চট্টগ্রামে তিন লাখ মানুষ পানিবন্দী, দুর্ভোগ চরমে

প্রকাশ | ০৩ জুন ২০১৭, ১৬:৪২ | আপডেট: ০৩ জুন ২০১৭, ১৬:৪৪

চট্টগ্রাম ব্যুরো, ঢাকাটাইমস

চট্টগ্রাম মহানগরের আগ্রাবাদ ও হালিশহর এলাকার প্রায় তিন লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। নর্দমার দূষিত পানি, ডাস্টবিনের আবর্জনা, মশার উৎপাত, বিদ্যুতের যাওয়া-আসা সবমিলে চরম দুর্দশায় দিন কাটছে পানিবন্দী এসব মানুষের।

ঘূর্ণিঝড় মোরার প্রভাবে টানা বর্ষণে আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকা, মধ্যম ও উত্তর মধ্যম হালিশহরের একাংশ, গোসাইলডাঙ্গা ওয়ার্ডের বেপারিপাড়া, হাজিপাড়া, কুসুমবাগ আবাসিক, বন্দর কলোনি ও ছোটপুল এলাকাসহ আশপাশের এলাকাগুলো পানিতে সয়লাব চার দিন ধরে। এসব এলাকায় জমে থাকা হাঁটু পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে বাসিন্দাদের আসবাবপত্র, কাপড়, টিভি-ফ্রিজসহ প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি। বৃষ্টি থামলেও পানিবন্দী অবস্থার কারণে হুমকির মুখে পড়েছে এসব এলাকার জনজীবন।

পানিবন্দী স্থানীয়রা জানান, মহেশখালের বাঁধের কারণে প্রায় সময় বর্ষার পানি জমে থাকলেও এবারের মতো তা এতো দীর্ঘস্থায়ী ছিল না। পানিবন্দী অবস্থার অন্যতম কারণ আবর্জনায় মহেশখাল ভরাট, অপর্যাপ্ত পানি নিষ্কাষণ ব্যবস্থা, জনসচেতনতার অভাব এবং অপরিকল্পিত নগরায়ণকেই মনে করছেন এলাকাবাসী।

সরেজমিনে আগ্রাবাদ সিডিএ এলাকা পরিদর্শনে দেখা যায়, প্রধান সড়ক ও আশপাশের এলাকা পানি আর নর্দমার আবর্জনায় একাকার। এক নম্বর রোড থেকে গোটা সিডিএ আবাসিক এলাকা হাঁটু পানিতে থইথই করছে। মসজিদ, ফ্ল্যাট, কলোনি আর অফিসের চারদিকে যতদূর চোখ যায় শুধু পানি আর পানি।

গত চার দিন ধরেই আগ্রাবাদ সিডিএ এলাকার এই দশা। আগ্রাবাদ এক্সেস রোডের দিকেও পানি। বেপারীপাড়ায় আগে মাঝে মাঝে জোয়ার-ভাটার সঙ্গে পানি আসতো আর নেমে যেতো। কিন্তু এখন সারাক্ষণ পানিবন্দী লোকজন। অন্যদিকে, গোটা মহেশখাল এখন আবর্জনা আর কচুরিপানায় ভরপুর। পর্যাপ্ত পানি আসা-যাওয়ার ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। যে কারণে এমন পানিবন্দী দশা গোটা আগ্রাবাদ ও আশপাশের এলাকাজুড়ে।

দীর্ঘদিন ধরে বসবাসরত আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক ৫ নম্বর রোডের স্থায়ী বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম খান বলেন, ২০১৫ সালে বন্দর স্টেডিয়ামের পাশে মহেশখালের ওপর নির্মিত বাঁধটি কিছু কিছু এলাকায় সুফল বয়ে আনলেও এখন সুবিধার চেয়ে অসুবিধাই বেশি। যে কারণে গত চারদিন ধরে পানিবন্দী আমরা। এই বিতর্কিত বাঁধটি অপসারণের সিদ্ধান্ত হলেও এতে সমস্যার সমাধান হবে না বলে মন্তব্য করেন সাইফুল ইসলাম খান।

তিনি আরও বলেন, মহেশখালের দিকে একনজর তাকালে বোঝা যায়, কখনো ড্রেজিং করা হয়নি। গত ৩০ বছরেও আমার চোখে পড়েনি মহেশখালের ড্রেজিং কার্যক্রম। যদি দ্রুত পরিকল্পিতভাবে মহেশখাল ড্রেজিং করা না হয় তাহলে ধীরে ধীরে পানিবন্দী দশার বিস্তৃতি আরো বাড়বে চট্টগ্রামের এসব এলাকায়।

তার সঙ্গে একমত পোষণ করেন বৃহত্তর আগ্রাবাদ ও হালিশহর জলাবদ্ধতা নিরসন কমিটির যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল আলম সবুজ। তিনি বলেন, আগ্রাবাদের পানিবন্দী দশা এড়াতে প্রয়োজন দ্রুত মহেশখালের ড্রেজিং ও পর্যাপ্ত পানি নিষ্কাষণের ব্যবস্থা। পাহাড়ি ঢল, অতিবৃষ্টি বা জোয়ারের পানি এলাকায় বন্দিদশা সৃষ্টি না করে দ্রুত যাতে সরে যায় সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। অন্যথায়, বর্ষা মৌসুমে আরো করুণ অবস্থা হবে আগ্রাবাদ ও আশপাশের এলাকাজুড়ে।

পুরো আগ্রাবাদ এলাকায় অল্প বৃষ্টিতেও পানি উঠে যায় মন্তব্য করে শান্তিবাগ নিবাসী মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ জানান, কয়েকদিন ধরেই গৃহবন্দী জীবন কাটছে। মশার উপদ্রবের সঙ্গে বিদ্যুতের সমস্যাতো নিয়মিত লেগেই আছে। চারদিকে দূষিত পরিবেশের কারণে অসুস্থ হয়ে পড়ছে পরিবারের ছোট-বড় সবাই। এমন অবস্থা থাকলে দূর্বিষহ হয়ে পড়বে জনজীবন।

আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতালসহ আশপাশের এলাকা এখনো পানিতে ভাসছে। ঘূর্ণিঝড় মোরার প্রভাবে গত মঙ্গলবার রাতে শুরু হওয়া টানা বর্ষণে হাঁটু পানিতে তলিয়ে যায় শিশু হাসপাতাল। এতে দুর্ভোগ কমছে না রোগীদের উল্লেখ করে হাসপাতাল পরিচালনা কমিটির ভাইস-চেয়ারম্যান সৈয়দ মোরশেদ হোসেন বলেন, হাসপাতালের চারদিকে এখনো হাঁটুপানি। আশপাশের আগ্রাবাদ এলাকাজুড়ে পানিবন্দী দশার কারণে রোগের প্রকোপ যেমন বাড়ছে তেমনি হাসপাতালে আসতেও রোগীদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।

পানিবন্দী থাকলেও কর্মস্থলে যথাসময়ে আসা-যাওয়া করতে হচ্ছে জানিয়ে আগ্রাবাদের আখতারুজ্জামান সেন্টারের ব্যবসায়ী রিপন দাশ রকি জানান, আগ্রাবাদ এলাকায় গাড়ির পরিবর্তে এখন নৌকায় বা সাঁতার কেটে কর্মক্ষেত্রে যেতে হচ্ছে। কর্মচারীরা এভাবে আসলেও গ্রাহকদের অভাবে ব্যবসা বন্ধের উপক্রম এখন। তাই আসন্ন বর্ষা মৌসুম নিয়েও দুশ্চিন্তায় এই ব্যবসায়ী।

ছোটপুল এলাকার বাসিন্দা জোবায়ের আহমেদ আরিফ বলেন, কখনো এমন পানিবন্দী অবস্থায় থাকতে হয়নি। আগে জোয়ারের সময় এলাকায় পানি আসতো আর ভাটার সময় নেমে যেতো। কিন্তু এখন পানি কমছেই না। ছোটপুল এলাকায় নিচতলার বেশিরভাগ ঘরে এখনো অর্ধেক পানির নিচে। এই বন্দিদশা এড়াতে দ্রুত পরিকল্পিত উদ্যোগের প্রয়োজন। নয়তো বর্ষা মৌসুমে পানিতে ভাসবে গোটা আগ্রাবাদ।

উল্লেখ্য, আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকাসহ সন্নিহিত অঞ্চলকে জোয়ারের পানি থেকে রক্ষার লক্ষ্যে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে বন্দর স্টেডিয়ামের পাশে মহেলখালের ওপর নির্মাণ করা হয় এই বাঁধটি। বাঁধটি নির্মাণে দেড় কোটিরও বেশি টাকা ব্যয় করা হয় বন্দর তহবিল থেকে। গত ১ জুন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে বাঁধটি অপসারণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

মহেশখালের বাঁধ অপসারণ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া নগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি খোরশেদ আলম সুজন বলেন, মহেশখালের ওপর চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের দেয়া এ বাঁধ উজানের পাঁচ লাখ মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। এমনকি কেউ মারা গেলে অন্য এলাকায় নিয়ে গিয়ে দাফন করতে হচ্ছে। ঈদের জামাত পড়তে পারে না এলাকার মানুষ।

ঢাকাটাইমস/৩জুন/আইকে/এমআর