মওদুদের বাড়ি উচ্ছেদ: আমাদের রাজনীতির চেহারা

প্রকাশ | ০৯ জুন ২০১৭, ১৭:১১ | আপডেট: ০৯ জুন ২০১৭, ১৭:১৪

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা

প্রায় তিন যুগ একটি সরকারি সম্পত্তি দখল করে বাস করছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। তিনি একজন উচ্চ শিক্ষিত রাজনীতিবিদ। এমপি, মন্ত্রী, প্রধামন্ত্রী, উপ-রাষ্ট্রপতি- কত পদেই না ছিলেন নানা দলের সরকারে। সেই মানুষ যখন এমন করে দখলের উৎসবে মাতেন, তখন এদেশের রাজনীতির মান বোঝা যায়।  

রাজনীতি করা গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু আমরা জানি,  এই রাজনীতিতে জনগণের ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। রাজনীতি করে প্রতিষ্ঠানকে কী ভাবে ঘায়েল করা যায়, অফিস, পদ, পদবী, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, পুকুর, জলাভূমি, সরকারি খাস জমি, সুযোগ বুঝে অন্যের বাড়ি, টেন্ডার দখলে নেয়া রাজনীতির নির্ধারিত কাজের চেয়ে অনেক বেশি রোমাঞ্চকর। সবাই নিশ্চয়ই এমন নয়। অনেকেই আছেন, যাঁরা কখনও কোন দিন কোথাও রাজনীতির সাহায্যে দখলের উৎসবে মাতেননি। কিন্তু তারা সংখ্যালঘু।

ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদকে দেখলে একটা কথা মনে হয়, রাজনীতি চর্চার একটি বৌদ্ধিক এবং মানসিক দিক আছে, আর অন্য দিকে রয়েছে রাজনীতির কায়িক চেহারা, যেখানে ‘চতুর’ নেতারা রমরমা। এই দুইয়ের দ্বন্দ্বে তথাকথিত ‘ভদ্রলোক’ রাজনীতির লোকেরা দখলের খেলায় মেতে ওঠেন। এই রাজনীতির কারণেই রাজনীতির বাইরে যে দখলের আখড়া, সেখানে ভিড় বাড়তে থাকে। রাজনীতির নামে দখল এক ‘সংস্কৃতি’ হয়ে দাঁড়ায় মুদ্রাদোষের মতো, না করে থাকতে পারেন না। ভদ্রতার মুখোশে সেই সংস্কৃতি মওদুদরা ছড়িয়েছেন কেন্দ্র থেকে প্রান্তে। 

রাজনীতির সাহায্যেই তো অশুভ শক্তিকে ঠেকানো যায়, অন্তত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সেটাই শিক্ষা। কিন্তু আমাদের রাজনীতি স্বাভাবিক রাজনীতি নয়। সর্বগ্রাসী সর্বব্যাপ্ত রাজনীতি আমাদের। এখন রাজনীতি হলো, কয়েক জন বলে, আর সবাই চুপ করে থাকে। অশান্তি নেই, প্রতিবাদ নেই, মিছিল নেই, মশাল নেই। যেন স্বেচ্ছায় স্বাধীনতা বিসর্জন দিয়েছে সবাই কোনও এক অমোঘ, নিরঙ্কুশ, সদাসত্য রাজনৈতিক দর্শনের তাড়নায়। বিতর্ক নেই, তাই সংঘাতও নেই। দিনের পর দিন হাড়-হিম-করা শৃঙ্খলে আবদ্ধ সে ব্যবস্থা। এই রাজনীতিই উপহার দেয় দখলবাজদের। 

সব জায়গায় রাজনৈতিক স্ট্র্যাটেজির একটা বাড়বাড়ন্ত আছে। সব জায়গায় শাসক-বিরোধী সমারোহ, জটিল-কুটিল পদ্ধতি প্রক্রিয়ার সাহায্যে অমুককে ল্যাং মেরে তমুক গোষ্ঠীকে বিপাকে ফেলে, মাসল ফুলিয়ে ঘুরে চলার নাম রাজনীতি। 

সুশাসনমুখী ও দুর্নীতিহীন একটি ভাবমূর্তির কথা রাজনীতি আর ভাবেনা। ভাববার প্রয়োজনও নেই। আদর্শের রাজনীতি বিদায় নিয়েছে সেই কবে, সেকথা এখন আর কারো স্মরণে নেই। আদর্শ  না থাকায় এখন রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীরা সম্পদ দখলের লড়াইয়ে মেতে উঠেছেন। আদর্শের জন্য নয়, কী পরিমাণ অর্থ বিতরণ হচ্ছে, তার দখল নিতেই লড়াই হয় বেশি।  

মওদুদের মতো প্রায় সব রাজনীতিকই সৎ-অসৎ পথে সম্পদের মালিক হতে চান। এটা এখন একটা চর্চা। রাজনীতিবিদদের মধ্যে সমন্বিত কোনো আদর্শ নেই। প্রতিযোগিতা মূলত সম্পদ বানানোর জন্য, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য। একদলীয় প্রভাবাধীন ব্যবস্থার এখন সম্পদ ও পদের ভাগাভাগি নিয়ে সংশ্লিষ্টদের মধ্যেই সংঘাত বাড়ে। আর এই সুযোগ ছাড়েনা আমলাতন্ত্রও। 

রাজনীতি চর্চা এখন এমন হয়েছে যে, সংসদ সদস্যরা, তাদের যে মৌলিক কাজ, আইন প্রণয়ন, তার চাইতে বেশি চান সুযোগ-সুবিধার বণ্টন। এবং এই সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়েছে পেশাজীবীদের মধ্যেও। 

আসল রাজনীতি, বড় রাজনীতির ময়দানে এখন ঘোর অনটন। রাজনীতি চর্চার রোমাঞ্চ আমরা অর্জন করতে চাই ক্ষুদ্রতর নানা পরিসরে। আর সেকারণেই দখলের কৌশল রপ্ত করতে হয় সবাইকে। সামরিক শাসকরা শিখিয়ে দিয়েছেন, এখন তার প্র্যাকটিক্যাল চলছে। জাতীয় রাজনীতির বিভিন্ন আসরে ভাল রাজনীতিক হিসেবে নাম শোনা যায়,  তাদের সংখ্যা এক আঙুলে গোনা যায়। এরা আবার দলে বা দলের বাইরে নানাভাবে উপেক্ষিত। কারণ তাদের কাছে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার কৌশলটা অজানা। পেশাদার রাজনীতিবিদরা মানুষকে শুধু ক্ষমতা আর লোভের গল্পই শিখিয়ে ছাড়ে। ফলে এই দখল সংস্কৃতিকে আর অন্যায্য কাজ মনে হয়না রাজনীতির বড় অঙ্গনে। 

বড়দের দল ছোটদেরও অনুপ্রাণিত করে, উৎসাহিত করে। ছাত্রদের রাজনীতি যারা করে কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে, ক্রমে তারাও যুক্ত হয়ে পড়ে নানা দুর্নীতি এবং অর্থকরী কার্যক্রমে। এর ফলে ক্যাম্পাসে দলাদলি, বিশৃঙ্খলা আর হিংসা প্রবল ভাবে বেড়েছে, কিন্তু  তাতে কারো কোন উদ্বেগ নেই। উদ্বেগ নেই, কারণ শিক্ষকরাও একই ধরণের অনুশীলনে ব্যস্ত। 

নীতি নৈতিকতা নয়, রাজনীতিতে স্বার্থই একমাত্র কালজয়ী। জোরজবরদস্তি করে দখলের রাজনীতি বৃহৎ অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে ক্রমাগত বিপর্যস্ত করছে। ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী একা উন্নয়নের ভাবনায় ব্যস্ত থাকলে চলবেনা, দলকে তার আদর্শিক হাতিয়ার হতে হয়। মানুষের মনে ইতিবাচক ভাবমূর্তি গড়ার নিয়ত সংগ্রাম করতে হয়। দেশ নূতন রাজনীতি চায়। উন্নয়নের সাথে আদর্শের রাজনীতি, সুশাসনের রাজনীতি। সেই রাজনীতি মওদুদরা কখনো দিতে পারবেন না।

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা: পরিচালক বার্তা, একাত্তর টিভি

(ঢাকাটাইমস/০৯জুন/টিএমএইচ)