রাজধানীতে ‘মহামারির’ রূপ নিয়েছে চিকুনগুনিয়া

প্রকাশ | ০৮ জুন ২০১৭, ০৮:২২

নজরুল ইসলাম, ঢাকাটাইমস

বিদেশফেরত আবদুল হাকিম ঢাকায় তার বোনের বাসায় ওঠেন মাত্র দুই দিন থাকবেন বলে। তারপরই তিনি চলে যাবেন গ্রামের বাড়ি বরিশালে। এরই মধ্যে তিনি চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়েন। তিনি শমরিতা হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে এসে কাকে যেন মুঠোফোনে চিকুনগুনিয়া রোগের লক্ষণ ডাক্তারদের মতো করে বলছিলেন। কৌতূহলবশত বিষয়টি নিয়ে তার সাথে কথা বললে তিনি বলেন, ‘দেশের বাইরে থেকে এসেছি। এরই মধ্যে নতুন রোগ চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে বাড়িতে যেতে পারছি না। শরীরের গিঁটে গিঁটে ব্যথা, কিছুতেই দুর্বলতা কাটছে না। জ্বর সেরে গেলেও শরীরটা ভালো যাচ্ছে না।’

সম্প্রতি ঢাকায় চিকনগুনিয়া নামের ভাইরাসজনিত জ্বরের প্রকোপ দেখা যাচ্ছে। ক্রমেই এই ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এই রোগ মহামারি আকারে ছড়াচ্ছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। ‘চিকুনগুনিয়া’ শব্দটি ইতোমধ্যে এতটাই পরিচিতি লাভ করেছে যে, কারো স্বাভাবিক জ্বর হলেও অন্যরা রসিকতা করে বলে বসে তোমার চিকুনগুনিয়া হয়েছে নাকি!

রাজধানীর বেশ কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরে ডাক্তারদের সাথে কথা বলে জানা যায় প্রতিদিনই বাড়ছে চিকুনগুনিয়া রোগীর সংখ্যা। মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. এম এ মান্নান ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘প্রতিদিনই চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এইতো কয়দিন আগে এক পরিবারের কাজের মেয়ের চিকুনগুনিয়া হয়, এর কয়েকদিন পরেই দেখা যায় পুরো পরিবারের সবার চিকুনগুনিয়া হয়েছে। প্রতিদিনই আমার কাছে কম হলেও পাঁচজনের মতো চিকনগুনিয়া রোগী আসছে।’

চিকুনগুনিয়া কী

চিকিৎসকরা জানান, চিকুনগুনিয়া রোগটি ভাইরাসজনিত। অতি পরিচিত ডেঙ্গুর সঙ্গে এর অনেকটাই মিল রয়েছে। ডেঙ্গু জ্বরের মতোই এই ভাইরাসটি এডিস ইজিপ্টাই ও এডিস অ্যালবপ্টিকাস মশার কামড়ের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করে। চিকুনগুনিয়া মানবদেহ থেকে মশা এবং মশা থেকে মানবদেহে ছড়িয়ে থাকে। মানুষ ছাড়াও বানর, পাখি, তীক্ষ্ণ দন্ত প্রাণী যেমন ইঁদুরে এই ভাইরাসের জীবনচক্র বিদ্যমান।

লক্ষণ

চিকুনগুনিয়ার মূল উপসর্গ হলো জ্বর এবং অস্থিসন্ধির ব্যথা। শরীরের তাপমাত্রা অনেকটা বেড়ে প্রায়ই ১০৪ ডিগ্রি পর্যন্ত উঠে যায়, তবে কাঁপুনি বা ঘাম দেয় না। জ্বরের সঙ্গে সঙ্গে মাথাব্যথা, চোখ জ্বালা, গায়ে লাল লাল দানার মতো র‌্যাশ, অবসাদ, অনিদ্রা, বমি বমি ভাব ইত্যাদি দেখা দিতে পারে। শরীরের বিভিন্ন স্থানে, বিশেষ করে অস্থিসন্ধিতে তীব্র ব্যথা হয়, এমনকি ফুলেও যেতে পারে। তীব্র অবসাদ, পেশীতে ব্যথা, অস্থিসন্ধির ব্যথা ইত্যাদি জ্বর চলে যাওয়ার পরও কয়েক সপ্তাহ থাকতে পারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এমনকি মাসের পর মাসও অস্থিসন্ধিতে ব্যথা বা প্রদাহ থাকতে পারে; যা অনেক ক্ষেত্রেই রোগীকে স্বাভাবিক কাজ করতে অক্ষম করে তোলে। রোগী ব্যথায় এতই কাতর হন যে হাঁটতে কষ্ট হয়, সামনে বেঁকে হাঁটেন।

চিকিৎসা

অন্যান্য ভাইরাস জ্বরের মতো এই রোগের নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। এর চিকিৎসা মূলত রোগের উপসর্গগুলো নিরাময় করা। রোগীকে সম্পূর্ণ বিশ্রামে রাখতে হবে এবং প্রচুর পানি বা অন্যান্য তরল খেতে দিতে হবে। জ্বরের জন্য প্যারাসিটামলজাতীয় ওষুধই যথেষ্ট। এর সঙ্গে সঙ্গে পানি দিয়ে শরীর মুছিয়ে দিতে হবে। তীব্র ব্যথার জন্য অন্য ভালো ওষুধ প্রয়োজন হতে পারে। রোগীকে আবার যেন মশা না কামড়ায় এজন্য তাঁকে মশারির ভেতরে রাখাই ভালো। কারণ আক্রান্ত রোগীকে মশা কামড় দিয়ে কোনো সুস্থ লোককে সেই মশা কামড়ালে ওই ব্যক্তিও এই রোগে আক্রান্ত হবেন।

প্রতিরোধ

চিকিৎসকরা জানান, চিকুনগুনিয়া জ্বরের কোনো প্রতিষেধক নেই, কোনো ভ্যাকসিন বা টিকাও নেই। তাই রোগ থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হলো এডিস মশা প্রতিরোধ। এডিস মশার উৎপত্তি স্থল ধ্বংস করা এবং মশা নির্মূল করাই মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। বাসাবাড়ির আশপাশে যেখানে পানি জমে থাকতে পারে, তা সরিয়ে ফেলতে হবে এবং নিয়মিত পরিষ্কার রাখতে হবে। ডাবের খোসা, কোমল পানীয়ের ক্যান, ফুলের টব—এসব স্থানে যাতে পানি জমে না থাকে, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। দরজা-জানলায় নেট লাগানো, ঘুমানোর সময় মশারি ব্যবহার। জেনে রাখা ভালো, এডিস মশা মূলত দিনের বেলা এবং ঘরের বাইরেই বেশি কামড়ায়।

চিকুনগুনিয়া হলে কী খাবেন

ডাক্তারের ভাষ্যমতে, ডেঙ্গু বা চিকুনগুনিয়া হলে প্রচুর তরল পান করতে হয়, দিনে কমপক্ষে আড়াই লিটার। পানির পাশাপাশি লবণ ও খনিজ উপাদানসমৃদ্ধ তরল (যেমন: ডাবের পানি, ওরস্যালাইন, লেবু-লবণের শরবত, ফলের রস) পান করা উচিত। এতে করে রক্তচাপ হ্রাসের ঝুঁকি কমবে। তবে অতিমিষ্টি পানীয় বমির উদ্রেক করতে পারে। বাজারের কোমল পানীয় বা আইসক্রিম না খাওয়াই শ্রেয়।

অরুচি বা বমি ভাবের মধ্যে তেল-মসলাযুক্ত খাবার, ফাস্ট ফুড ইত্যাদি না খাওয়াই ভালো। খাবারের তালিকায় পর্যাপ্ত শর্করা যেমন: ভাত, জাউভাত, ওটমিল ইত্যাদি রাখুন। রাখুন প্রোটিনও, যেমন: দুধ, দই, মাছ বা মুরগির মাংস ও স্যুপ।

অনেক ডেঙ্গু বা চিকুনগুনিয়া রোগীর খেতে গেলেই বমি আসে। তারা হালকা শুকনো খাবার খেতে পারে। যেমন বিস্কুট, মুড়ি ইত্যাদি। এতে বমি ভাব কমবে। এ ছাড়া আদা-চা, গ্রিন টি বা শুকনো আদা বমি ভাব কমায়। এ সময় ফলমূল খেতে হবে বেশি করে।

(ঢাকাটাইমস/০৮জুন/এনআই/জেবি)