বাস ভাড়ায় ঈদ বোনাস

প্রকাশ | ২৫ জুন ২০১৭, ১৬:৩০ | আপডেট: ২৫ জুন ২০১৭, ১৬:৩৬

এম গোলাম মোস্তফা ও তানিম আহমেদ

‘সারা বছর লস গুনছি, ঈদে এখন তুলছি’। বিআরটিএ চার্টের চেয়ে বাসের ভাড়া অতিরিক্ত নেয়ায় এক যাত্রীর করা অভিযোগের প্রেক্ষিতে এ কথা বলেন সায়েদাবাদ জোনাকি কাউন্টারের সহকারী ম্যানেজার জাকির। ঢাকাটাইমসকে তিনি বলেন, ‘সারা বছর আমরা বিআরটিএর নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে কম ভাড়ায় যাত্রী পরিবহন করে আসছি। সেই ক্ষতি পোষাতে ঈদের একটু বাড়তি ভাড়া আদায় করে সমন্বয় করছি।’

স্বজনদের সঙ্গে ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করতে গত কয়েকদিন থেকে গ্রামের পানে ছুটছে ঘরমুখি মানুষ। প্রতিটি বাস টার্মিনালে গেলে চোখে পড়ে জনতার স্রোত। যে করেই হোক বাড়ি যাওয়াই সবার লক্ষ্য। বাড়ি যাওয়ার জন্য যারা আগে থেকে টিকিট কাটেননি প্রতিটি বাস টার্মিনালে তাদের টিকিট কাউন্টারগুলোতে ছুটতে দেখা যায়। অনেক কাউন্টারে টিকিট নেই বলে জানানো হলেও থেকে নেই বাড়ি ফেরা মানুষদের প্রচেষ্টা। অনেক চেষ্টার পর টিকিটের খোঁজ মিললেন দাম চাওয়া হচ্ছে দ্বিগুণের মতো।

সকাল ১১টার দিকে সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে গিয়ে এমন চিত্র লক্ষ্য করা গেছে। সেখানকার জোনাকি কাউন্টারে গিয়ে দেখা গেছে ঘরমুখো মানুষের উপচেপড়া ভিড়। লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন অনেক যাত্রী। ঠাসাঠাসির মধ্য থেকে দাঁড়িয়ে থাকা লক্ষীপুরগামী যাত্রী স্বপন ঢাকাটাইমসকে অভিযোগ করে বলেন, ‘সকাল থেকে দাঁড়িয়ে আছি, এখনো টিকিট পাইনি। আগে ২৫০ টাকা ভাড়া নেয়া হলেও আজ টিকিটের দাম নেয়া হচ্ছে ৪০০ টাকা। মনে হচ্ছে শ্রমিকদের ঈদ বোনাস দিতে তারা অতিরিক্ত টাকা আদায় করছে। ’

লাইনে না দাঁড়িয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন একটি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির বিবিএর ছাত্র নাফিস ইকবাল। অতিরিক্ত ভাড়া নেয়ার প্রতিবাদ করে তিনি ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘বিআরটিএর টানানো চার্টে ভাড়া লেখা রয়েছে ৩৩০ টাকা। অথচ যাত্রীদের পকেট কেটে নিয়মের বাহিরে তারা আদায় করছেন ৪০০ টাকা।’

সায়েদাবাদ টার্মিনাল থেকে ছেড়ে যাওয়া বাসগুলিই নিম্ন আয়ের মানুষের বাড়ি যাওয়ার অবলম্বন। ঈদে যাত্রীদের অতিরিক্ত চাপের সুযোগে অতিরিক্ত ভাড়া শুধু জোনাকী সার্ভিসই আদায় করছে তা নয়। তাদের মতো তিশা পরিবহন, জননী সার্ভিসসহ সায়েদাবাদ থেকে ছেড়ে যাওয়া প্রায় সকল পূর্বাঞ্চলের পরিবহনেই আদায় করা হচ্ছে অতিরিক্ত ভাড়া।

অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ে পিছিয়ে নেই সায়দাবাদ থেকে গাইবান্ধাগামী বাসগুলোও। এখান থেকে এই পথ ব্যবহারকারী অনেক বাসে দুইশ টাকার ভাড়া পাঁচশ থেকে এক হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করা হচ্ছে। ভাই বন্ধু পরিবহন, সাফা পরিবহন, সৈকত পরিবহনসহ অনেক বাস সায়েদাবাদ থেকে গাইবান্ধা যায়। নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য চলাচল করা বাসগুলোতে অন্যান্য সময় দেড়শ থেকে দুইশ টাকা ভাড়া নেয়া হতো। কিন্তু ঈদে যাত্রী চাপের সুযোগে প্রায় সকল বাসেই যাত্রীদের গুণতে হচ্ছে অতিরিক্ত ভাড়া।

রবিবার সায়েদাবাদে সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ঈদযাত্রার সম্ভাব্য শেষ দিনে সকাল থেকে কাউন্টারগুলোতে ঘরমুখো মানুষের প্রচণ্ড ভিড়। বাসগুলির গেটেই দেয়া হচ্ছে টিকিট।

ঈদে যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া নিয়ে কঠোর ব্যবস্তা নেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। কিন্তু সরেজমিনে গিয়ে মন্ত্রীর সেই বক্তব্যের প্রতিফলন দেখা যায়নি। মন্ত্রীর বক্তব্য উপেক্ষা করে যাত্রীদের কাছ থেকে নিজেদের ইচ্ছামতো ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। ভাড়ার বিষয়টি মনিটরিং করতে সায়েদাবাদে বসানো ভিজিল্যান্স ক্যাম্পের কাছে জানতে চাওয়া হলে তারা অতিরিক্ত ভাড়ার বিষয়ে কোনো অভিযোগ পাননি বলে জানান।

জানতে চাইলে জোনাকির কাউন্টারের ম্যানেজার খবির উদ্দিন ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘বিআরটিএর নির্ধারিত ভাড়ায় টিকিট নিলে গাড়ি চালাবো কীভাবে? যাওয়ার সময়গাড়ি ভরে যায়, কিন্তু আসার পথে তো খালি গাড়ি ফেরত আসতে হয় ঢাকায়, এই খরচ দিবে কে? এজন্য এখন একটু বেশি ভাড়া নিচ্ছি।’

জানতে চাইলে বিআরটিএর সায়েদাবাদ ভিজিলেন্স ক্যাম্পের দায়িত্বরত মোটরযান পরিদর্শক শেখ মো. রাজিবুল ইসলাম ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘বিআরটিএ গত ২০ তারিখ থেকে প্রত্যেক বাসস্ট্যান্ডে অতিরিক্ত ভাড়া ও অনিয়মের ঠেকাতে তৎপর রয়েছে। কেউ বেশি ভাড়া নিচ্ছে এই ধরনের অভিযোগ আমার জানা নেই। যেসব পরিবহনে অতিরিক্ত ভাড়া নেয়া হচ্ছে তাদের নাম বলেন, বিষয়টি আমি দেখবো।’

গত কয়েকদিন ধরে বিআরটিএ অভিযান চালিয়ে ভাড়া আদায়ের অনিয়মের অভিযোগে বিশ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে বলেও জানান বিআরটিএর এই কর্মকর্তা।

শুধু সায়েবাদ নয়, মহাখালী বাসস্ট্যান্ডে গিয়েও অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের চিত্র পাওয়া গেছে। এই টার্মিনাল থেকেও দূরপাল্লার অনেক বাসে নির্ধারিত ভাড়া চেয়েও বেশি ভাড়া নেয়ার অভিযোগ করছেন অনেক যাত্রী। তবে পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকায় ফেরার সময় খালি গাড়ি নিয়ে আসতে হয়। তাই ক্ষতি পুষিয়ে নিতেই ভাড়া কিছুটা বেশি নেয়া হচ্ছে।

রাজধানীর মহাখালী বাস টার্মিনাল ঘুরে দেখা গেছে, ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটে চলাচলকারী এনা পরিবহন ছাড়া প্রায় সব বাসই আগের চেয়ে বেশি ভাড়া নিচ্ছে। রুটভেদে ভাড়া ২০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত বেশি নেয়া হচ্ছে।

ঢাকা-জামালপুর রুটে মহানগর পরিবহনে ভাড়া নেয়া হচ্ছে ৫০০ টাকা, ঈদের আগে যা ছিল ৩০০ টাকা। ভাড়া বেশি নেয়ার কারণ জানতে চাইলে কাউন্টার ম্যানেজার বলেন, ঈদের মৌসুম। আসার সময় যাত্রী পাওয়া যাবে না। তাই এখন ভাড়া একটু বেশি নেয়া হচ্ছে। তার মতো উত্তরা এরাবিয়ান পরিবহনের কাউন্টার ম্যানেজারও একই কথা বলেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি জাতীয় দৈনিকের একজন প্রতিনিধি বলেন, জামালপুর রুটে পরিবহনগুলোর কাছে আমরা জিম্মি। এখন তারা সিটিং করে নিবে। আবার রাস্তা থেকে লোক উঠাবে। পরিস্থিতি এমন হয় যে দাঁড়ানো যাত্রীর কারণে আমাদের বসে থাকাও মুশকিল হয়ে পড়ে।

ঢাকা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া রুটের উত্তরা এরাবিয়ানে ভাড়া নেয়া হচ্ছে ৩০০ টাকা। এ রুটে নির্ধারিত ভাড়া ছিলো ১৭০ টাকা। ঢাকা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া রুটের তিতাস পরিবহনে ভাড়া নেয়া হচ্ছে ২০০ টাকা। এ রুটে ইকনো পরিবহনে টিকেট বিক্রি বন্ধ রয়েছে।

এ রুটের যাত্রীরা অভিযোগ করছেন, ঢাকা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া রুটে চলাচলকারী ইকোনো সার্ভিসের টিকেট দেয়া বন্ধ থাকায় উত্তরা এরাবিয়ান পরিবহনের ভাড়া ভাড়ানো হয়েছে।

আবুল হাশেস নামে একজন যাত্রী বলেন, ‘কি করবো। পরিবারের সঙ্গে ঈদ করতে যাবো। ভাড়া বেশি হলে হলেও যেতে হবে। আমাদের কিছু করার নেই।’

ঢাকা-কিশোরগঞ্জ-হোসেনপুর রুটে ভাড়া নেয়া হচ্ছে ২২০ থেকে ২৫০ টাকা পর্যন্ত। অথচ আগে এই রুটে ভাড়া ছিল ১৮০ থেকে ২০০ টাকা। শুধুমাত্র ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটে চলা এনা পরিবহন আগের ২২০ টাকাই আদায় করছে।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘বাস টার্মিনালে আমাদের টিম রয়েছে। অভিযোগ পেলে আমরা ব্যবস্থা নিবো।’

ঢাকাটাইমস/২৫জুন/জিএম/টিএ/এমআর