কে কে আপন

প্রকাশ | ২৪ মে ২০১৭, ০৮:২৬ | আপডেট: ২৪ মে ২০১৭, ১৫:৫৩

অনলাইন ডেস্ক

খনি নেই। স্বর্ণ বলতে আমদানিই আমাদের একমাত্র ভরসা। বৈধ প্রক্রিয়া আছে। তবুও অবৈধ পথে আসছে স্বর্ণ। বিমানবন্দরে প্রায়ই ধরা পড়ছে চোরাই চালান। সম্প্রতি আপন জুয়েলার্সে অভিযান চালিয়েছে শুল্ক গোয়েন্দারা। অন্যদের খবর কী?

লিখেছেন হাবিবুল্লাহ ফাহাদ ও আশিক আহমেদ

‘সোনা সোনা সোনা
লোকে বলে সোনা
সোনা নয় তত খাঁটি...’

খাঁটি হোক আর নাই হোক- সোনাতেই আগ্রহ সবার। নারীকে সাজাতে স্বর্ণের বিকল্প কী হয়? স্বর্ণালঙ্কার দিয়ে রমণীকে খুশি করতে না পারলে ক্ষতি নেই; যদি প্রেয়সীর রূপের তুলনা হয় সোনার সঙ্গেÑ তবেই তুষ্ট। বিখ্যাত মনীষী ব্রেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন বলতেন, ভোরের মুখে নাকি সোনার রং থাকে। পাকা ফসলের মাঠের তুলনা চলে সোনার সঙ্গে। দেখে চাষি বলে, সোনা ফলেছে মাঠে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও কম যাননি। ‘ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই- ছোটো সে তরী/ আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।’

‘সোনার ধানে’ রবীন্দ্রনাথের ছোটো তরী ভরে গিয়েছিল। শেষে তাকে নেয়ার মতো জায়গা ছিল না তরীতে। সোনার ধানই বিপাকে ফেলেছিল তাকে। কবির ফসলগুলো আদতে সোনার ছিল না। পাকা ফসলকে তুলনা করেছিলেন সোনার সঙ্গে। কিন্তু দেশের স্বর্ণালঙ্কার ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ এ যাত্রা কিছুটা হলেও বিপাকে পড়েছেন। তাদের ‘অবৈধ’ স্বর্ণই বিপদ ডেকে এনেছে। বাকিরা আছে দুশ্চিন্তায়।

ভ্যাট-ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে প্রতিনিয়তই বিদেশ থেকে আসছে স্বর্ণ। ধরাও পড়ছে চোরাই চালান। তবুও থেমে নেই। এদিকে শুল্ক গোয়েন্দার কবলে যাচ্ছে কোটি কোটি টাকার মূল্যবান এই ধাতু। অন্যদিকে আসছে নতুন চালান। শুল্ক গোয়েন্দা সূত্র বলছে, গত চার বছরের কম সময়ে অবৈধভাবে আসা সোনা আটক হয়েছে একটনের বেশি! তারপরও কেন অবৈধ পথে স্বর্ণ আনা থামানো যাচ্ছে না? জবাবে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মইনুল খান বললেন, ‘এখানে অনেক বিষয় আছে, একটা হচ্ছে ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়া। আরেকটি হচ্ছে তার যে অবৈধ অর্থ আছে তা যেন প্রকাশিত না হয়। লোকে জেনে না ফেলে। বৈধভাবে আমদানি করলে ব্যাংকের মাধ্যমে তাকে টাকা দিতে হবে। তিনি কত টাকার মালিক সে বিষয়টি রেকর্ডে থেকে যায়।’

স্বর্ণালঙ্কার ব্যবসায়ীরা অবশ্য দায়ী করলেন সোনা আমদানির প্রক্রিয়াকে। বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির সভাপতি গঙ্গা চরণ মালাকার বলেন, ‘এলসি (ঋণপত্র) খুলে সোনা আমদানির প্রক্রিয়া সহজ না, খুবই জটিল। সময় লাগে অনেক। দামও বেশি পড়ে যায়।’ তিনি বলেন, ‘গত ২০ বছর ধরে আমরা এই প্রক্রিয়াটি সহজ করার জন্য দাবি করে আসছি। কাজ হচ্ছে না। আপনি পাশের দেশ ভারতের দিকে তাকান। তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনুমোদিত এজেন্টের মাধ্যমে সোনা বিক্রি করে। আমাদের এ রকম একটি ব্যবস্থা করলে ক্ষতি কী? স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের ভালোমন্দ সরকার দেখবেন না। আমরা তো বছরের পর বছর সরকারকে কোটি কোটি টাকা ভ্যাট-ট্যাক্স দিচ্ছি।’

শুধুই কি ভ্যাট-ট্যাক্স ফাঁকির জন্য অবৈধভাবে সোনা আসছে দেশে? শুল্ক গোয়েন্দার মহাপরিচালক এই প্রশ্নেরও জবাব দিলেন। বললেন, ‘অনেকেই আন্ডারওয়ার্ল্ডে ব্যবসা করেন। অবৈধ ব্যবসা। যেগুলো বেশিরভাগ হচ্ছে ক্রাইম রিলেটেড। ড্রাগ, নারী পাচার, অস্ত্র পাচারÑ এগুলোর সঙ্গে গোল্ড মিশে যাচ্ছে। গোল্ডের মাধ্যমে লেনদেন হচ্ছে।’

স্বর্ণ চোরাচালানের এই কারবার দীর্ঘদিন ধরে চলছে। মাঠপর্যায়ে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ঢাকায় যারা স্বর্ণালঙ্কার বিকিকিনি করছেন তাদের কারো কাছেই স্বর্ণের বৈধ কোনো কাগজপত্র নেই। কেনার সময়ও তারা কাগজপত্র নিচ্ছেন না। যে কারণে বিক্রির সময় ক্রেতাকেও বৈধ কাগজ দেখাতে পারছেন না। দেশের নামকরা অনেক জুয়েলারি বিক্রয়কেন্দ্রেরও একই হাল। মাঠ পর্যায়ের তথ্য বলছে, ঢাকার মধ্যে পুরান ঢাকার তাঁতীবাজারে প্রতিদিন প্রায় দেড় থেকে দুই হাজার ভরি সোনা কেনাবেচা হয়। টাকার হিসাবে লেনদেন আট কোটি টাকার কাছাকাছি। বড় অঙ্কের এই কেনাবেচার কোনো পর্যায়েই সঠিক কাগজপত্র পাওয়া যায় না। এই জোগান আসে পুরনো অলঙ্কার গলিয়ে। কিংবা ব্যাগেজ রুলসে। এসব মাধ্যমে যতটুকু না পাওয়া যায় তার বেশি আসে অবৈধ পথে।

স্বর্ণ নিয়ে সম্প্রতি মাতামাতির একটা শক্তপোক্ত কারণ আছে। গত ২৮ মার্চ ঢাকার বনানীর হোটেল রেইনট্রিতে বিশ^বিদ্যালয়ের দুই ছাত্রী ধর্ষিত হয়। এ ঘটনায় মামলা হয় এক মাসেরও বেশি সময় পর ৬ মে। প্রথমে বনানী থানা পুলিশ মামলাটি নিতে চায়নি। পরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিষয়টি ছড়িয়ে পড়লে পুলিশ মামলা নেয়। মামলার প্রধান আসামি আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদ সেলিমের বড় ছেলে সাফাত আহমেদ। জন্মদিনের পার্টির কথা বলে ২৮ মার্চ রাতে ওই শিক্ষার্থীদের ডেকে নিয়ে সাফাত ও তার বন্ধুরা এ কা- ঘটায় বলে অভিযোগ আছে। আসামিদের মধ্যে বাকি দুজন সাফাতের বন্ধু নাঈম আশরাফ এবং সাদমান সাফিক। দুজন দেহরক্ষী ও গাড়ি চালকও আছেন এই তালিকায়। সাফাত আহমেদকে মামলায় আসামি করার পর আলোচনায় আসে আপন জুয়েলার্স। প্রতিষ্ঠানটির মালিক দিলদার আহমেদের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ ওঠে। সাফাত, দিলদার আহমেদ ও আপন জুয়েলার্সের নামে থাকা ব্যাংক হিসাবের তথ্য চেয়ে সব ব্যাংকে ১৪ মে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

অভিযোগের ভিত্তিতে শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তারা প্রতিষ্ঠানটির পাঁচটি বিক্রয়কেন্দ্রে অভিযান চালিয়ে প্রায় ১২ মণ ৩৫ কেজি স্বর্ণ জব্দ করে। হীরা জব্দ করা হয় ৬১ গ্রাম। অভিযান পরিচালনাকালে এসব স্বর্ণের অনুকূলে বৈধ কাগজপত্র দেখাতে পারেনি আপন জুয়েলার্স কর্তৃপক্ষ। গোয়েন্দা সূত্র বলছে, এসব স্বর্ণ অবৈধ পথে আনা হয়েছে। ট্যাক্স-ভ্যাট ফাঁকি দেয়া হয়েছে। মালিক দিলদার আহমেদকে ডেকে নিয়ে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে শুল্ক গোয়েন্দা কর্তৃপক্ষ। দিলদার আহমেদ দাবি করেছেন, এসব অবৈধ সম্পদ নয়। তবে কাগজপত্র দেখাতে পারেননি। এজন্য ১৫ দিন সময় নিয়েছেন তিনি। বিশিষ্ট এই স্বর্ণ ব্যবসায়ীর দাবি, তার স্বর্ণ যদি অবৈধ হয় তবে কারো স্বর্ণই বৈধ নয়।

দিলদার আহমেদের এই দাবি ভিন্ন কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। তার মানে দেশের স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা কি বেশির ভাগই অবৈধ পথে স্বর্ণ আমদানি করেন? আপন জুয়েলার্সের মতো অনেক নামকরা জুয়েলারি প্রতিষ্ঠান আছে। তারাও বেশ দাপটের সঙ্গেই এই খাতে টিকে আছেন। প্রতিদিনই কোটি কোটি টাকার স্বর্ণ কেনাবেচা করছেন। স্বর্ণের পাশাপাশি হীরাও বিক্রি করছে এসব প্রতিষ্ঠান। অথচ গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, বৈধপথে মাত্র হাতেগোনা কয়েকজন ব্যবসায়ী হীরা আমদানি করেন। অথচ বিক্রি করেন সবাই।

আপন জুয়েলার্সের মতো যদি অন্যরাও একইভাবে ব্যবসা পরিচালনা করে থাকেন, তাহলে অন্য জুয়েলারি প্রতিষ্ঠানগুলোতেও কি শুল্ক গোয়েন্দারা অভিযান চালাবে? জবাবে শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মইনুল খান এই সময়কে বলেন, ‘কোথাও কোনো ঢালাওভাবে অভিযান করা হবে না। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তথ্য যাচাই বাছাই করে তদন্ত সাপেক্ষে যদি মনে হয় কারো কাছে চোরাচালানের স্বর্ণ আছে তবে সেখানে অভিযান পরিচালনা করা হবে। অহেতুক কাউকে হয়রানি করা হবে না।’

জুয়েলার্স সমিতির তথ্য মতে, ওই সমিতির সদস্য সংখ্যা প্রায় ৭০০। এর বাইরে সারা দেশে জুয়েলার্স আছে দশ হাজারের মতো। ব্যবসায়ীদের সিটি করপোরেশন বা পৌরসভা থেকে ট্রেড লাইসেন্স এবং জেলা প্রশাসন কার্যালয় থেকে ডিলিং লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসা করার বিধান আছে। এর বাইরে বিক্রিতে ৫ শতাংশ মূসক দিতে হয় সরকারকে।

সোনা-হীরা আমদানির বৈধ উপায় কী

দেশে সোনা কিংবা হীরা আমদানির বৈধ উপায় আছে। অথচ ট্যাক্স-ভ্যাট বেশি দিতে হয় বলে এই পথে আগ্রহ কম ব্যবসায়ীদের। যে কারণে অবৈধ পথে মূল্যবান এই ধাতু দেশে আসছে। সরকার কোটি কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে। শুল্ক গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নিয়ে এলসি (ঋণপত্র) খুলে যে কেউ স্বর্ণ আমদানি করতে পারে। প্রতি ভরি স্বর্ণের জন্য তিন হাজার টাকা ভ্যাট-ট্যাক্স দিতে হয়। তবে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের ব্যাগেজ রুলস বলছে, বিদেশ থেকে একজন যাত্রী ১০০ গ্রাম (৮.৫৭ ভরি) পর্যন্ত স্বর্ণালঙ্কার আনতে পারবেন। এ জন্য তাকে শুল্ক দিতে হবে না। আর সোনার বার আনতে পারবেন ২৩৪ গ্রাম। প্রতি ১১.৬৬৪ গ্রামে (এক ভরি) ৩ হাজার টাকা শুল্ক দিতে হবে। তবে এই স্বর্ণ আনতে হবে নিজের বা আত্মীয়স্বজনের ব্যবহারের জন্য। ব্যবসায়ীদের বেলায় দুটি আলাদা এইচএস কোডে প্রতি ১১.৬৬৪ গ্রাম স্বর্ণের জন্য ৩ হাজার টাকা এবং ৪ শতাংশ অগ্রিম ব্যবসায় মূসক দিতে হবে। স্বর্ণের মতোই বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নিয়ে ঋণপত্র খুলে হীরাও আমদানি করা যায়। হাতব্যাগে করেও আনা যায়। তবে বৈধ পন্থায় স্বর্ণ বা হীরা আমদানির চেয়ে চোরাচালানেই বেশি আগ্রহ ব্যবসায়ীদের। অধিক মুনাফার জন্য তাদের এই কৌশল।

সোনা চোরাচালান মামলায় সাজা

বিমানবন্দরে সোনার চোরাই চালান ধরার পর এ ঘটনায় মামলা করা হয়। এ পর্যন্ত কতগুলো মামলা হয়েছে তা বলা না গেলেও শতাধিক ব্যক্তি চোরাচালানের ঘটনায় গ্রেপ্তার হয়েছে। শুল্ক গোয়েন্দা সূত্র জানায়, এই পর্যন্ত শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তর ১১শ কেজি চোরাচালানে আসা স্বর্ণ উদ্ধার করেছে। শুল্ক আইনে মামলা হলে ওই স্বর্ণ বাজেয়াপ্ত হবে। ফৌজদারি আদালতে বিচার হলে সাত বছরের জেল এবং বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা হলে ১২ থেকে ১৪ বছরের সাজা হতে পারে।

চার বছরে আটক এক টন স্বর্ণ

গত চার বছরেরও কম সময়ে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর উদ্ধার করেছে এক টনেরও বেশি স্বর্ণ। এসব স্বর্ণের দাম ৫২০ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। উদ্ধার করা এসব স্বর্ণ বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা করা হয়। আর মামলা নিষ্পত্তির পর স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের কাছে নিলামে বিক্রি করে থাকেন, যা এই দেশের মানুষই ব্যবহার করে থাকে। তবে গত চার বছরে উদ্ধার হওয়া স্বর্ণের মধ্যে কী পরিমাণ স্বর্ণ নিলামে বিক্রি করা হয়েছে, কী পরিমাণ স্বর্ণ এখনও বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা আছে, সে তথ্য নেই শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তরের কাছে। অধিদপ্তরের সূত্রমতে, ২০১৩ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ৪৬ মাসে সারা দেশে এক হাজার ১০১.৯১ কেজি স্বর্ণ উদ্ধার করেছে তাদের দল। এর মধ্যে ২০১৩ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত উদ্ধার করা হয় ৫৬৫.৭১ কেজি, যার দাম ২৫৫ কোটি ৮২ লাখ টাকা। ২০১৪ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত উদ্ধার করা হয় ৩৬৩.৭৮২ কেজি স্বর্ণ, যার দাম ১৮১ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। ২০১৫ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ৬৭.২১ কেজি স্বর্ণ উদ্ধার করে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর যার দাম ৩০ কোটি এক লাখ টাকা।

শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের হিসাব মতে, ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশ থেকে উদ্ধার করা হয় ১৫১.৫৪ কেজি স্বর্ণ যার দাম ৬৭ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত উদ্ধার করা স্বর্ণের পরিমাণ ৬৪১.৯০৮ কেজি যার দাম ৩০১ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত উদ্ধার করা স্বর্ণের পরিমাণ ২০৩.৫৪ কেজি যার দাম ৯৮ কোটি এক লাখ টাকা। ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত উদ্ধার করা স্বর্ণের পরিমাণ ৬৯.২৪ কেজি যার দাম ৩৪ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত উদ্ধারকৃত স্বর্ণের পরিমাণ ৮৫.৯৮ কেজি যার দাম ১৯ কোটি এক লাখ টাকা।

আটক হওয়া স্বর্ণ যায় কোথায়?

শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেন, শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর বিভিন্ন বিমানবন্দর থেকে স্বর্ণ আটক করে। ওই স্বর্ণ ঢাকা কাস্টমস হাউজের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে একটি জিআরও নম্বরের মাধ্যমে জমা দেওয়া হয়। ঢাকা কাস্টমস হাউজ উদ্ধারকৃত ওই স্বর্ণের নিষ্পত্তি করে বাংলাদেশ ব্যাংকে। উদ্ধারকৃত স্বর্ণের মালিকানা দাবি করে কেউ যদি ওই স্বর্ণ নির্ধারিত শুল্ক পরিশোধ করে তাহলে তারা তা নিয়ে যেতে পারে। তবে কেউ যদি দাবি না করে তখন বাংলাদেশ ব্যাংক ওই স্বর্ণ নিলাম করে। এরপর বাংলাদেশ জুয়েলারি ব্যবসায়ী সমিতির সদস্যরা তখন ওই স্বর্ণ নিলামে কিনে বিক্রি করে। আর নিলামে বিক্রি করা ওই টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেওয়া হয়।

জানতে চাইলে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মইনুল খান বলেন, ‘আমরা স্বর্ণ উদ্ধার করে ঢাকা কাস্টমস হাউজের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দেই। এরপর ওই স্বর্ণ বাংলাদেশ ব্যাংক নিলামে বিক্রি করে থাকে। তবে কী পরিমাণ স্বর্ণ নিলাম করা হয়, সে হিসাব আমাদের কাছে নেই। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এই হিসাব আমাদের কাছে আসে না।’

আপন জুয়েলার্সের ১৩ মণ সোনার কী হবে

দুই দিনে আপন জুয়েলার্সে অভিযান চালিয়ে শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা প্রায় ১২ মণ ৩৫ কেজি স্বর্ণ জব্দ করেছে। এর মধ্যে গত ১৪ মে আপন জুয়েলার্সের পাঁচটি শাখার চারটি থেকে ২৮৬ কেজি স্বর্ণালঙ্কার এবং ৬১ গ্রাম হীরা জব্দ করা হয়। পরদিন ১৫ মে গুলশানে আপন জুয়েলার্সের প্রধান শাখায় অভিযান চালিয়ে ২১২ কেজি স্বর্ণ জব্দ করা হয়। জব্দ করা এসব স্বর্ণের কী গতি হবে জানতে চাইলে শুল্ক গোয়েন্দার মহাপরিচালক বলেন, ‘আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এটি নিষ্পত্তি করা হবে। আমরা প্রতিষ্ঠানের মালিক দিলদার আহমেদকে ন্যায় বিচারের জন্য সুযোগ দিচ্ছি। সময় দিচ্ছি। তাকে বারবার বলা হচ্ছে। তিনি বলছেন, তার বৈধ স্বর্ণ। তবে কাগজপত্র দেখাতে পারছেন না। তারপরও বলছে আমাকে কয়েকদিন সময় দিন আমরা তাকে ২৩ মে আসতে বলেছি। তখন তার বক্তব্য শোনার পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

যা বলছেন দিলদার

গত ১৭ মে শুল্ক গোয়েন্দা কার্যালয়ে গিয়েছিলেন আপন জুয়েলার্সের অন্যতম মালিক দিলদার আহমেদ। সেখান থেকে বেরিয়ে এসে তিনি বলেন, ‘অধিদপ্তরের দল আমার কাছ থেকে যে স্বর্ণ আটক করেছেন তা সবই বৈধ। আমার স্বর্ণ যদি অবৈধ হয় তাহলে বাংলাদেশের সব ব্যবসায়ীরটাই অবৈধ।’ গত পাঁচ বছর ধরে কোনো স্বর্ণের আমদানি হয়নি বলেও স্বীকার করেন দিলদার। তিনি দাবি করেন, যেসব অলঙ্কার বানানো হয়, সেগুলো সব পুরনো স্বর্ণ পুনরায় ব্যবহার করেই করা হয়। তিনি বলেন, ‘আমি যেভাবে ব্যবসা করি, সারা বাংলাদেশও একইভাবে ব্যবসা করে। তাই আপন জুয়েলার্স যদি বন্ধ করা হয় তাহলে সারা দেশের জুয়েলার্সও বন্ধ করতে হবে।’

বর্ণ ব্যবসার উৎসে যে অস্বচ্ছতা আছে স্বীকার করেন কি না এমন প্রশ্নের জবাবে দিলদার বলেন, ‘আমি বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির সেক্রেটারি ছিলাম। তখন অনেকবার বলা হয়েছিল ব্যবসায়ীদের একটা নীতিমালা করার জন্য। কিন্তু আমরা সেটা করতে পারিনি। একটা ব্যবসায় নীতিমালা থাকা উচিত। কারণ এখানে কিন্তু জবাবদিহিতার একটা প্রশ্ন থাকে।’

চোরাচালান ঠেকানোর উপায় কী

সোনা চোরাচালান পুরোপুরি ঠেকানোর উপায় বলতে পারছেন না কেউই। এটি করতে হলে বিমানবন্দর দিয়ে আসা-যাওয়া করা প্রত্যেকটি যাত্রীকে ধরে ধরে তল্লাশি করতে হবে। এটি সহজ কাজ নয়। শুল্ক গোয়েন্দা প্রধান মইনুল খান বললেন, ‘শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে স্বর্ণ চোরাচালান বন্ধ করা যাবে না। এটা শোভনও হবে না। কারণ সব যাত্রীকে তো আর তল্লাশি করতে পারব না। যে কারণে এত নজরদারির মধ্যেও চালান বের হয়ে যাচ্ছে। তবে আমরা যেসব তথ্য পাই সেই তথ্য গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে থাকি। তদন্ত করি। অতীতে অনেক কাজ করেছি। অনেক অভিযান পরিচালনা করেছি। মণকে মণ স্বর্ণও উদ্ধার করেছি।’

স্বর্ণ ব্যবসা খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্বর্ণ আমদানি প্রক্রিয়াটিকে ঢেলে সাজানোর সময় এসেছে। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বসে আলোচনা করলে একটা উপায় বেরিয়ে আসবে। ব্যবসায়ীরাও অবৈধ পথে আগ্রহী হবে না। অপরদিকে রাষ্ট্র রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হবে না। বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির সভাপতি গঙ্গা চরণ মালাকার বলেন, ‘স্বর্ণ চোরাচালানের মূলে কী আছে সেটি খুঁজে বের করতে হবে। স্বচ্ছ প্রক্রিয়া থাকলে কেউ তো আর অবৈধ পথ বেছে নেবে না।’