ফেসবুক পর্ব -২

প্রকাশ | ০৪ জুন ২০১৭, ১১:৪৭ | আপডেট: ০৪ জুন ২০১৭, ১১:৫৩

দিলরুবা শরমিন

যে ফেসবুকের প্রতি আমার এত ভক্তি, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা সেই ফেসবুক আসলে আমাকে কি দিচ্ছে? 

দিচ্ছে না কি??? অনলাইনে এলেই একঝাঁক নোটিফিকেশন, সদ্যজাত সংবাদ। অসাধারন সব মুখ ও মুখশ্রীর ছবি। দৃষ্টিনন্দন সাজসজ্জা, রসনার তৃপ্তি মেটাবার মত খাবার-দাবারের ছবি। আর কি চাই? কে কোথায় গেল, কি করলো সবই জানতে পারি। কি কিনতে হবে, কোথায় পাওয়া যাবে সবই আসে। ফেসবুকের দয়ায় বিশ্ব এখন হাতের মুঠোয়। কে কত দেশ বিদেশ ভ্রমণ করলো, কি কিনলো কি দেখলো তা আমরা সহজেই জানতে পারি। বন্ধু তো বন্ধু না? না জানলে বা না জানালে জানবো কেমন করে?

তবে আমার প্রাপ্তি মনেহয় অনেক বেশি। হয়তো অনেক দিন ধরে যাকে কিংবা যাদেরকে খুঁজছিলাম তাকে বা তাদের পেয়েছি। তাদের লেখা পেয়েছি, পেয়েছি অসাধারণ সব কবিতা। কিছু স্ট্যাটাস, কিছু রাজনৈতিক লেখা আর কিছু মজার মন্তব্য। সব মিলিয়ে ঢাকার রাস্তার যানজট ততটা আর ‘উপভোগ’ করি না।

মানুষ কখনো নিজেকে চেনে না কিন্তু ফেসবুক আমাদের সব কিছু চিনিয়ে ছাড়ে। এমন কি কারো কারো সুদৃশ্য ড্রয়িং রুম থেকে বেড রুম অবধি। আমি বরাবরই বন্ধু  বৎসল। হৈ-চৈ আড্ডাই আমার সারা জীবনের সঙ্গী। তাই বয়স ভেদে সকলেই আমার বন্ধু। প্রতিনিয়ত বন্ধুদের দেখার চেষ্টা করি, তাদের পোষ্ট পড়ার চেষ্টা করি, তাদের সঙ্গে ইনবক্সে কথা হয়, আলোচনা হয়। সবই বেশ ভালো। বাকীটা না হয় পরের লেখার জন্য তোলা থাক।

ফেসবুক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হিসাবে সবচেয়ে বেশি পরিচিত। কেউ কেউ দাবি করেন ফেসবুকে এই সংবাদটা পেয়েছিলাম বলেই আজ এটা করতে পেরেছি। এটা হয়েছে, ওটা হয়েছে। কি সংবাদ সেটা আর যাচাই-বাছাইয়ের দরকার হয় না। ফেসবুককেন্দ্রিক জীবনে আজ আমরা যতটুকু কোন সামাজিক অনুষ্ঠান উপভোগ করি তার চেয়ে বেশি ব্যস্ত থাকি সেলফি তোলাতে এবং সঙ্গে সঙ্গে পোষ্ট দিতে। আর এসব পোষ্ট কখনো কখনো ভাললাগার পাশাপাশি ভয়ংকর ঘটনারও জন্ম দিচ্ছে। বিব্রতকর পরিস্থিতিরও সৃষ্টি করছে। এই রকম নানান ব্যাথাতুর ও মাজাদার ঘটনা-কাহিনী শুনতেই থাকি। সেলফি তুলতে সাহায্য করায় কোম্পানিগুলো আবার ‘লাঠি’ও তৈরি করে দিয়েছে। তো চলছে এইভাবে, চলুক।

ফেসবুক নায়ক নায়িকাদের প্রচারের জায়গা দখল করে নিয়েছে। সেলিব্রেটিরা তো এখন সেলিব্রেটি হয়েই উঠছে ফেসবুকের দয়ায়। কে কাকে লাইক দিবে, কাকে লাইক দিয়ে কে ধন্য হবে বা কাকে লাইক দিলে কে আবার কি মনে করবে এসবও নাকি বিচার বিবেচনা করে চলতে হয়। মানে ফেসবুক আমাদের নিয়ন্ত্রকও বটে।  
কেউ কেউ আবার অটো লাইক সিস্টেম চালু করে বসে আছে। ফলে যেখানে লাইক দিলে ব্যক্তির পছন্দ নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে সেখানেও অটো লাইক চলে যায়।

ফেসবুক আবার অটোগার্ড! আরেকজনকে খুশি করতে এর জুড়ি নাই। তা হোক এতে যদি কারো মন একটু ভালো হয় তো ক্ষতি কি?

বাংলাদেশের মানুষের জীবনে বিনোদন বলতে আমরা আর কি বুঝি, কিবা পাই? কেবল কাজকর্ম করে দিনশেষে কেনাকাটা, খাওয়া-দাওয়া, বিয়ে, সন্তান জন্ম দেয়া এর বাইরে বিনোদন বলতে আমাদের মত নিম্নবিত্তের আর কি আছে? মধ্যবিত্ত কেনাকাটা ও বিনোদনের জন্য ছুটে যায় ভারত কিংবা ব্যাংককয়ে। উচ্চবিত্ত সকালে ইউরোপে ‘ব্রেকফাস্ট’ সেরেই ‘লাঞ্চের’ জন্য ছুটেন যুক্তরাষ্ট্রে। এসব খবরই পাই ফেসবুকে।

কেউ কেউ আবার ফেসবুকে ঢুঁ মারতে না পারলে অসুস্থ হয়ে পড়েন। কেউ আবার হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে গিয়েও ভুলে যান না ফেসবুকারদের। কারো কারো আবার সংসার ভাঙ্গা-গড়ার ইতিহাসও রচনা করে এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটি।  যাই ঘটুক সবই জানার মাধ্যম ফেসবুক।

আমি বারবারই এই মাধ্যমটার ইতিবাচক দিক খোঁজার চেষ্টা করি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ভাবে দিনে দিনে ফেসবুক তার রুপ-রস-গন্ধ হারাচ্ছে। ফেসবুক হয়ে গিয়েছে এখন একে অপরকে গালাগাল করার সরবশ্রেষ্ঠ স্থান। কাউকে নাস্তানাবুদ করতে চান? ফেসবুক আছে। কারো সাথে ঝগড়া করতে চান? তার জন্য ফেসবুকের চেয়ে সহজ জায়গা আর কোথায়? কাউকে বাজে কথা বলতে চান তো এটাই শ্রেষ্ঠ জায়গা।

নারীর পর্দা বাহিরে আর পুরুষের পর্দা অন্তরে এটাও ঠিক করে দেয় ফেসবুক বন্ধুরা। এই নিয়ে যে চরম বিতরক ওঠে সেটা শুনতে খারাপ লাগে না। কাকে কখন মুরতাদ ঘোষণা করা হবে বা কাকে কখন বাঁচাতে হবে তাও আজকাল ফেসবুকই নির্ধারণ করে দেয়। ভয় পাই রীতিমত। এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ধীরে ধীরে একে অপরের গীবত গাওয়ার, অন্যকে নানা ভাবে ছোট করার, প্রতিহিংসা, জিঘাংসা যা যা আছে সব কিছুর মাধ্যম হয়ে উঠছে। একমাত্র এই মাধ্যমই যেন সব শেষ মাধ্যম যেখানে, আমরা সব কিছু উজাড় করে বলতে, করতে পারি। যদি এর কোন অন্যথা ঘটে সাথে সাথে এই সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমকে হাতিয়ার করে ব্যক্তিকে হতে হয় নাজেহাল। 

আসলে এটা এক রকম নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সমাজের নিয়ন্ত্রক। বাহ, তবে আর সভ্যতার বিকাশের কি প্রয়োজন? ফেসবুকই সব নিয়ন্ত্রণ করুক!

সব কিছুই মেনে নিতে চেষ্টা করি, মানিয়ে নিতেও। কিন্তু সেটা কতক্ষণ সেটাই ব্যাপার? একজন রেপিষ্ট যখন পোষ্ট দেয় ‘ভরসা রাখুন আল্লাহর ওপর’; কিংবা একজন খুনী যখন ফেসবুকে লিখে ‘ভরসা রাখুন নৌকায়’, তখন ফেসবুক ব্যবহারকারীর আত্মপরিচয় জানতে ইচ্ছে করে। অথবা একজন মেয়েকে যখন একদল পুরুষ ফেসবুকেই ‘ভারবাল বা রিটেন রেপ’ করে তখন একটু হলেও থমকে যাই, ফেসবুক? যার বাংলা অনেকটা এমন হয় ‘মুখ ও হৃদয়’ বা ‘হৃদয় ও মুখ’? এই অশ্লীলতা এখানে লুকানো? সুযোগ পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে ইচ্ছে মত নিজেকে প্রকাশ করে!

(চলবে)

লেখক: আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী।