আপনি চিকিৎসক, আপনারও ভুল হতে পারে

প্রকাশ | ২৫ মে ২০১৭, ১২:৩৮ | আপডেট: ২৫ মে ২০১৭, ১৩:১০

আফরিন জাহান

বেশ কিছুদিন ধরেই ভাবছিলাম বিষয়টি নিয়ে লিখব আবার ভাবি চিকিৎসকরাতো মানুষের বন্ধু। অসুস্থকে দিনের পর দিন চিকিৎসা দিয়ে বাঁচিয়ে তুলেন তাহলে তাদের নিয়ে তো ভালো কিছুই লেখা উচিত। আবার ভাবি সব চিকিৎসকই কি অসুস্থদের সঙ্গে এই বন্ধুসুলভ আচরণ করেন? এখানেই মূলত খটকা লাগে যখন দেখি বড় ভাই ঢাকাটাইমস সম্পাদক আরিফুর রহমান দোলন কিংবা বড় আপু বিবার্তার সম্পাদক বানি ইয়াসমিন হাসি দেশের পাঁচ তারকা হাসপাতালেই ভুল চিকিৎসার শিকার হন অথবা খোদ আমার ঘরেরই কেউ যখন ভুল চিকিৎসার প্রকোপে ভুগতে থাকে দিনের পর দিন। তখন কি মনে এই প্রশ্ন জাগাটা স্বাভাবিক নয়?

ভুল চিকিৎসার এই আমলনামার শুরু করি পরিবার থেকেই। বছরে দুয়েক আগে হঠাৎ করেই আমার ভাগ্নির তলপেটে প্রচন্ড ব্যথা শুরু হলে মিরপুরের এক মোটামুটি মানের হাসপাতালে গেলে তারা বলেন রোগির অবস্থা ভালো নয়, তার সিস্ট অনেক বড় হয়ে গেছে দ্রুত অস্ত্রোপচার করতে হবে। আমার বোন এই অস্ত্রোপচারের পক্ষে ছিলেন না বলে পান্থপথের একটি বড় বেসরকারি মেডিকেল কলেজে হাসপাতালে মেয়েকে পাঠালেন।সঙ্গে কেবল আমার ভাগ্নি জামাই। আমি দৌঁড়ে সেই হাসপাতালে গিয়ে ভাগ্নিকে ভর্তি করে অফিস অ্যাসাইনমেন্টে চলে যাই। কিছুক্ষন বাদে ভাগ্নি জামাইকে ফোন দিলে শুনতে পাই আমার ভাগ্নির অপারেশন চলছে। আমি কারন জানতে চাইলে ও জানাল চিকিৎসক বলেছে, রোগির কন্ডিশন খুব খারাপ এখনই অপারেশন করতে হবে। আমাদেরতো চিকিৎসকেই ভরসা তাই ভাবলাম এত বড় হাসপাতালের চিকিৎসক নিশ্চয়ই খারাপ কিছু হবে না। তাদের উপরে ভরসা করাই যায়।

কিন্তু বিপত্তি ঘটল অপারেশনের দ্বিতীয় দিন। সন্ধ্যা থেকে আবারো সেই প্রচন্ড ব্যাথা। আমি দৌড়ে ডিউটি ডক্টরকে ডেকে নিয়ে আসি তিনি আবার ভাগ্নির চিকিৎসককে ফোন দেন। ফোনে ফোনেই চলে চিকিৎসা। কি চিকিৎসা? বারবার শুধু রোগিকে এন্টাসিড খাওয়ানো হচ্ছে। কখনো অ্যান্টাসিড সিরাপ কখনো ট্যাবলেট আবার কখনো ইনজেকশন। চিকিৎসকরা ভাবতে পারেন বারবার যে অ্যান্টাসিড দিচ্ছে আমি একজন নন মেডিকেল মানুষ হয়ে বুঝলাম কিভাবে? কারন ঔষুধটা যে আমরাই কিনে এনেছি আর দেখছি ডিউটি ডাক্তার সেই চিকিৎসাই দিচ্ছেন। সারারাত আমার ভাগ্নির আর্তচিৎকারে আমরা দুচোখ এক করতে পারিনি। আমি বার বার ডিউটি ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করি যিনি ওর চিকিৎসক আই মিন অপারেশন করেছেন তিনি কোথায়? ওরা শুধু বলছেন আসবে।

এভাবে চলল পরদিন দুপুর পর্য্ন্ত কিন্তু ঐ চিকিৎসকের খবর নেই। হঠাৎ আমার রোগির নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে দ্রুত তাকে আইসিউতে স্থানান্তর করা হল। আমি বললাম আইসিইউতে কেন? বলল এমনিই। সেখানে থাকলে ভালো থাকবে। ঐ আইসিইউর ইনচার্জ্ আবার দেশের বড় একিটি সরকারি হাসপাতালের আইসিইউ-এর ইনচার্জ্। মানে তিনি ডাবল/ ট্রিপল জব করেন।আমি হঠাৎ আইসিইতে গিয়ে আমার ভাগ্নিকে দেখলাম নিথর পড়ে আছে। ওর পুরো শরীর ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। ভয়ে ভয়ে ডিউটিরত জুনিয়র এক ডাক্তারকে ওর প্রেজেন্ট কন্ডিশন জানতে চাওয়াতে বলল, আল্লাহ আল্লাহ করেন। রোগির যে অবস্থা তাতে আমাদের হাতে কিছুই নেই। ততক্ষনেও কিন্তু ওর চিকিৎসকের খবর নাই।

এবার আমি হাসপাতাল থেকে ওই চিকিৎসককে ফোন দিয়ে তার অবস্থান জানতে চাইলে তিনি বললেন এইতো আমি রাস্তায়, আসছি। আমি ওনাকে বললাম কাল থেকে আপনার রোগির অবস্থা ক্রিটিক্যাল আজ প্রায় বিকেল হতে চলল আর আপনি এখনো আসছেন? ফোনে কেবল বারবার অ্যান্টাসিড দিচ্ছেন? আসেন আপনি হাসপাতপালে আমি আপনাকে এবার অ্যান্টাসিড খাওয়াব দেখি আপনি কত অ্যান্টাসিড খেতে পারেন। ভয়ে ওই ডাক্তার ফোন রেখে দিল। বিশ্বাস করেন তখন আমার কেবল মনে হচ্ছিল ভেঙ্গেচূড়ে ফেলি এই হাসপাতাল, ভেঙ্গে ফেলি এই চিকিৎসা ব্যবস্থা। শুধু মাত্র এই কারনে আমি মনে করছিনা সেন্ট্রাল হাসপাতালে ভাঙচূর করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ভুল করেছে। তবে ভুল তারা করেছে চিকিৎকের গায়ে হাত তুলে। আমার ভাগ্নির যে ভুল চিকিৎসা হয়েছে সেটা বলেছেন আমার এক বড়ভাই যিনি নিজেও একটি বড় সরকারি মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক। কি সমস্যা হয়েছিল সেটা লিখতে গেলে অনেক লিখতে হবে শুধু বলতে পারি ওর অ্যানেসথেসিয়ার পরিমান সঠিকভাবে দেয়া হয়নি। এখন ভাবুনতো এত নামকরা একজন অ্যানেসথেসিওলজিস্ট যিনি একটি বড় সরকারি মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক তার ভুল হতে পারে? পারে কারন মানুষ মাত্রইতো ভুল হয়। কিন্তু চিকৎসকতো আর বলবেনা সে ভুল করেছে।

আমি আমার সেই বড় ভাইকে বললাম আপনি মন্তব্য দেন আমি নিউজ করব যাতে অন্য কেউ এর ভুক্তভোগি না হয়। তিনি বললেন, দেখেন আমি সামনে বিএমএ (বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন) ইলেকশন করবো আমাকে প্লিজ এর মধ্যে নিয়েন না এতে আমার ভোটার কমে যাবে। অবশেষে আমাদের হুমকি এবং চিৎকার চেচামেচিতে চিকিৎসক ওর প্রতি আরো কেয়ারিং হলেন। আল্লাহর মহান ইচ্ছায় সে বেঁচে ফিরল কিন্তু পুরো সুস্থ হয়ে নয়। পরে শুনলাম আমার ভাগ্নির যে চিকিৎসক তিনি ওই হাসপাতালের চিফ মেডিকেল অফিসারের দ্বিতীয় স্ত্রী তাই তিনি ধরাকে সরা জ্ঞান করেন না।

আমাদের দেশের পাঁচ তারকা যে হাসপাতালগুলো আছে সেগুলোতে যে সবসময় সঠিক চিকিৎসা হয় তাও বলা যাবে না। যদি হতই তাহলে ঢাকাটাইমস সম্পাদককে ভুল চিকিৎসার শিকার হয়ে ভাঙ্গা পা নিয়ে সিংগাপুরে যেতে হত না। সিংগাপুরে না গেলে হয়তো বুঝতেই পারতেন না যে দিনের পর দিন তিনি ভুল চিকিৎসার শিকার হয়েছেন। এখনতো দোলন ভাই দিব্যি দুপায়ে চষে বেড়াচ্ছেন ফরিদপুরের রাজপথ।আবার বেসরকারি একটি টিভি চ্যানেলের এক বড় ভাই গলার ব্যথা নিয়ে গেলেন একটি পাঁচ তারকা হাসপাতালে। তাকে বলা হল আপনার থ্রোট ক্যান্সার এ সম্তাহের মধ্যেই অপারেশন করতে হবে। উনি দ্বিতীয় ওপিনিয়ন হিসেবে গেলেন দেশের বিখ্যাত এক ইএনটি স্পেশালিস্টের কাছে। তিনিও এই কথা বললেন, দ্রুত অপারেশন করতে হবে। যেহেতু টিভি সাংবাদিক গলার গুরুত্ব অনুধাবন করে বাসায় মিথ্যে বলে (পরিবার শুনলে কান্নাকাটি করবে) ছুটে গেলেন ভারতের চেন্নাই অ্যাপোলোতে। তারা পরীক্ষা নিরিক্ষা করে অবাক। আরে আপনারতো কিছুই হয়নি।ক্যান্সার হয়েছে কে বলল? উনি মেডিকেল বোর্ডের জন্য রিকোয়েস্ট করলেন। সেই বোর্ডেও ওনাকে রাখা হল। উনি আমাদের দেশের সেই পাঁচ তারকা হাসপাতালের নাম বলতেই সেই মেডিকেল বোর্ড্ থেকেই ফোন করা হল। এখানে ওনারা গাইগুই করলেন আর কিছু না। এবার ওই সাংবাদিক ভাবলেন দেশের এত বড় হাসপাতাল আর এত বড় ইএনটি স্পেশালিস্ট বলার পরেও কোন সমস্যা নেই! কিভাবে সম্ভব? উনি এবার কলকাতার অ্যাপোলোতে এসে আবার দেখালেন। নাতো; ওনার কোন সমস্যাই নাই। এবার ওই সাংবাদিকের গা দিয়ে যেন ঘাম ঝরল এবং দেশে স্ত্রী সন্তানকে ফোন দিলেন আর সব খুলে বললেন। তিনি এখন বীরদর্পে কাজ করছেন।

এত গেল মূদ্রার ওপিঠ আবার মূদ্রার এপিঠও আছে। আমি যখন ম্যাটারনিটি টাইমে জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে হাসপাতালে পৌঁছালাম তখন চিকিৎসকরাই কিন্তু অক্লান্ত পরিশ্রম করে আমাকে বাঁচিয়ে তুলেছেন।আমি আজীবন এই চিকিৎকদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকব। পরিচিত ভাই বন্ধু চিকিৎসক যারা আছেন যে কোন সমস্যায় ফোন দিলেই তারা এগিয়ে এসেছেন। চিকিৎসকদের বুঝতে হবে সব সাংবাদিকই হলুদ সাংবাদিক নয় আবার ভালো চিকিৎসকের পাশাপাশি দেশে অপচিকিৎসাও আছে। হলুদ সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে সাংবাদিকরাই বেশি লিখেন।কিন্তু তারপরেও যত দোষ নন্দ ঘোষের মত সব দোষ যেন সাংবাদিকদের। এটা কিছু চিকিৎসকদের ভাষ্য। যেমন সেদিন অধ্যাপক ডাঃ এবিএম আব্দুল্লাহর জন্য যখন চিকিৎসকরা প্রতিবাদ সভা করছেন তখন আমার এক সাংবাদিক বন্ধু গেলেন তাদের ইন্টারভিউ নিতে। সঙ্গে সঙ্গে এক ডাক্তার বললেন আপনারা যান এখান থেকে। সব সাংবাদিকই হলুদ সাংবাদিক। একজন দায়িত্ববান চিকিৎসকের মন্তব্য কি এমন হওয়া উচিত? ডাক্তার আব্দুল্লাহ যে নির্দোষ এটা কিন্তু সাংবাদিকেরাই প্রমাণ করেছে সুতরাং তাদের প্রতি আস্থা রাখুন আর হলুদ সাংবাদিকতার পাশাপাশি অপচিকিৎসার বিরুদ্ধে লিখুন এবং রুখে দাঁড়ান তবেই না আপনি একজন সুচিকিৎসক, একজন বিবেকবান মানুষ।

আবার ফিরে আসি আমার ভাগ্নির কাছে। সিস্ট অপারেশনের পর দীর্ঘ্ দুই বছর ও কখনোই ভালো ছিলনা। মাসের কুড়ি দিনই ওকে হয় ডাক্তারের চেম্বারে নয়ত হাসপাতালের বেডে কাটাতে হয়েছে। এখানকার নামী সব গাইনোকলজিস্টরা বললেন ওর মা হবার সম্ভাবনা নাই বললেই চলে। মাস চারেক আগে ওকে চেন্নাই অ্যপোলোতে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হল আর এখন ও দেড় মাসের অন্তঃসত্বা।

আফরিন জাহান: সাংবাদিক গবেষক