শিক্ষকের জাল সনদে ভর্তি, অনিশ্চিত ২০ শিক্ষাজীবন

প্রকাশ | ২৪ মে ২০১৭, ০৮:৪০

ইমতিয়াজ উল ইসলাম, ঢাকাটাইমস

তারা ২০ জন প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় (পিইসি) পাস করতে পারেনি। কিন্তু জনপ্রতি ২০০ টাকার বিনিময়ে প্রশংসাপত্র দিয়ে তাদের ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তির সুযোগ করে দেন বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক ছুরত আলী। শিক্ষকের এই অসাধুতায় এখন জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষার নিবন্ধন করতে গিয়ে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে তাদের শিক্ষাজীবন।

ঢাকার ধামরাইয়ের নান্নার ইউনিয়নে রঘুনাথপুর-২ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে সনদ জালিয়াতির এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে ঢাকাটাইমসের অনুসন্ধানে।

জানা গেছে, ২০১৪ সালে রঘুনাথপুর-২ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ২৯ জন পরীক্ষার্থী পিইসি পরীক্ষায় অংশ নেয়। এর মধ্যে ২০ জন অকৃতকার্য হয়। কিন্তু বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক ছুরত আলী প্রত্যেকের কাছ থেকে ২০০ টাকা নিয়ে প্রশংসাপত্র দিয়ে তাদের এলোকেশী উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি করিয়ে দেন।

অভিযোগ রয়েছে, ইন্টারনেটের মাধ্যমে ফলাফল দেখে তারা অকৃতকার্য হয়েছে এমন তথ্য শিক্ষার্থীরা শিক্ষক ছুরত আলীকে জানালেও তিনি তাতে গা করেননি। এরপর অনেকবার শিক্ষার্থীরা মূল সনদের জন্য শিক্ষককে চাপ দিলে তিনি তাদের হাতে জাল সনদ ধরিয়ে দেন।

ইতিমধ্যে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণি শেষ করে অষ্টম শ্রেণিতে উঠেছে ওই ২০ শিক্ষার্থী। তিন বছরের মাথায়  এখন জেএসসি পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার জন্য নিবন্ধন করতে গিয়ে সনদ জালিয়াতির বিষয়টি বেরিয়ে আসে।

ধামরাই উপজেলা শিক্ষা অফিস থেকে সংগৃহীত ২০১৪ সালে রঘুনাথপুর-২ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ফলাফলের শিট যাচাই করে সনদ জালিয়াতির বিষয়টির সত্যতা মেলে।

ওই ফলাফল শিটে দেখা যায়, আদিত্য বিশ্বাস বিজয় (রোল-৭৬৮৭), আক্কাস আলী (রোল-৭৬৮৮), ইয়াছিন মিয়া (রোল-৭৬৮৭৯), মহাদেব শীল (রোল-৭৬৯৬), শাকিব খান (রোল-৭৬৯৭), স্বপনা রানী (রোল-৭৬৯৮), শিলা রানী (রোল-৭৬৯৯), বিথী রানী সরকার (রোল-৭৭০০), আসমা আক্তার (রোল-৭৭০১), নিপা রানী (রোল-৭৭০২), সাহিদা আক্তার (রোল-৭৭০৩), আশা রানী (রোল-৭৭০৪), মুক্তা আক্তার (রোল-৭৭০৫), সায়লা আক্তার (রোল-৭৭০৬), জয়ন্তি রানী বি: (রোল-৭৭০৭), শাহনাজ আক্তার (রোল-৭৭০৮), সোমা আক্তার (রোল-৭৭০৯), লিজা আক্তার (রোল-৭৭১০), সারমিন আক্তার (রোল-৭৭১১) ও নাসরিন আক্তার ডালিমন (রোল-৭৭১২) এক বা একাধিক বিষয়ে অকৃতকার্য হয়েছে।

আর কৃতকার্য হয়েছে মাসুদ রানা, ইস্পাহান হোসেন, আল-আমিন, সজিব মিয়া, রবিউল হোসেন, নিলয় ইসলাম, মাহমুদ আলী, জাহাঙ্গীর আলম ও জহিরুল ইসলাম।

অকৃতকার্য শিক্ষার্থীরা ঢাকাটাইমসকে জানায়, তারা পাস করতে পারেনি ইন্টারনেটের মাধ্যমে জানতে পেরে তারা প্রধান শিক্ষক ছুরত আলীকে জানালে তিনি বলেন- ‘তোরা পাস করছস। তোগো ইসকুলে ভর্তি করায় দিলেই তো হইলো।’ পরে তাদের ২০০ টাকার বিনিময়ে প্রশংসাপত্র দিয়ে এলোকেশী উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয়।

ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা জানায়, এখন তাদের জেএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। শিক্ষকের অনৈতিক কাজের কারণে তারা কেন শাস্তি পাবে।

ওই শিক্ষার্থীরা আরো জানায়, বাবা-মা তাদের পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে চাইছেন।

এসব শিক্ষার্থীর অক্ষরজ্ঞানহীন অনেক অভিভাবক অভিযোগ করেন, প্রধান শিক্ষক ছুরত আলী কখনোই শিক্ষার্থীদের ক্লাসে পড়াতেন না। নির্দিষ্ট সময়ে স্কুলেও আসেন না তিনি। আর প্রায় সময় তিনি সহকারী শিক্ষিকা স্ত্রী মরিয়ম বেগমের সঙ্গে সাংসারিক বিষয় নিয়ে শিক্ষার্থীদের সামনে অকথ্য ভাষায় ঝগড়া করতেন।

অভিভাবকরা আরো জানান, তাদের সন্তানরা অকৃতকার্য হওয়ার পরও কেন ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি করানো হয়েছে জানতে চাইলে ছুরত আলী বরাবর এড়িয়ে গেছেন। সর্বশেষ জাল সনদের ফটোকপি দেন তিনি।  ক্ষমতাশালী হওয়ায় তার বিরুদ্ধে স্কুল কমিটির কাছে অভিযোগ করেও কোনো ফল মেলেনি।

ছুরত আলীর এমন অনিয়মের ব্যাপারে ম্যানেজিং কমিটির সহ-সভাপতি আনছার আলী ও সদস্য সাইজ উদ্দিন ঢাকাটাইমসকে বলেন, ২০১৪ সালে শিক্ষক ছুরত আলী তার মনগড়া আত্মীয়দের নিয়ে ম্যানিজিং কমিটি তৈরি করেন। আর তাই ওই সময় কেউ কোনো অভিযোগ করার সুযোগ পায়নি।

তবে সব অভিযোগ অস্বীকার করেন শিক্ষক ছুরত আলী। তিনি বলেন, ২০১৪ সালে আমার স্কুল থেকে ২৫ জন শিক্ষার্থী পিইসি পরীক্ষায় অংশ নেয়। এর মধ্যে ২২ জন কৃতকার্য ও মাত্র তিনজন অকৃতকার্য হয়।

সনদ জালিয়াতির ব্যাপারে ধামরাই উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা কাজী রাশেদ মামুন ঢাকাটাইমসকে বলেন, অভিযুক্ত শিক্ষক ছুরত আলীর বিরুদ্ধে সনদ জালিয়াতির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রতারণার প্রমাণ মিলেছে। তিনি কোমলমতি শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়েছেন। তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

একই সঙ্গে তিনি এ ব্যাপারে অভিভাবকদের অসচেতনতার কথা উল্লেখ করেন। শিক্ষা কর্মকর্তা বলেন, ‘তারা সচেতন থাকলে শিক্ষার্থীদের তিনটি বছর নষ্ট হয়ে যেত না।’

(ঢাকাটাইমস/২৪মে/মোআ)