আপাতত ‘আইএস’ ভূত তাড়ানোই বাংলাদেশের বড় সাফল্য

প্রকাশ | ০৪ জুলাই ২০১৭, ০৮:২৯

শেখ আদনান ফাহাদ

সন্ত্রাসবাদ বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়। জন্মলগ্ন থেকেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয়, রাজনৈতিক ও ধর্মের নামে সন্ত্রাসবাদ সংঘটিত হতে দেখেছে। যেমন স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিবাহিনীর কর্মকাণ্ড রাজনৈতিক সন্ত্রাসবাদের বড় উদাহরণ; ভারতে যেমন আছে মাওবাদী তৎপরতা। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের সাধারণ বাঙালিদের উপর সেনাবাহিনীর হামলা ও গণহত্যা হল রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদের নজির। ইরাকে আগ্রাসন চালিয়ে শাসক সাদ্দাম হোসেনকে হত্যা করেও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদের বড় নমুনা সৃষ্টি করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তবে সবকিছু ছাপিয়ে আমাদের কাছে বড় হয়ে উঠেছে, ধর্মকে ব্যবহার করে সৃষ্ট সন্ত্রাসবাদ। নানা টাইপের সন্ত্রাসবাদী তৎপরতায় পুরো বিশ্বই এখন কোনো না কোনো মাত্রায় আক্রান্ত হয়েছে।  

কিন্তু সব সমস্যা ছাপিয়ে আমাদের কাছে প্রধান করে তোলা হয়েছে ‘ইসলাম’, ‘মুসলিম’, ‘জিহাদি’ কিংবা ‘মুজাহেদিন’ ইত্যাদি শব্দকে উপজীব্য করে পরিচালিত ও প্রচারিত সন্ত্রাসবাদ। আর এই অপকর্মে যে নামটি টেররিস্ট নেটওয়ার্ক ও গণমাধ্যম কর্তৃক ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, সেটি হল আইএস বা দায়েস। আইএস এর অফিস কোথায় কেউ জানে না, এদের অস্ত্র কে দেয় কেউ জানেনা, আইএস এর ট্রেনিং ক্যাম্প কোথায় কেউ জানে না।

ঢাকায় হোক আর লন্ডনে হোক, সবখানে আইএস আছে। উত্তরবঙ্গের  একটি জেলায় জাপানের নাগরিক হত্যা হলেও আইএস স্বীকারোক্তি দেয়, আবার ম্যানচেস্টারে হামলা হলেও আইএস স্বীকারোক্তি দেয়। এখন শুধু আইএস এর নাম শোনা যায়, আগে শোনা যেত আল-কায়েদার নাম। যুক্তরাষ্ট্রের বুশ পরিবারের একসময়কার ব্যবসায়িক পার্টনার ওসামা বিন লাদেনের আল-কায়েদার এখন কী অবস্থা, আমরা জানি না। জানার উপায় নেই, কারণ বিবিসি, সিএনএন, এপি, রয়টার্স, এএফপি এখন আর আল-কায়েদার সংবাদ দেয় না।

আল-কায়েদাতো আর আমাদের কাছে এসে ভিডিও ফুটেজ দিত না, ফলে জানার উপায় নেই। এখন যেমন আইএস বার্তা পাঠায় যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক রিটা কাটজ কর্তৃক পরিচালিত প্রতিষ্ঠান সাইট ইন্টিলিজেন্স। ঢাকা, রংপুরের ‘আইএস’ এর সাথে সরাসরি যোগাযোগ ওয়াশিংটন-ভিত্তিক সাইট ইন্টিলিজেন্স এর সাথে! ভাবতে কেমন অদ্ভুত লাগে!       

সন্ত্রাসবাদ বহু আগে থেকেই ছিল বাংলাদেশে। মূলত স্বাধীনতাবিরোধী, ধর্মাশ্রয়ী রাজনৈতিক শক্তিগুলোর আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় অভিভাবকদের আর্থিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদ সৃষ্টি হয়েছে। সন্ত্রাসবাদের বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট বুঝে উঠতে না পেরে, স্থানীয় অপরিপক্ক মিডিয়ার অপরিণামদর্শী প্রচারে সরল আওয়াম ধর্মকে এখানে প্রধান উপজীব্য হিসেবে ভাবতে শিখে গেলেও রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট আড়ালেই থেকে গেছে। আল-কায়েদা এবং আইএস ইস্যুতে যেভাবে বিশ্বজুড়ে মানুষের মগজ ধোলাই করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সামরিক, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক শক্তি আধিপত্য বিস্তার করেছে তাতে সকলের সতর্ক হওয়ার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। কারণ বর্তমান আর ইতিহাস খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে জড়িয়ে আছে।

সাম্প্রতিক বিশ্বে একটি ধোঁয়াশার নাম হল ‘আইএস’। এর আগে আমরা বিবিসি,  সিএনএন, এপি, এএফপি, রয়টার্সে এবং এদের বদৌলতে বিশ্বের প্রায় সব পরিচিত সংবাদমাধ্যমে অবিরাম আল-কায়েদার নাম শুনেছি, পড়েছি। এখন আর আল-কায়েদার নাম শোনা যায় না। কারণ পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলো আল-কায়েদাভিত্তিক সংবাদ আর দেয় না। এখন নতুন ধারণা আইএস’র প্রচার ও প্রসার চলছে।

আল-কায়েদার আইডিয়া ব্যবহার করে আফগানিস্তান এবং ইরাকের পাইপলাইনগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেয়া হয়ে গেছে। মধ্যপ্রাচ্যে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ নেয়া যাচ্ছে না সিরিয়া এবং ইরানের জন্য। তাছাড়া সিরিয়া এবং ইরান উভয় রাষ্ট্রই জোর করে বানানো রাষ্ট্র ইসরায়েলের জন্য হুমকি। বর্ধিত ইসরায়েলের অমানবিক স্বপ্ন বাস্তবায়ন এবং মধ্যপ্রাচ্যের স্বাধীনচেতা রাষ্ট্রনেতা ও রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে নিশ্চিহ্ন করতে একটা যুৎসই আইডিয়া হিসেবে কাজ করছে ‘আইএস’।

সিরিয়া সংকটের দিকেই মনোনিবেশ করুন, আইএসের ধারণা আমাদের সামনে পরিস্কার হয়ে যাবে। রাশিয়া যখন বাশার আল আসাদের পক্ষে ‘আইএস’ মেরেছে বলে দাবি করে, তখন পশ্চিমা মিডিয়া নিউজ প্রচার করে ‘রাশিয়ার বিমান হামলায় বেসামরিক মানুষ নিহত। সিরিয়ার সেনাবাহিনী যখন ‘আইএস’ মারে, তখনো একই শব্দ আর ভাষার ব্যবহার থাকে। আবার ন্যাটো বাহিনী যখন হামলা করে সাধারণ মানুষ ও আসাদের বৈধ সেনাসদস্যদের হত্যা করে তখন প্রচার করা হয় ‘আইএস জঙ্গি নিহত’।   

বাংলাদেশে ইটালিয়ান বা জাপানি নাগরিক হত্যার পরে ‘আইএস’ স্বীকারোক্তি দিয়েছে। গুলশানের হলি বেকারির ঘটনায়ও আইএস স্বীকারোক্তি দিয়ে বিবৃতি দিয়েছে। খেয়াল করার বিষয় হল, আইএস এর বিবৃতি প্রচার করেছে সাইট ইন্টিলিজেন্স নামের একটি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান যার প্রতিষ্ঠাতা রিটা কাটজ নামের এই ইরাকি বংশোদ্ভূত আমেরিকান। তার বাবা ছিল ইসরায়েলের গোয়েন্দা। সাদ্দাম হোসেন ক্ষমতায় আসার পর ইরাকবিরোধী কাজে জড়িত থাকায় এবং ইসরায়েলের পক্ষে গোয়েন্দাবৃত্তি করায় তার ফাঁসি হয়।

এরপর এই নারী যান ইরানে, সেখান থেকে ইসরায়েলে। তেলআবিব বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেন। জায়নিস্ট আন্দোলনে যোগ দেন। মুসলিম নারীর ছদ্মবেশে এমনকি বোরকা পরে অনেক ইসলামি প্রোগ্রামে, মসজিদে গেছেন, ফান্ড রেইজ করেছেন, র‍্যালি করেছেন ইসরায়েলের বিরুদ্ধে। এইভাবে হামাস এবং অন্য জিহাদি সংগঠনের ভেতরের তথ্য সংগ্রহ করেছে। জন্মসূত্রে ইরাকি হওয়ায় চোস্ত আরবি বলতে পারতেন। ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের এজেন্ট এই রিটা কাটজের প্রতিষ্ঠান সাইট ইন্টিলিজেন্স এর সরবরাহকৃত ‘সংবাদ’ বিবিসি-সিএনএন জাতীয় সংবাদমাধ্যমের অনুকরণে আমাদের মিডিয়াও অন্ধের মত প্রচার করে চলেছে। কয়েকদিন আগে শুনলাম, রিটা অন্য বিশেষ দায়িত্ব নিয়ে সাইট ইন্টিলিজেন্স ছেড়ে দিয়েছেন।

এখন অনেকের প্রশ্ন হল, আইএস হঠাৎ করে বাংলাদেশে সক্রিয় হতে চাইল কেন? উত্তর খুব কঠিন নয়। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আছে টানা আট বছর। এই আটবছরে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জন হয়েছে ভালো। তারচেয়েও বড় অর্জন জামায়াত এবং অন্যান্য দলের যুদ্ধপরাধীদের অনেকের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। বিশেষ করে জামায়াতের অস্তিত্ব এখন হুমকির মুখে। ১৯৭১ সালেও জামায়াত এবং পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের আন্তর্জাতিক অভিভাবক ছিল যুক্তরাষ্ট্র।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকালীন, আগে ও পরে এই জামায়াত, পাকিস্তান এবং যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাও আমরা সকলেই জানি। আমরা এও জানি, আওয়ামী লীগ সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য পশ্চিমা শক্তিতে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে টানা দ্বিতীয়বারের মত রাষ্ট্র পরিচালনা করছে। পদ্মাসেতু ইস্যুতে বিশ্বব্যাংক এবং জিএসপি সুবিধা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আচরণ বিশ্লেষণ করলে বলতে অসুবিধা নেই যে, ভারত ও রাশিয়ার সাহায্য পেয়ে আওয়ামী লীগ সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে একপ্রকার স্নায়ুযুদ্ধের মধ্যে আছে।

১৯৭১ সালে এই রাশিয়া, তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন আমাদের পক্ষে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে জাতিসংঘে ভেটো দিয়ে আমাদের স্বাধীনতাকে তরান্বিত করেছিল। ভারত তো আমাদের সাথে ছিলই। মূলত ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্মই হয়েছে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের পটভূমিতে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর অনেক ভাষণ-বক্তৃতায় সাম্রাজ্যবাদের বিষয়টি পরিষ্কার করেছেন। আশার কথা হল, শেখ হাসিনার সরকার আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এখন সঠিকভাবে বঙ্গবন্ধুর বাতলে দেয়া পথে আছে।

গত আট বছরে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ অনেক শক্তি অর্জন করেছে এবং এই অর্জন সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গিয়েই হয়েছে। পদ্মাসেতু ইস্যুতে শেখ হাসিনার সরকার যে সাহস ও সাফল্য দেখিয়েছে তাতে করে সাম্রাজ্যবাদী যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের এদেশীয় দোসরদের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। 

১৯৭১, ১৯৭৫ এবং বর্তমান সময় মিলিয়ে দেখুন, হিসাব স্পষ্ট হয়ে যাবে। বাংলাদেশের জন্মই হয়েছে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে পরাজিত করে। এর প্রতিশোধ নিতে হেন কোনো চেষ্টা নেই, এই পশ্চিমারা করেনি। বঙ্গবন্ধু হত্যা, হত্যাকারীদের নিরাপদে পালিয়ে যেতে সাহায্য করার পেছনে সরাসরি এদের হাত ছিল। শেখ হাসিনাকেও হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে বহুবার। তখন আইএস ধারণা ছিল না, থাকলে হয়ত আইএস স্বীকারোক্তি দিত! এতে প্রকৃত অপরাধী ধরা মুশকিল হয়ে যেত! আইএস এর কাজই হল প্রকৃত অপরাধীকে আড়াল করতে বিবৃতি দেয়া।   

তাহলে আইএস সৃষ্টি করেছে কারা? এই আইএস বাংলাদেশে আমদানি করল কারা? হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির গবেষক গারিকাই চেঙ্গু কানাডা-ভিত্তিক গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল রিসার্চ এর ওয়েবসাইটে এক নিবন্ধে লিখেছেন, ‘আল-কায়েদার মত আইএস সৃষ্টির পেছনে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েলের ভূমিকা প্রধান। তেল-সমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যকে ভেঙে ফেলা এবং ইরানের ক্রমবর্ধমান প্রভাব খর্ব করার জন্য আইএস এর সৃষ্টি করা হয়েছে। যারা ইতিহাস পড়ে না, শুধু চলমান সংবাদ দেখে তাদের কাছে সন্ত্রাসবাদ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক অবিশ্বাস্য মনে হতে পার।’

১৯৭০ এর দশকে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ মিশরে সোভিয়েত প্রভাব খর্ব এবং মার্কসবাদী আদর্শের বিস্তার রোধ করতে মুসলিম ব্রাদারহুড নামক সংগঠনকে ব্যবহার করেছে। ইন্দোনেশিয়ায় সুকর্ন সরকারকে হটাতে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি ‘সারেকাত ইসলাম’ নামক জঙ্গি সংগঠনকে সমর্থন করেছে। জুলফিকার আলী ভূট্টোর বিরুদ্ধে জামায়াত-ই-ইসলামিকে ব্যবহার করেছে। আল-কায়েদা ও আইএসও এমনই মার্কিন সৃষ্ট নেটওয়ার্ক বলে গবেষক গারিকাই চেঙ্গু বর্ণনা করেছেন।

১৯৮০ এর দশকে সিআইএ ওসামা বিন লাদেনকে পৃষ্ঠপোষকতা শুরু করে। সাবেক ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবিন কুক হাউস অব কমন্স এ একবার বলেছিলেন, আল-কায়েদা প্রশ্নাতীতভাবে পশ্চিমা গোয়েন্দা বাহিনীগুলোর সৃষ্টি। রবিন কুক ব্যাখা দিয়ে বলেছিলেন, আরবিতে আল-কায়েদা শব্দের অর্থ হল, ডাটাবেজ। আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নকে পরাজিত করতে সিআইএ এবং সৌদি আরবের যৌথ প্রকল্পের অধীনে যে হাজার হাজার জঙ্গি তৈরি করা হয়েছিল, তাদেরকে নিয়েই কাজ শুরু করে আল-কায়েদা (http://www.globalresearch.ca/america-created-al-qaeda-and-the-isis-terror-group/5402881)।

আইএস সৃষ্টির পেছনের সব রহস্য ফাঁস করে দিতে চেয়েছিলেন মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তা ও কম্পিউটার প্রফেশনাল এডওয়ার্ড স্নোডেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক গোপন অপকর্মের খবর ফাঁস করে দিয়ে বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন তিনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে পালিয়ে তিনি কয়েক বছর হল রাশিয়ায় আশ্রয় নিয়েছেন। এই এডওয়ার্ড স্নোডেন আইএস সৃষ্টির পেছনে সিআইএ এবং ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের ভূমিকার কথা তিনি কেবল ফাঁস করতে শুরু করেছিলেন।  ইরানের ইংলিশ দৈনিক তেহরান টাইমস এর বরাত দিয়ে টাইম ম্যাগাজিনে আরিয়ান বাকের নামের এক সাংবাদিক জুলাই ১৯, ২০১৪ তারিখে এক বড় প্রতিবেদন লিখেন (http://time.com/2992269/isis-is-an-american-plot-says-iran/)।

সেখানে বলা হয়, ইরান বিশ্বাস করে এবং ইরানের কাছে প্রমাণ আছে যে, ইসরায়েলকে রক্ষা করতেই সিআইএ এবং মোসাদ মিলে আইএস সৃষ্টি করেছে। তেহরান টাইমস এ প্রথম প্রকাশিত সেই প্রতিবেদনটি এডওয়ার্ড স্নোডেন এর ইন্টার্ভিউ নিয়ে প্রস্তুত করে ইরান-ভিত্তিক বার্তাসংস্থা ইরনা। স্নোডেন সে ইন্টারভিউতে জানিয়েছিলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এবং ইসরায়েলি গোয়েন্দারা এমন একটি সন্ত্রাসী নেটওয়ার্কের পরিকল্পনা করেছে যাতে সারা বিশ্বেই নানা সময়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতে পারে।

এই পরিকল্পনার কোড নাম ছিল,’বীহিভ (Beehive)। আরেকটি ব্যাখ্যায় এই পরিকল্পনার নাম ছিল ‘Hornet’s Nest’, অথচ আমাদের মিডিয়া কী অবলীলায় সাইট ইন্টিলিজেন্স এর বিবৃতি প্রচার করে যাচ্ছে!

বাংলাদেশে আইএস আছে প্রমাণ করার জন্য পশ্চিমা কিছু শক্তির সাথে স্থানীয় কিছু মিডিয়া উঠেপড়ে লেগেছে। তবে পুলিশ এবং অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করার পাশাপাশি সরকার কাউন্টার পলিটিক্সেও সরকার আপাতত সফল হয়েছে বলা যায়। এদেশে আইএস আছে প্রমাণ করতে পারলে পশ্চিমা শক্তিগুলোর সুবিধা,  কূটনৈতিক এবং অন্যান্য হস্তক্ষেপ করার পথ সুগম হয়। অন্যদিকে আইএস এদেশে আছে এটা স্বীকার করলে ব্যর্থ রাষ্ট্র হওয়ার তালিকায় উঠে যাবে বাংলাদেশ। ফলে শুধু বুলেট দিয়ে নয়, বুদ্ধি দিয়েও সরকারকে কাজ করতে হচ্ছে।

গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে সন্ত্রাসী হামলার ভয়াবহতা সরকার ও জনগণ, সর্বস্তরকে ভয় ধরিয়ে দেয়। দেখতে দেখতে এই নিষ্ঠুর হামলার এক বছর সময় পার হয়েছে। অনেক আলোচনা-সমালোচনা চলছে। মূল্যায়ন চলছে সন্ত্রাসবাদ দমনে বাংলাদেশের সাফল্য-ব্যর্থতার। বলা যায়, ‘সন্ত্রাসী’ দমনে বাংলাদেশ যতখানি সাফল্য প্রদর্শন করেছে, সন্ত্রাসবাদ দমনে ততখানি নয়।  কিছু সন্ত্রাসী, সন্ত্রাসী-আস্তানা ধ্বংস করা গেলেও নতুন করে নতুন আস্তানা, নতুন সন্ত্রাসী সৃষ্টি হচ্ছে। কারণ সন্ত্রাসবাদ শুধু বুলেট-বোমার বিষয় নয়। সন্ত্রাসবাদ একটি মনস্তাত্ত্বিক ও মতাদর্শিক  প্রক্রিয়া। ফলে বুলেট দিয়ে সন্ত্রাসী মারা গেলেও এই অর্জন সাময়িক। দীর্ঘমেয়াদে সন্ত্রাসবাদকে জয় করতে হলে প্রয়োজন সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক সংস্কার।

বাংলাদেশের সাম্প্রতিককালে সন্ত্রাসী হামলাগুলোর সাথে জড়িত সন্ত্রাসীদের বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, মূলত সাংস্কৃতিকভাবে এবং অর্থনৈতিকভাবে এলিয়েনেটেড মানুষই সন্ত্রাসবাদে জড়িয়ে পড়ছে। এতিমখানা বা বস্তির ছেলে-মেয়েরা যেমন সন্ত্রাসী হতে পারে, আবার একেবারে উচ্চ সমাজের ছেলে-মেয়েরাও সন্ত্রাসী হতে পারে। গুলশানের ঘটনায় সন্ত্রাসী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল বাংলাদেশের ‘উচ্চশিক্ষিত’, ইংলিশ জানা, পশ্চিমা হলিউডি স্টাইলে বড় হওয়া ছেলেগুলো। অন্যদিকে অন্যান্য অনেক ঘটনায় আমরা দেখেছি, গরিব, এতিমখানা বা নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে আসা ছেলে-মেয়েরা সন্ত্রাসী হয়েছে। সন্ত্রাসবাদ একপ্রকার মেন্টাল গেইম, মগজ ধোলাইয়ের ফসল। মগজ ধোলাই তাদেরই করা সম্ভব যারা দারিদ্র কিংবা অসুস্থ অর্থনৈতিক বাস্তবতা থেকে এসেছে। খেয়াল করে দেখবেন, বাংলাদেশে যাদেরকে আমরা সন্ত্রাসী হিসেবে সংবাদমাধ্যমের বদৌলতে দেখেছি তাদের বেশিরভাগ হয় মাদ্রাসা অথবা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল থেকে এসেছে।

সাধারণ লাইনে পড়াশুনা করা ছেলে-মেয়েদের অংশগ্রহণ খুব কম। আরেকটি বিষয় হল, দেশের অর্থনীতি,  রাজনীতি, প্রশাসন এবং খেলাধুলায় এই সাধারণ লাইনে পড়াশুনা করা ছেলে-মেয়েরাই নেতৃত্ব দিচ্ছে। সর্বত্র দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার অস্তিত্ব থাকলেও বাংলাদেশের বর্তমান অগ্রযাত্রায় এই প্রাথমিক, হাইস্কুল, কলেজ এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছেলে-মেয়েরাই কাজ করছে। অন্যদিকে মাদ্রাসা এবং ইংলিশ পড়ুয়ারা ভিন্ন ভিন্ন বাস্তবতা এবং সামর্থ্য থাকলেও দেশের উন্নয়নের কাজে তেমন কাজে আসছে না।

মাদ্রাসায় পড়ুয়ারা পারছে না দক্ষতার অভাবে আর ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ুয়ারা আসতে পারাছে না পশ্চিমা সভ্যতাপ্রীতির জন্য। জাতি গঠন প্রক্রিয়ায় এমন আরও অনেক ফাঁক ফোকর থাকার ফলে বাংলাদেশ কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারছে না।

আমাদের মনে ও মগজে অনেক ভুল ধারণা এবং বিশ্বাস। অন্যকে জেনে-বুঝে নিজেকেও চেনার ইচ্ছে আমাদের কম। এইজন্য মনোজগতের উপনিবেশ থেকে আমরা বের হতে পারিনা। বের হওয়া সহজ নয়। কারণ সাম্রাজ্যবাদী পশ্চিমাগোষ্ঠীর প্রচারযন্ত্র হিসেবে কাজ করে চলেছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বড় গণমাধ্যমগুলো। এক্ষেত্রে দেশীয় সংবাদমাধ্যম, লেখক, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্তাব্যক্তিদের সন্ত্রাসবাদের স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা রাখা বাঞ্ছনীয়। বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদ সক্রিয়, এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। গভীরে বিদেশি শক্তির হাত থাকলেও প্রকাশ্যে কিন্তু ধরা পড়ছে, নিহত হচ্ছে এদেশেরই মানুষ। বিদেশ থেকে অস্ত্র আসছে, অর্থ আসছে। আর সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন ছেলে-মেয়েদেরকে সন্ত্রাসী হিসেবে রিক্রুট করা হচ্ছে। এই পথগুলো বন্ধ করতে হবে। সব সামাজিক-অর্থনৈতিক ফাঁকফোকর বন্ধ করতে হলে এদেশের রাজনীতিবিদ এবং আমলাদের শতভাগ সৎ হয়ে একটি সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে প্রজন্মকে তৈরি করতে হবে।

লেখকঃ শিক্ষক, সাংবাদিক