কোন পথে বনানীকাণ্ড?

প্রকাশ | ২২ মে ২০১৭, ১৫:৪০

মাসুদ কামাল

বনানীর ধর্ষণ মামলার সব আসামি ধরা পড়েছে। মামলা হওয়ার পর থেকে গত প্রায় দু সপ্তাহ ধরে সাধারণ মানুষের মূল উদ্বেগ ছিল আসামিদের ধরা পড়া না পড়া নিয়ে। মানুষের সেই উদ্বেগ প্রকাশিত হয়েছে তাদের কথাবার্তায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেগুলোতে। মানুষের আগ্রহের কারণেই হয়তো মিডিয়াগুলোও এ নিয়ে বেশ সক্রিয় থেকেছে। এ সময়ে মিডিয়ার ভূমিকা নিয়ে নানাজনকে বিচিত্র রকম মন্তব্য করতেও দেখেছি। মিডিয়া নাকি বাড়াবাড়ি করছে। ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণ হওয়ার আগেই এই যে লেখালেখি, তাতে নাকি মিডিয়া ট্রায়াল হয়ে যাচ্ছে। নিরপরাধেরও সাজা হয়ে যাচ্ছে। ধর্ষণ করে থাকলে সাফাত করেছে, কিন্তু সাজা কেন তার পিতা দিলদার আহমেদকে ভোগ করতে হচ্ছে? কেন তার ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান আপন জুয়েলার্সকে ঝামেলায় পড়তে হচ্ছে? এই রকম আরও অনেক কথা।

কারও কারও প্রশ্ন আবার আরও গভীরে। বলছেন, ধর্ষণ কি গত কয়েক মাসে এই একটাই হয়েছে? সারা দেশে প্রতিনিয়ত গ্রামেগঞ্জে কত ধর্ষণ হচ্ছে। কই, সেগুলো নিয়ে তো মিডিয়ার এত হইচই হতে দেখি না। প্রবাসী এক নারী সেদিন আমাকে এক লেখার মাধ্যমে বললেন, বনানীর এই দুই ছাত্রী তবুও তো তাদের পাশে মিডিয়াকে পেয়েছে, কিন্তু দুই হালিমা কি পেল? দুই হালিমা বলতে তিনি গাজীপুরের হযরত আলীর বিধবা স্ত্রী এবং ময়মনসিংহের ধর্ষিতা পুলিশ কনস্টেবল হালিমার কথা বলেছেন। শিশুকন্যাকে নির্যাতনের বিচার না পেয়ে হযরত আলী তার মেয়েকে নিয়েই ট্রেনের নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছেন। হালিমা বেঁচে থেকেও বিচারহীনতার প্রতীক হিসাবে রাষ্ট্রকে কষাঘাত করে চলেছেন।
আর ময়মনসিংহের হালিমার বিষয়টি আরও বিস্ময়কর। ধর্ষণের বিচারহীনতার জন্য প্রথমেই যে পুলিশকে দায়ী করা আমাদের এক রকম অভ্যাসে পরিণত হয়েছে, হালিমা কিন্তু সেই পুলিশ বাহিনীরই একজন সদস্য ছিলেন। তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, এক এসআই তাকে ধর্ষণ করেছে। ধর্ষিত হওয়ার পর অভিযোগ নিয়ে হালিমা গিয়েছিলেন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে। বিষয়টি এভাবেই মিডিয়াকে জানিয়েছে হালিমার পিতা। জানিয়েছেন তিনি হালিমার ডায়রির ওপর ভিত্তি করেই। ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছ থেকে কোনো সুবিচার না পেয়ে আত্মহত্যা করেছে হালিমা। আত্মহত্যার জন্য বেছে নিয়েছে সবচেয়ে কষ্টকর পদ্ধতিটি, আগুন দিয়েছে নিজের গায়ে। ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এখন অবশ্য বলছেন উল্টো কথা। বলছেন-হালিমা নয় বরং ওই এসআই-ই তার কাছে এসে অভিযোগ করেছিল হালিমার বিরুদ্ধে। জানিয়েছিল হালিমা নাকি তাকে ব্ল্যাকমেইল করছে। মানে উল্টে যাচ্ছে পুরো দৃশ্যপটই। ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে এমন কথা অভিযুক্ত এসআই বলতেই পারে, নিজের দায় এড়ানোর জন্য আগেভাগেই উল্টো কথা বলার নজির অনেকই আছে। কিন্তু তাতেই কি দৃশ্যপট পাল্টে যাবে? আর নিজের জীবন দিয়ে প্রতিবাদ করা হালিমার বক্তব্যের কোনোই মূল্য থাকবে না? অভিযুক্ত এসআই অবশ্য গ্রেপ্তার হয়েছে। কিন্তু গ্রেপ্তারই কি ন্যায় বিচার নিশ্চিত করে?
এই কথাটাই এই সময়-এর গত সংখ্যায় বলেছিলাম। গ্রেপ্তারই কিন্তু বিচার নিশ্চিত করে না। আইনের অনেক মারপ্যাঁচ আছে। বিচারপদ্ধতিতে জামিন বলে একটা বিষয় আছে। ধনীরা জামিন পেয়ে যায় সহজেই। জামিন লাভটি অনেক ক্ষেত্রেই নির্ভর করে বড় আইনজীবী ধরতে পারার উপর। আর বড় আইনজীবীরা তো বলতে গেলে ধনী মানুষের ইয়ার দোস্ত। একবার যদি জামিনে বের হয়ে আসতে পারে এই নঈম, সাফাতরা, তাহলে অভিযোগকারী দুই তরুণীর জীবন কি আরও দুর্বিষহ হয়ে উঠবে না? এই দুষ্ট বালকেরা কি আরও বেশি দুর্বিনীত আচরণ করবে না? ধরা পড়ার পর এরা পুলিশ বিচারকের কাছে জবানবন্দি দিয়েছে। তা থেকে যতটুকু মিডিয়াতে এসেছে, তারা নাকি পুরো ঘটনাটিই স্বীকার করেছে।

সাফাতের একটা বক্তব্য বেশ অবাক করা, সে নাকি বুঝতেই পারছে নাÑ যে কা- সে করেছে তাতে অপরাধটা কোথায়?(!) তবে এই বিস্ময় অনেকটাই কমে গেছে দু’দিনের ব্যবধানে একটা জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সাফাতের পিতা দিলদার আহমেদের সাক্ষাৎকারে। সেখানে তিনি পুত্রের অপকর্মকে ‘আকাম’ বলে অভিহিত করেছেন এবং বলেছেন এই বয়সে একটু আকটু ‘আকাম’ করাই যায়। তিনি নিজেও নাকি এই বয়সেও এমন ‘আকাম’ করে থাকেন। অর্থাৎ এই ধর্ষণকা-কে কোনো অপরাধ বলেই মনে করেন না সাফাতের পিতা। পিতার যদি এই মনোভাব হয়, যদি এই শিক্ষা হয়, তাহলে পুত্র কিভাবে উপলব্ধি করতে পারবে ধর্ষণে অপরাধ কোথায়? দেশে মনে হয় এখন এমন একটা শ্রেণি বিরাজ করছে যাদের কাছে ধর্ষণ কোনোই অপরাধ নয়, বাচ্চাদের খেলনা ভেঙে ফেলার মত দুষ্টুমি মাত্র! কিন্তু রাষ্ট্র কি তাই মনে করে? যদি না করে, তাহলে ওই শ্রেণিটির কি কোনো অধিকার আছে এই সমাজে অবাধে চলাফেরা করার? ওরা তো বিপজ্জনক। কেবল সাফাতই নয়, ওর বাপকেও খাঁচায় আটকে রাখা দরকার। এই মনোভাবাপন্ন আরও যেসব পিতা-পুত্র রয়েছে, তাদেরকেও আটকে রাখা জরুরি।

শুরুতে বলছিলাম সাধারণ মানুষের উদ্বেগ আর মিডিয়ার আচরণ নিয়ে। এই উদ্বেগ হয়তো অমূলক, কিন্তু অপ্রয়োজনীয় নয়। অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, সাধারণ মানুষের কথাবার্তা যতদিন চলবে, ততদিনই স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর জন্য কঠিন হবে বিষয়টিকে ধামাচাপা দেওয়া। এই একটা নিয়ে মেতে থাকার অর্থ কিন্তু এমন নয় যে, অন্য ঘটনাগুলোকে উপেক্ষা করা, কিংবা অন্য অপকর্মগুলোর মাত্রাকে অবমূল্যায়িত করা। বরং এটা যেহেতু সামনে চলে এসেছে, এখানে যেহেতু ওই বিপজ্জনক শ্রেণিটি জড়িত, তাই এটিরই একটা দৃষ্টান্তমূলক সাজা হওয়া দরকার। এই সাজা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত সামাজিক চাপ অব্যাহত রাখা দরকার। এই সাজাটি যদি হতে পারে, সেটা অন্য সবার জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হিসাবে বিরাজ করবে।

তবে এরই মধ্যে ওই শ্রেণিটির মধ্যে কিছু নাড়াচাড়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দিন কয়েক আগে একটি টেলিভিশন টক শোতে স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের এক নেতার সঙ্গে আমার কিছুটা বাহাস হয়েছিল। তিনি বারবার বলার চেষ্টা করছিলেন, ‘সাফাত ধর্ষণ মামলায় অভিযুক্ত হওয়ার কারণে তার বাবার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে শুল্ক গোয়েন্দা সংস্থা অভিযান চালিয়েছে। এতে পুরো স্বর্ণ ব্যবসায়ের মধ্যে একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এ রকমটি হওয়া উচিত নয়। অভিযোগ প্রমাণ হওয়ার আগেই মিডিয়া ট্রায়াল হয়ে যাচ্ছে।’ ভদ্রলোকের সঙ্গে আমি দ্বিমত পোষণ করেছিলাম। আমি বুঝতে পারছিলাম না, সাফাতের কারণে পুরো স্বর্ণ ব্যবসায় কিভাবে নেতিবাচক প্রভাব পড়লো? আপন জুয়েলার্সের ব্যবসায়ে যে কিছু ক্ষতি হয়েছে, সেটা ঠিক। ঘটনাটি প্রকাশের পর মানুষের মধ্যে কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব তো পড়তেই পারে। আর তার উপর দিলদার আহমেদ যখন বেহায়ার মতো পুত্রের সাফাই গান, তখন সেই নেতিবাচক প্রভাবের ব্যাপ্তিও বাড়তে পারে। এটা নিয়ে দুঃখ করার কি আছে? এটা তো দিলদার-সাফাত জুটি অর্জন করেছে। নিজেদের চরিত্র দিয়ে অর্জন করেছে। কিন্তু ওই পিতা-পুত্রের দুঃখে যখন পুরো স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা কাতর হয়ে ধর্মঘটে যাওয়ার মতো সিদ্ধান্ত নেয়, তখন তাদের চরিত্র নিয়েও প্রশ্ন দেখা দেয়। বোঝা যায়, তারাও বুঝি দিলদার-সাফাতের মতো ধর্ষণকা-কে নিছকই শিশুসুলভ ‘আকাম’ মনে করেন, তারাও বোধকরি ওই অস্বাভাবিক শ্রেণিটির প্রতিনিধি হতে পারে আত্মতৃপ্তি অনুভব করেন।

তবে ধর্মঘটটি বেশি সময় টিকে থাকেনি, মাত্র তিন ঘণ্টাতেই ফাঁপানো বেলুনের বাতাস বের হয়ে গেছে। ওই তিন ঘণ্টায় ফেসবুকে আমি বেশ ইন্টারেস্টিং কিছু স্ট্যাটাস দেখেছি। এই প্রথম একটা ধর্মঘট নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগের পরিবর্তে সন্তোষ দেখা গেছে। একজন এমনও বলেছেন, এই ধর্মঘট যাতে প্রত্যাহার করা না হয়, সেজন্য তিনি ধর্মঘট আহ্বান করতে চান! সন্দেহ নেই, এগুলো নিছকই ফান। কিন্তু ফান হলেও ফুলে ফেঁপে ওঠা বিকৃত ওই শ্রেণিটির প্রতি সাধারণ মানুষের মনোভাব যে এতে ঠিকই প্রকাশিত হয়েছে, সেটাও মানতে হবে। হয়তো বিষয়টি বুঝতে পেরে তড়িঘড়ি করে তারা ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নিয়েছে। হয়তো এভাবে দেশের সংক্ষিপ্ততম ধর্মঘটের সঙ্গে তারা তাদের নামটি যুক্ত করতে পেরেছে।

অনেকে বলতে পারেন, স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা তো ধর্মঘট ডেকেছে সাফাত কিংবা দিলদারের জন্য নয়। অন্য একটি জুয়েলার্সে যখন সরকারের শুল্ক বিভাগের লোকেরা অভিযান চালিয়েছে, তখনই তারা ধর্মঘটে গেছে। আমি কিছুতেই বুঝি না, শুল্ক বিভাগের লোকেরা কি জুয়েলার্সগুলোতে অভিযান চালাতে পারবে না? এটা তো তাদের নিয়মিত কাজের মধ্যেই পড়ে। বরং নিয়মিত তারা এ কাজটি কেন করতো না, সেটা নিয়েই প্রশ্ন তোলা যায়। দেশে সোনা চোরাচালানের সঙ্গে স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের কোনোই সম্পর্ক নেই এমন কথা কি হলফ করে বলা যায়? এর মধ্যে বিভিন্ন মিডিয়াতে দেখেছি, সাফাত নাকি প্রকাশ্যেই বলতো যে, তার বাবা দেশের এক নম্বর স্মাগলার। এক নম্বর যদি উনি হন, অন্যরা হয়তো দুই, তিন বা চার-পাঁচে থাকবেন। পার্থক্যটা নম্বরে, চরিত্রে নয়। সে কারণে আমাদের দাবি থাকবে দেশের লাগামহীন স্বর্ণ ব্যবসায়কে একটা নীতিমালার মধ্যে আনা হোক। কেউ যেন দম্ভ করে নিজের নম্বরটি কত কম সেটা বলতে না পারে, সে ব্যবস্থা করা হোক।

বনানীর ওই ধর্ষণকা-ে বিচার শেষ পর্যন্ত কতটুকু কি হবে, সেটা হয়তো সময়ে জানা যাবে। তবে এই মুহূর্তে ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট নানা গ্রুপের চেহারা প্রতিদিনই একটু একটু করে স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন গ্রুপ তাদের মতো করে নাড়াচাড়া করছে। কেউ সরাসরি, কেউবা একটু পরোক্ষভাবে। তবে বোঝা যাচ্ছে তাদের অস্বস্তিটা। কেউ ধর্ষকদের বাঁচাতে চাইছে, কেউবা নিজেদের। সুবিধা যেটা হচ্ছে, মানুষ চিনে যাচ্ছে চেহারাগুলো। দিন যত যেতে থাকবে, চেহারাগুলো আরও হয়তো স্পষ্ট হতে থাকবে। মানুষ বুঝে যাবে কে তার শত্রুপক্ষ, কে মিত্রপক্ষ।

মাসুদ কামাল: লেখক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক