কুখ্যাত রাজাকার খতমকারী ১০ যুবক মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি কবে?

প্রকাশ | ০৯ জুন ২০১৭, ০৯:১০ | আপডেট: ০৯ জুন ২০১৭, ১২:২৮

জাহাঙ্গীর হোসেন, মির্জাপুর (টাঙ্গাইল) প্রতিনিধি

তারা ছিলেন ১০ যুবক। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তারা থামিয়ে দিয়েছিলেন  এক নির্মম রাজাকারকে, যার নেতৃত্বে মির্জাপুরে চলে গণহত্যা, জ্বালাও-পোড়াও, লুটপাট। শান্তি কমিটির ওই চেয়ারম্যান মাওলানা ওয়াদুদকে (ওদুদ মওলানা নামে পরিচিত) খতমকারী দশ যুবকের মধ্যে এত দিনে সাতজন পাড়ি জমিয়েছেন পরপারে। বেঁচে আছেন তিনজন। কিন্তু কেউ এখনো মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাননি।  

টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের সেই দশ বীর যুবক কবে পাবেন মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি? এই প্রশ্ন এলাকাবাসী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের।

অভিযোগ রয়েছে, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ওয়াদুদের পরিকল্পনায় হত্যা করা হয় কুমুদিনী হাসপাতাল ও ভারতেশ্বরী হোমসের প্রতিষ্ঠাতা দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা ও তার একমাত্র ছেলে ভবানী প্রসাদ সাহা রবিকে।

পৌর সদরের বাইমহাটি গ্রামের বাসিন্দা ওয়াদুদের নেতৃত্বে ওই সময়ে মির্জাপুরে সংঘটিত হতে থাকে একের পর এক হত্যা, জ্বালাও-পোড়াও। সেই দিনের সেই অসহায় অবস্থা থেকে স্থানীয়দের জানমাল রক্ষায় জীবন বাজি রেখে এগিয়ে আসেন দশ যুবক। তারা পরিকল্পনা করেন কুখ্যাত রাজাকার মাওলানা ওয়াদুদকে খতম করার। পরিকল্পনা মাফিক তারা সফলও হন।

এই সফলতা ৭৫ পরবর্তী সময়ে তাদের জীবনে নিয়ে আসে ঘোর অন্ধকার। বহুবার জেল-জুলম ও হয়রানির শিকার হতে হয় সেই যুবক ও তাদের পরিবারের সদস্যদের।

জানা যায়, সেদিনের সেই জীবনবাজি রাখা ১০ যুবকের সাতজনই এখন আর বেঁচে নেই। যে তিনজন বেঁচে রয়েছেন তারাও ভুগছেন শারীরিক নানা অসুখ-বিসুখে। জীবন বাজি রাখা সেই দশ যুবক কি মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাবেন? এ প্রশ্ন এখন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা, এলাকাবাসী ও দশ যুবকের  পরিবারের।

সেদিনের সেই দশ বীর যুবক হলেন পৌর সদরের পোষ্টকামুরী গ্রামের মো. আমজাদ হোসেন (মৃত) বড় ছেলে বুরজু মুন্সী (মৃত), সেজু ছেলে আয়নাল হক (মৃত), ছোট ছেলে নুরু মিয়া (জীবিত), মো. নোয়াব আলী (মৃত), আবুল কাশেম কাচ্ছেদ সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান (মৃত), মো. শাজাহান মিঞা (মৃত), মো. লাল মিয়া সাবেক কাউন্সিলর (মৃত), মো. হেলাল উদ্দিন (জীবিত) ও আলেপ মিয়া (জীবিত)।

জানা গেছে, স্বাধীনতা যুদ্ধে সরাসরি অংশ নেয়া ও বিভিন্নভাবে অবদান রাখা ব্যক্তিদের নতুন করে যাচাই-বাছায়ের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে বর্তমান সরকার।

জানা যায়, মাওলানা ওয়াদুদের পরিকল্পনায় কুমুদিনী হাসপাতাল ও ভারতেশ্বরী হোমসের প্রতিষ্ঠাতা এশিয়াখ্যাত দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা ও তার একমাত্র পুত্র ভবানী প্রসাদ সাহাকে ধরে নিয়ে হত্যা করা হয়। বাসায় আওয়ামী লীগের অফিস থাকার অপরাধে পোষ্টকামুরী গ্রামের জয়নাল সরকারকে ঘরে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারা হয়। এ ছাড়া একই গ্রামের মাজম আলীকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এভাবে একের পর এক চলা হত্যা ও জ্বালাও-পোড়াওয়ে মির্জাপুরের মানুষ হয়ে পড়ে অসহায়।

সেই অসহায় অবস্থা থেকে রক্ষা পেতে মাওলানা ওয়াদুদকে খতম করে দশ যুবক। তারা পরিকল্পনা মাফিক হামলা চালিয়ে পৌর সদরের কলেজ রোডে মাওলান ওয়াদুদকে খতম করেন। ফলে মির্জাপুরবাসী আরও ভয়ঙ্কর ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পায়।

কিন্তু পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে মাওলানা ওয়াদুদের বড় ছেলে রাজাকার মাহাবুর হয়ে ওঠেন প্রশাসনের খুব কাছের লোক। তার ক্ষমতার কাছে স্থানীয়রাসহ ওই দশ যুবক ও তাদের পরিবার হয়ে পড়েন অসহায়। মাহাবুবের ক্ষমতায় একের পর এক মিথ্যা অভিযোগে বহুবার জেল-জুলুমের শিকার  হয় দশ যুবক।

ইতিমধ্যে দশ যুবকের সাতজনই মৃত্যুবরণ করছেন।  যে তিনজন বেঁচে আছেন, তারাও ভুগছেন শারীরিক নানা অসুখ-বিসুখে।

বর্তমান সরকার সারাদেশে চিহ্নিত রাজাকারদের বিচারের ব্যবস্থা করায় দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা ও তার ছেলে ভবানী প্রসাদ সাহা হত্যা মামলায় মাওলানা ওয়াদুদের বড় ছেলে রাজাকার মাহাবুব গত প্রায় ছয় মাস ধরে রয়েছেন জেল হাজতে।

নতুন করে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার সরকারি উদ্যোগের পরিপ্রেক্ষিতে অনেকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেতে অনলাইনে আবেদন করেছেন। কিন্তু ওই দশ যুবকের অধিকাংশের পরিবার সে খবর জানে না। জীবিত তিনজনের দুজন আবেদন করেছেন অনলাইনে। ইতিমধ্যে তারা যাচাই-বাছাই কমিটির কাছে সাক্ষাৎকারও দিয়েছেন। কিন্তু মৃত সাতজন ও জীবিত একজনের পরিবার বাদ পড়েছেন এই সুবিধা থেকে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নানা কারণে দুই দফা পিছিয়ে অনলাইনে আবেদনকারীদের প্রথম দফা সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে। কিছুদিনের মধ্যে তারিখ নির্ধারণ করে পুনরায় যাচাই-বাছাই কার্যক্রম শুরু করা হবে।

ওই ১০ জনের একজন জীবিত সদস্য মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘কী পাব কী পাব না সেই আশায় রাজাকার ওয়াদুদকে খতম করিনি। মির্জাপুরের মানুষকে এবং দেশের শত্রুকে খতম করেছি সেটাই ছিল বড় কথা।’

অপারেশনে অংশ নেয়া সদস্য মৃত মো. নোয়াব আলীর বড় ছেলে মো. মাসুদ রানা বলেন, মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের সরকার যদি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকারীদের পুরস্কৃত করতে পারে তাহলে বর্তমান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার কেন একজন চিহ্নিত রাজাকার হত্যাকারীদের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দিতে পারবে না। তিনি সেদিনের সেই দশ যুবককে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেয়ার জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানান।

এ ব্যাপারে মির্জাপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার অধ্যাপক দুর্লভ বিশ্বাস বলেন, মাওলানা ওয়াদুদ সহযোগিতা না করলে যুদ্ধের সময় মির্জাপুরে এত গণহত্যা ও জ্বালাও-পোড়াও হতো না। এ ছাড়া তার পরিকল্পনাতে দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা ও তার পুত্র ভবানী প্রসাদ সাহাকে হত্যা করা হয়। মাওলানা ওয়াদুদকে খতমকারীরা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তবে নির্ধারিত সময়ে অনলাইনে আবেদন না করায় স্থানীয়ভাবে তাদের জন্য কিছু করার নেই বলে জানান তিনি।

(ঢাকাটাইমস/৯জুন/মোআ)