মওদুদের বাড়ি ও ৫০টি লিচু

প্রকাশ | ০৮ জুন ২০১৭, ১০:৫৮ | আপডেট: ০৮ জুন ২০১৭, ১১:৪৯

ওয়াসেক বিল্লাহ

যেদিন বিএনপি নেতা মওদুদ আহমদকে তার দীর্ঘ দিনের আবাস ছাড়তে হল সেদিনই ৫০টি লিচু কিনে বাড়ি ফিরলাম। কেনার কোনো ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু অনেক রাতে বেচারা বিক্রেতা কতগুলো ফল নিয়ে বসেছিলেন। জানালেন, পথে যানজটে দেরি হয়ে গেছে, তাই বিপাকে পড়েছেন। অনুরোধ করলেন অল্প হলেও যেন কিনি।

অন্য বছর এই সময়ে আম-লিচুতে ঘর ভর্তি থাকে। কিন্তু সন্তানসম্ভাবা স্ত্রী প্রেগন্যান্সি ডায়াবেটিকে আক্রান্ত, তাই মিষ্টি জাতীয় জিনিস কেনা হয় না। তবু বিক্রেতার মুখ চেয়ে অল্প কয়েকটা কিনলাম। দাম চাইলেন ১৫০ টাকা। আর কম বলতে ইচ্ছে হল না। বাড়িতে ফলগুলো নিতে নিতে ভাবলাম, বেচারা লিচু বিক্রেতা যদি এই টাকায় গুলশানে দুই বিঘা আয়তনের একটি বাড়ি কিনে নিতে পারে তাহলে তো ভালই।

ভাবছেন পাগলের প্রলাপ বকছি? ১৫০ টাকায় দুই বিঘা আয়তনের বাড়ি? শায়েস্তা খাঁর আমলেও এটা পাওয়া যেত কি না, সেই হিসাব কষতে শুরু করেছেন? তাহলে শুনুন। এই রাজধানীতে গুলশান-২ নম্বরে এক বিঘা ১৩ কাঠার একটি জমি ১০০ টাকায় কিনে নেয়ার গল্প সাজিয়েছিলেন এক জন। মামলায় হেরে ৩০ বছর পর সেই বাড়ি ছাড়তে হয়েছে তাকে। তবু তিনি বলেছেন, সরকার তার বাড়িটি নিয়ে গেছে। অভিমানী কণ্ঠে একবার এমনও বলেন, তিনি রাতে ফুটপাতে থাকবেন। তার দলের প্রধান তার কাছে ছুটে গিয়ে শান্তনা দিয়েছেন, বলেছেন ধৈর্য ধরতে, হুমকিও দিয়ে রেখেছেন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে, জনগণ একদিন এক কাপড়ে বাড়ি থেকে বের করে দেবে বলে।

বাহ কি সুন্দর তাই না? ১০০ টাকায় বাড়ি কেনার এই নাটক সাজিয়েছিলেন বিএনপি নেতা মওদুদ আহমদ। আসলে তিনি নিজের নামে কেনেননি বাড়িটি, মালিকানা স্বত্ত্ব করা হয়েছিল তার ভাই মনজুর আহমদের নামে। তবু তিনি বলেছেন, তার বাড়ি কেড়ে নেয়া হল। মওদুদ সাহেবের ভাই কোথায় আছেন জানি না। যদি এটা তার ভাইয়ের বাড়ি হয়েও থাকতো, তাহলে তিনি কোন হিসাবে বললেন, তার বাড়ি কেড়ে নেয়া হয়েছে?

চার বছর আগে এই বাড়ি বিক্রির নয় ছয় নিয়ে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন। ১০০ টাকায় গুলশানে বিরাট জমিসহ বাড়ি কেনাবেচার দলিল নিয়ে যে প্রশ্ন তোলা যায়, সেটা বুঝতে এতগুলো বছর পার করে দিল আমাদের প্রশাসনের কর্মীরা!

এমনকি গণমাধ্যমেও এ নিয়ে কোনো প্রতিবেদন হয়নি। উচ্চ আদালতের রায়ের পর গণমাধ্যমে আসা প্রতিবেদনে জানা যায়, ওই বাড়ির প্রকৃত মালিক ছিলেন পাকিস্তানি নাগরিক মো. এহসান। ১৯৬০ সালে তৎকালীন ডিআইটির কাছ থেকে তিনি ওই বাড়ির মালিকানা পান। ১৯৬৫ সালে বাড়ির মালিকানার কাগজপত্র এহসানের স্ত্রী অস্ট্রিয়ার নাগরিক ইনজে মারিয়া প্লাজের নামে নিবন্ধন করা হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এহসান স্ত্রীসহ ঢাকা ছাড়েন। তারা আর ফিরে না আসায় ১৯৭২ সালে এটি পরিত্যক্ত সম্পত্তির তালিকাভুক্ত হয়।

ওই বছরই মওদুদ ওই বাড়ির দখল নেন। কিন্তু ইনজে মারিয়া প্লাজের মৃত্যুর পর ভুয়া আমমোক্তারনামা তৈরি করে মওদুদের ভাই মনজুর আহমদের নামে ওই বাড়ির দখল নেওয়া হয়। ২০১৩ সালে দুদক মামলা করার পর শুরু হয় আইনি লড়াই।

উচ্চ আদালত পর্যন্ত প্রতিটি ধাপেই লড়েছেন মওদুদ। আইনজীবী হিসাবে প্রতিটি আইনি সুযোগই কাজে লাগিয়েছেন তিনি। মামলায় হেরেছেন, তারপর বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হওয়ার পর তিনি আবার ‍হুমকির সুরে বলেছেন, ‘দেশে কি কোনো আইন নেই?’।

মওদুদ সাহেবরা ক্ষমতায় থাকতে কতই না আইন বানিয়েছেন, ১০০ টাকায় গুলশানে জমি ও বাড়ি কেনা বেচা করা যায়-এমন আইন করে নিলেই তো পারতেন। তাহলেই তো বাজারমূল্যে ৩০০ কোটি বা তার চেয়ে বেশি টাকার জমি ১০০ বা ১ টাকায় নিজের করে নিতে পারতেন তিনি।

হ্যাঁ, গুলশানের সেই জমির দাম কমসে কম ৩০০ কোটি টাকা। প্রতি কাঠা জমির দাম সেখানে কমপক্ষে ১০ কোটি টাকা। সেই হিসাবে এক বিঘা ১৩ কাঠার জমির দাম এই বিপুল পরিমাণ টাকাই হয়ে থাকে। এটা কি দুর্নীতি নয়? ৩০০ কোটি টাকার জমি হাতিয়ে নেয়ার চেষ্টার অপরাধে মওদুদ সাহেবকে কোনো শাস্তি পেতে হবে না?

মওদুদ সাহেবকে চেনে না এমন মানুষের বুঝি অভাব রয়েছে এই দেশে। কারণ, তিনি পল্টিবাজ হিসেবে খ্যাত। আসলে ঠিক পল্টিবাজ বলা যায় কি না, তিনি সব সময় ক্ষমতার আশেপাশে থাকতে পছন্দ করেন। ক্ষমতার দল পাল্টালেও তার নীতি কখনও পাল্টায় না।

তবে হ্যাঁ, মওদুদের এই ক্ষমতার আশেপাশে থাকার নীতি গত ১১ বছর ধরে কিছুটা পাল্টেছে বলা যায়। এই সময়ে তার দল বিএনপি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বাইরে। তবু তিনি দলে রয়ে গেছেন। নানা সময় নানা গুঞ্জন শোনা গেলেও সেটি সত্য প্রমাণ হয়নি। তবে মওদুদের আর্থিক কেলেঙ্কারির কথা এতদিন সেভাবে প্রকাশ পায়নি। এবার তো আদালতে ৩০০ কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণ হল। রাজনীতির ময়দানে এই ধরনের দুর্বৃত্তপনা কি চলতেই থাকবে? বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া যে মওদুদ সাহেবকে ধৈর্য ধরতে বলেছেন, তার কী মানে? ক্ষমতায় ফিরতে পারলে কি এই জমি আর বাড়ি আবার ফিরিয়ে দেয়া হবে? সেই লিচু বিক্রেতার নাম জানি না, তাকে নিয়ে আসবো, ২০০ টাকাসহ। তাকেও কিন্তু এমন একটি বাড়ি দিতে হবে।

লেখক: সাংবাদিক