শুধুই প্রাকৃতিক দুর্যোগে পাহাড় ধস?
প্রকাশ | ১৭ জুন ২০১৭, ১৪:১৭
চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে সাম্প্রতিক পাহাড় ধস, ব্যাপক প্রাণহানি ও ধংসকে যে ভাবে প্রাকৃতিক বিপর্যয় বলে বর্ণনা করা হচ্ছে, সেটা বিভ্রান্তিকর। ক্ষতিকরও। মৃতের প্রকৃত সংখ্যা, কত ভয়ংকর অভিজ্ঞতা পেরিয়েছেন বেঁচে ফেরা লোকেরা, কত ক্ষয়ক্ষতি হল রাস্তাঘাটের, কী অসাধারণ সাহস ও ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে সেনাবাহিনী, ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকারী দল ও সাধারণ মানুষ, সব নিয়ে অনেক আলোচনা, মৃতদের জন্য আহাজারি দুর্গতদের সাহায্য-প্রচেষ্টা, সবই নিশ্চয়ই চলতে থাকবে, চলারই কথা। কিন্তু ‘বিপর্যয়’ শব্দটির মধ্যে কোথাও আকস্মিকতার অর্থ নিহিত থাকে। পাহাড়ে যা ঘটেছে, তাকে আকস্মিক বলা যাবে না।
অঞ্চলটির দিকে খেয়াল করলেই অনেকটা পরিষ্কার হবে যে, পাহাড়ের এই চূড়ান্ত দুর্যোগ অবশ্যম্ভাবী ছিল। এই পার্বত্য এলাকা দশকের পর দশক ধরে যে যথেচ্ছাচারের শিকার হয়েছে তা হিসাববিহীন। পাহাড়ের উপযোগী নয় এমন মানুষ স্থলভাগ থেকেতো সেটেল করা হয়েছেই, নির্বিচারে কাটা হয়েছে পাহাড়ের মাটি, পাহাড়ের গাছ।
পাহাড়ের যারা আদিবাসি, তারা প্রাকৃতিক এই সম্পদের গুরুত্ব এত বেশি বুঝতেন বা বুঝেন, যে তাদের কাছে সমগ্র অঞ্চলটিই পবিত্র। সযত্নে সসম্ভ্রমে রক্ষা করার। পাহাড়ের ভঙ্গুরতা খেয়াল রেখে সেখানে ব্যবহৃত হয়েছে গাঁইতি-শাবল। তারা কোনকিছুই নির্বিচারে করেনি। এ দেশের দুর্লভ এই প্রাকৃতিক সম্পদ যেদিন থেকে বাজারে বিক্রি করা শুরু হলো, সেদিন থেকেই বিপর্যয় নামতে শুরু করলো। আর আছে উন্নয়ন আসক্তির নামে যেনতেনভাবে পাহাড় হত্যা করা। প্রকৃতির গুরুত্বকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে এই তাৎক্ষণিক খুচরা লাভের আশায় বেচা-কেনা, গাছ কাটা থেকে শুরু করে যাবতীয় ধংসযজ্ঞ করা হয়েছে। সেখানকার শান্ত প্রকৃতি তাই এখন আশান্ত হয়ে প্রতিশোধ নিতে শুরু করেছে।
স্থানীয় লোকেদের উন্নয়নের নামে ধ্বংস হয়েছে তাদের জীবনযাপন পদ্ধতি। মাইলের পর মাইল জুড়ে অসংখ্য বিস্ফোরণে আপাদমস্তক পাহাড় কাঁপিয়ে তৈরি হয়েছে পাকা রাস্তা। এমনকি বেশ কিছু বহুতল ভবনও। অনিয়ন্ত্রিত অপরিণামদর্শী বিস্তারের পরিণামে ধ্বংস হয়ে গেল বহু জায়গায় পাহাড়ের স্বাভাবিক ঢাল, জঙ্গল।
আর আছে অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন ব্যবসা। যেন খুবলে খুবলে নগরের মানুষকে দেখাতে হবে পাহাড়ের শরীর। পাহাড় শত শত বছর ধরে বহু মানুষ স্বয়ংভর ভাবে বাস করে এসেছে, পালন করে এসেছে তাদের মতো করে জীবনধারা, আতিথ্য দিয়েছেন সাধারণ তীর্থযাত্রীদের। দায়িত্বজ্ঞানহীন ‘ভ্রমণশিল্প’ আর উন্নয়ন আনক্তি সেখানে উদ্যোক্তাদের কিছু-দিন কিছু আর্থিক সুবিধা দিলেও অঞ্চলের ভৌগোলিক ও সামাজিক অর্থনৈতিক অবস্থার অত্যন্ত ক্ষতি করেছে ভয়ানক ভাবে।
এবারের বিধ্বংস যে অবশ্যম্ভাবী ছিল, তার সাক্ষ্য দেয় ২০০৭ সালের ঘটনা। সেবার ১১ জুন, চট্টগ্রামের আকাশ ভারী হয়ে এসেছিলে মৃতের স্বজনদের আর্তনাদে। মারা গিয়েছিল ১২৭ জন মানুস। রাষ্ট্র, প্রশাসন তখনও সচেতন হয়নি। এর পর নিয়ম করে প্রতি বছরই ছোটখাট ও মাঝারি বেশ কিছু ধসের ঘটনা ঘেটেছে। সমস্ত অঞ্চলটির পরিবেশগত সংস্কৃতির দিকে লক্ষ্যমাত্রা না-করে কেবল নির্মাণ করা হয়েছে নানা স্থাপনা, সিন্ডিকেটের জোরে পাহাড়কে সর্বনাশের মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে। নদী, অরণ্য, পাহাড়ের র সম্ভ্রম ধ্বংস করলে, যথেচ্ছ নিয়মভঙ্গ করলে শাস্তি পেতে হয়। আমরা এখন তা পাচ্ছি। সাম্প্রতিক ঘটনা বিপদসংকেত মাত্র। আরো বড় ধংসলিলা হয়তো অপেক্ষা করছে।
এই ধসের কারণে দুর্ভাগ্য কবলিত পরিবারগুলোতে যে শোকের মাতম চলছে, অমূল্য প্রাণহানি ঘটেছে তার দায় একশ্রেণীর লোভী ও অপরিণামদর্শী মানুষের, যারা আইন-কানুন মানে না, নিয়ম-নীতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পেশীশক্তির জোরে এবং নানামহলকে বগলদাবা করার কৌশল করে নিজেদের লোব চরিতার্থ করার কাজ অব্যাহত রেখে চলেছে। এদের আইনের শাসনে শাসিত করে কেনো যে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না, কেনো যে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে নিবৃত্ত করার কোনো উদাহরণ করা হচ্ছে না, তা এক বিস্ময়ের বিষয়!
পাহাড়-কাটা বন্ধ করা এবং বিপজ্জনক পাহাড়-কাটা অংশে বসতি স্থাপন নিষিদ্ধ করা হলেও এই সমস্ত অবৈধ কাজ এখনো অব্যাহত রয়েছে। এর ফলে মানুষের জীবনের নিরাপত্তাহীনতা বারে বারে এমন মর্মন্তুদ ঘটনার জন্ম দিচ্ছে। আমরা চাই, কঠোরভাবে এই অনিয়মের বিরুদ্ধে এবং আইন-কানুন উপেক্ষার বিরুদ্ধে, প্রশাসন দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ নিয়ে মানুষের প্রাণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন। আসলে নিয়তির জালেই যেন পাহাড়ের মানুষের জীবন বন্দি। কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করে মৃত্যুকূপ থেকে পাহাড়ের মানুষকে রক্ষা করা হবে, এটাই প্রত্যাশা। প্রতিবছরই আমরা চাপা লাশ দেখে আহ! উহ! করছি তো; করছিই। সেই কান্নার আওয়াজ যেন কিছুতেই ঢুকছে না দায়িত্বশীলদের কর্ণকুহরে।
হয়তো এখনও সময় আছে সংযত, স্বাভাবিক হওয়ার। ২০০৭ এর ঘটনায় উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন একটি কমিটি গঠন করেছিলো তৎকালীন সরকার। ওই কমিটির সদস্য ছিলেন এই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ। কমিটি পাহাড় ধসের ২৮ কারণ চিহ্নিত করেছিলো। রক্ষা ও ধস ঠেকাতে ৩৬ টি সুপারিশ করা হয়েছিলো। ১০ বছরেও সেসব সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়নি। এখন গুরুত্ব দিতে হবে পাহাড় সংরক্ষণে। পাহাড়কে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ করছে দখলদারদের পাহাড় চুরি। পাহাড়কে বাজারে বিক্রি করায় পাহাড়ে হাউজিং, রিসোর্টের নামে অবাধ বাণিজ্য চলছে। এসব বন্ধ করতে প্রশাসনিক ব্যবস্থাগ্রহণ জরুরি। পাহাড়কে রাষ্ট্রীয় সম্পদ হিসেবে সংরক্ষণ করতে হবে, এর কোন বিকল্প নেই।
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা: পরিচালক (বার্তা), একাত্তর টিভি