মাহমুদউল্লাহ, বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়

প্রকাশ | ১১ জুন ২০১৭, ১২:০২

তায়েব মিল্লাত হোসেন

মাহমুদউল্লাহ আমাদের। আমাদের মাহমুদউল্লাহ। ক্রাইসিস ম্যান। বিপদের বন্ধু। সবাই যখন একে একে বিদায়ের পথে থাকেন। তখন খড়কুটো ধরার মতো করে আগলে রাখেন উইকেট আর লাল-সবুজের পতাকার মানুষদের এতোটুক আশা। ৩৯ বলে হয়তো ১৩। একটা, দুটো উইকেট। কিছু ক্যাচ। নিয়ম করে ফিল্ডিং। অন্যদের সামনে ম্রিয়মান। কেবল সবটা মিলে পূর্ণ এক ক্রিকেটার রিয়াদ। তাই একপা-দুপা করে জাতীয় দলে খেলে যাওয়া, টিকে থাকা।

মাঠে সম্মানজনক ক্রিকেটের সেই সময়ে তার বিকল্প আর কে ছিল। তবু তারকার তকমা ছিল না। কারণ শ্রমে-ঘামে-প্রয়োজনে কার্যকর যারা, তাদের গায়ে জনপ্রিয়তার জোয়ার ছুটে আসে না। তারা নিয়মিত ভাত-মাছের মতো, বাতাসের মতো, দরকারি কিন্তু মনে রাখার প্রয়োজন আসে না। বিশেষ দিনের পোলাও-রোস্ট, জীবনের সন্ধিক্ষণে টাকায় কেনা অক্সিজেন কেবল আমরা মনে রাখি।

যাই হোক ক্রিকেটে ফিরি। গড়-পড়তা মাহমুদউল্লাহ মাঝে বনে গেলেন দল-কাপ্তান মুশফিকের ভায়রা ভাই। তাই স্বজনের সুবাস পেতে লাগলেন অনেকেই। ভায়রার জোরেই নাকি বার বার দলে রিয়াদ! এই বোদ্ধারা পুরনো দিনের খবর রাখেন না। তারা নতুন দিনের হুজুগে ক্রিকেটপ্রেমী। তাদের জানা নেই, মাহমুদ একটা সময় নীতি-নির্ধারকের নয়নে ভাবী কাপ্তান ছিলেন। তাই সহ-অধিনায়কের দায়িত্বে ছিলেন বেশ কিছু কাল। সেই দিনগুলো হারিয়ে গেল। চারিদিকে বায়ুর বিষাদ।

জাতীয় দলে তার দিন বুঝি শেষ হয়ে এলো। রাশি রাশি তারার ভিড়ে আর কিভাবে টিকে থাকবেন। টিকতে হলে বড় কিছু করতে হবে। ঘটা করে আওয়াজ ছাড়া আজকাল এগিয়ে যাওয়া কঠিন। নইলে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে থাকতে হবে।

এই কাজে মাহমুদ বেছে নিলেন বড় মঞ্চ। ক্রিকেট বিশ্বের সবচেয়ে বড় আসর। একেবারে বিশ্বকাপ ক্রিকেট। দ্যুতি ছড়ালেন ব্যাটে। ছড়ি ঘোরাতে থাকলেন প্রতিপক্ষ বোলাদের উপর। দেশের পক্ষে বিশ্বকাপে প্রথম শতক। এবং দ্বিতীয় শতক। একদিনের ক্রিকেটে সেই সময় মাহমুদউল্লাহরও কিন্তু কোনো সেঞ্চুরি ছিল না। পর পর করে ফেললেন দুটো শতক।

বিশ্বকাপে টানা দুই শতকের বিরল গাঁথার তালিকায় এবি ডি ভিলিয়ার্স, রাহুল দ্রাবিড়, ম্যাথু হেইডেন, রিকি পন্টিং, সাঈদ আনোয়ার, মার্ক ওয়াহদের পাশে উঠে এলেন তিনি। আড়াল-নায়ক হয়ে উঠলেন বাংলাদেশের মহা-তারকা। হয়ে গেলেন বাংলাদেশের ক্রিকেটের বড় ভরসার নাম। তার ভক্ত-বাহিনীর বিশাল বহর হলো। ছোটপর্দার বিজ্ঞাপনের নায়ক হলেন। তবু তামিম-সাকিব-মুশফিক-মাশরাফি থেকে হালের মুস্তাফিজের পাশে কেমন যেন পার্শ্বনায়কই হয়ে থাকলেন। এভাবে আর কতোদিন! রিয়াদ বেছে নিলেন মহানায়ক হওয়ার মঞ্চ।

কার্ডিফ ৯ জুন ২০১৭। প্রতিপক্ষ নিউজিল্যান্ড। তাদের ব্যাটে টাইগারদের লক্ষ্য ২৬৬ রান। শুরুতেই বাংলাদেশ ৪-৩৩। আবার কী গো-হারা হারবে বাংলাদেশ? পরাজয় মানেই তো চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি থেকে এবারের মতো পত্রপাঠ বিদায়। মাঠে তখন সাকিব, রিয়াদ। থরহরি কম্প নয়। পাল্টা আক্রমণ চালালেন দুজনায়। তরতর করে বাড়তে থাকলো রানের পারদ। রেকর্ডের পর রেকর্ড। সাকিবের শতক। মাহমুদের শতক। জয়ের নোঙর থেকে খানিক দূরে থাকতেই সাকিব আল হাসানের বিদায়। অপরাজিত মাহমদউল্লাহ। মহাকাব্যিক এক জয় বাংলাদেশের।

সাকিবে, রিয়াদে নতুন করে লিখতে হলো রেকর্ড খাতা। কেননা বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে এর আগে কোনো উইকেটে সর্বোচ্চ রানের জুটি ছিল ১৭৮ রান। সেটা ছাপিয়ে কার্ডিফে হলো ২২৪ রান। জুটির নাম সাকিব-রিয়াদ। টাইগার বাহিনীর ক্রিকেটে এটিই প্রথম দ্বিশতক রানের জুটি। চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে যে কোন উইকেট জুটিতে এটি দ্বিতীয় সবোর্চ্চ রানের জুটি। কার্ডিফের মাঠে যেকোনো দেশের পক্ষে সর্বোচ্চ রানের জুটিও এটি। একই ম্যাচে দ্বিতীয়বারের মতো দুই বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানের সেঞ্চুরি দেখল বাংলাদেশের ক্রিকেট। আরো অনেক রেকর্ডের খোঁজ মিলবে নিশ্চয়ই। আমরা আর তাতে না যাই। বরং শতকের পর মাহমুদের উদযাপন ভঙি নিয়ে একটু বলি। সেঞ্চুরির পর উইকেটে চুমু খান। ব্যাটখানি উঁচিয়ে ধরেন ক্রিকেটারদের অপেক্ষালয়ে। তারপর ব্যাটে কী যেন একটা দেখালেন আঙুল দিয়ে। বাচ্চাদের ভঙ্গি করলেন। এই সবের রহস্য জানিয়েছেন গণমাধ্যমে।

বলেছেন, ‘‘এবার ইংল্যান্ডে আসার আগে ব্যাগ গোছাচ্ছিলাম। আমার ছেলে পাশে থেকে দেখছিল। হঠাৎ একটি ব্যাট নিয়ে ছেলেটা ওর নাম লিখল ব্যাটে। আমাকে বললো, ‘বাবা এই ব্যাট দিয়ে খেলো, ভালো খেলতে পারবে।’ আমি ওই ব্যাট দিয়েই খেলেছি। সেঞ্চুরির পর ছেলের কথাটিই বোঝাতে চেয়েছিলাম।”

৫ বছরের পুত্রের কথা বনে গেলো। হেসে উঠলো বাংলাদেশ।

মাহমুদউল্লাহর ব্যাটে এখন লাল-সবুজের এই দেশের যে হাসি, তার সূত্রপাত প্রায় দেড় যুগ আগে। ২০০০ সালে। নির্মাণ স্কুল ক্রিকেটে রাজশাহীর একটি স্কুলকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় ময়মনসিংহ জিলা স্কুল। সেখানে ঝলক দেখান। তাই মাহমুদউল্লাহকে ঢাকায় নিয়ে আসেন ভাই এমদাদ। তখন বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৫ দলের এশিয়া কাপের অনুশীলন চলছে। ময়মনসিংহের প-িতপাড়া ক্লাবের কোচ কামালুজ্জামান ও এমদাদ মাহমুদউল্লাহকে না জানিয়েই অনূর্ধ্ব-১৫ দলের জন্য মাহমুদউল্লাহর নাম নিবন্ধন করান।

তবে তত দিনে ওই স্কোয়াডে প্রয়োজনীয় ক্রিকেটারের অন্তর্ভুক্তি হয়ে গিয়েছিল। ক্ষীণ আশা ছিল, যদি ফিটনেস পরীক্ষায় কেউ বাদ পড়ে! কামালুজ্জামান তাঁর বন্ধু অনূর্ধ্ব-১৫ দলের তখনকার কোচ অলক চক্রবর্তী অনুরোধ করেন, শূন্য স্থানে মাহমুদউল্লাহকে বাজিয়ে দেখতে। বন্ধুর অনুরোধ রাখলেন অলক। সেবার মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব-১৫ এশিয়া কাপ টুর্নামেন্টের মূল দলে সুযোগ পেয়ে দারুণ পারফর্ম করেন মাহমুদউল্লাহ।

অসাধারণ সেই পারফরম্যান্সের পর ২০০২ সালে সুযোগ পেলেন ধানমন্ডি ক্লাবে। ক্লাবের কোচ জালালকে প্রিমিয়ার লিগে খেলার সুযোগ করে দিতে অনুরোধ করলেন মাহমুদউল্লাহ। তা-ও মিললো। এরপর আর পেছন ফেরা নেই। কেবল লড়াই আর লড়াই। হারে-জিতে মাথা উঁচু করে লাল-সবুজের পতাকা নিয়ে এগিয়ে চলা। দেখা যাক, এখন চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালে কী হয়। কী উপহার দেন আমাদের প্রিয় মাহমুদউল্লাহ। যাই হোক, আমরা আপনার পাশে আছি, ভালোতে, মন্দ দিনে- সবসময়।

তায়েব মিল্লাত হোসেন: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক