বিদ্যুতের আলোও। তাই বেশির ভাগ দিনে পড়ালেখা করেছেন আশা খাতুন। এক্ষেত্রে প্রতিদিন দুই থেকে তিন ঘণ্টা পড়ালেখা করেছের তিনি। আর পড়ার ফাঁকে নবম শ্রেণির চার শিক্ষার্থীকে টিউশনি করিয়ে পেতেন মাত্র ৮০০ টাকা মাসিক সম্মানী। এ টাকা দিয়েই নিজের পড়ালেখার খরচ চালিয়ে নিয়েছেন। পদার্থ ও রসায়ন ছাড়া কখনো প্রাইভেট পড়ার সৌভাগ্য হয়নি তার। মূল বইয়ের পাশাপাশি বিদ্যালয় থেকে সহায়ক বই, খাতা-কলম ও স্কুলড্রেস পেয়েছেন আশা।  

আশার মা জোবেদা বেগম জানান, তার স্বামীর বাড়ি কুমিল্লা জেলায়। আশার বয়স যখন তিন বছর, তখন তার বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। মানসিক যন্ত্রণা ও নির্যাতনের কারণে কুমিল্লা থেকে বাবার বাড়ি নড়াইলের চাঁচড়া গ্রামে চলে আসেন তিনি। বাবার বাড়িতে ভিটেমাটি ছাড়া তেমন কিছু না থাকায় নেমে পড়েন জীবনযুদ্ধ। কাঠোর পরিশ্রম করেও সন্তানদের মুখে দুবেলা দুমুঠো খাবার জোটাতে অনেক বেগ পেতে হয় জোবেদা বেগমকে। তবুও সন্তানদের পড়ালেখা শিখিয়ে মানুষের মতো মানুষ করার নিরন্তর চেষ্টা তার। প্রায় দুই বছর আগে বড় মেয়ে সামিয়া জামানকে শরীয়তপুরের জাজিরা এলাকায় বিয়ে দিলেও পড়ালেখা থেমে থাকেনি। সামিয়া এ বছর নড়াইল সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে বাংলা বিষয়ে অনার্স শেষবর্ষের পরীক্ষা দিয়েছেন।

এদিকে, আশার পাশাপাশি ছোট ভাই সৌরভ হোসেন পড়ছে স্থানীয় দারুল উলুম আলিম মাদ্রাসায় সপ্তম শ্রেণিতে। পড়ালেখার পাশাপাশি সৌরভও বিভিন্ন কাজ করে। বড় মেয়ে সামিয়া জামান বলেন, বাবা মারা গেছেন; না জীবিত আছেন তা আর জানা হয়নি।

প্রতিবেশীরা জানায়, মামাবাড়ির ভিটায় জরাজীর্ণ টিনের খুপড়ি ঘর ছাড়া কিছু নেই আশাদের। তাদের রান্নার কাজটিও করতে হয় উঠোনের একপ্রান্তে খোলা জায়গায়। আশার দুই মামার আলাদা সংসার। আর নানা থাকেন এক খালার সঙ্গে।

(ঢাকাটাইমস/১৬মে/প্রতিনিধি/এলএ)