‘নির্বাসিত ক্রিকেট’ রক্ষায় এগিয়ে এসেছিলেন শেখ কামাল

প্রকাশ | ১৪ আগস্ট ২০১৭, ১৬:৪৬ | আপডেট: ১৪ আগস্ট ২০১৭, ১৬:৫০

লিয়াকত আলী ভূঁইয়া
লিয়াকত আলী ভূঁইয়া

বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে শেখ কামাল একজন স্বপ্নদ্রষ্টার নাম। তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন দেশের ক্রীড়াঙ্গনকে আধুনিকায়নের। রাজনৈতিক পরিবারে জন্মগ্রহণ। বৈরী রাজনৈতিক ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে বেড়ে ওঠা। রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হয়েও রাজনীতির চেয়ে খেলাধুলাই বেশি প্রাধান্য পেয়েছিল তার কাছে। নিজে ছিলেন একজন ক্রীড়াবিদ। ক্রীড়া সংগঠক। ক্রিকেট খেলেছেন মোটামুটি ভালো পর্যায়ে। খেলেছেন বাস্কেটবল। তার অপরিসীম ভালোবাসা ছিল ফুটবলে। খেলাধুলার প্রতি তার এই ভালোবাসা এদেশের ক্রীড়াঙ্গনে লেগেছিল আধুনিকতার ছোঁয়া। ছিলেন সেতার বাদক ও নাট্যব্যক্তিত্ব। বলা যায় পরিপূর্ণ একজন ক্রীড়াপাগল মানুষ। কিন্তু কি দুর্ভাগ্য তার এবং এদেশের ক্রীড়াপ্রেমীদের। আধুনিক এই মানুষটিকে খুব বেশিদিন বেঁচে থাকতে দেওয়া হলো না। তিনি চলে গিয়ে রেখে গেলেন আবাহনী ক্লাবসহ অনেক প্রতিষ্ঠান, যা যুগ যুগ ধরে এদেশের খেলোয়াড় বানানোর সঙ্গে কোটি কোটি মানুষের খেলাধুলার প্রতি প্রেরণা এবং দেশের মানুষের আনন্দ জোগাবে।

আমি নিজে শেখ কামালের প্রজন্মের একজন লোক। ধানমন্ডির বাসিন্দা হওয়ায় কাছ থেকে হলেও শেখ কামালকে দেখার সুযোগ হয়েছিল। দেখেছি একজন খেলোয়াড় হিসেবে। দেখেছি একজন ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে। দেখেছি একজন প্রাণোচ্ছল তরুণ হিসেবে। শেখ কামালের মৃত্যুর এত বছর পর তাকে নিয়ে লিখতে বসে খানিকটা ব্যক্তিগত স্মৃতির কথা চলে আনছে। আমার বাবা ছিলেন পুলিশের পদস্থ কর্মকর্তা। সে সুবাদে দেশের বিভিন্ন জায়গায় থাকতে হতো আমাদের। একটা পর্যায়ে বাবার পোস্টিং হয় ঢাকাতে। আমরা থাকতাম ধানমন্ডিতে।

একদিন অনেকে মিলে প্র্যাকটিস করছিলেন। তার মধ্যে শেখ কামালও ছিলেন। আমি নেটের পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। শেখ কামালকে দেখে বলেছিলাম কামাল ভাই, আমি খেলতে চাই। সঙ্গে সঙ্গে আমাকে খেলার সুযোগ করে দিলেন। আমার কাছে এখনো অবাক লাগে, আমি অনেকটা কৌতূহলের বশে এ ধরনের আবদার করেছিলাম। মনে মনে ভেবেছিলাম হয়তো বা রাগ করবেন। কিন্তু তা নয়। তখনই আমি বুঝতে পারলাম যে, খেলার প্রতি তার আগ্রহের কথা। এ প্রসঙ্গে আরও একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। প্রায় প্রতিদিন আবাহনী মাঠে অনেক বাইরের লোক খেলাধুলা করতে আসে। রায়েরবাজারের জাহিদ (আমেরিকা প্রবাসী) একদিন আবাহনী পিচে ব্যাটিং প্র্যাকটিস করছিলেন, তখন অনেকেই মনে করেছিল কামাল ভাই হয়তো জাহিদকে তিরস্কার করবেন। কিন্তু দেখা গেল তার উল্টো। পরবর্তীতে কামাল ভাইকে বলা হয়েছিল জাহিদের কথা। তার উত্তর ছিল, জাহিদ খেলছে অন্য কিছু তো করছে না। এ কথায় বোঝা যায় যে, তার মনে একটাই কথা ছিল যদি একটি মানুষও খেলাধুলার ভেতরে থাকে, তাহলে অন্য কিছু চিন্তা করবে না। তিনি সব সময় পাড়ার ছেলেদের খেলাধুলার মধ্যে টেনে আনতে চেয়েছিলেন। সেটা ক্রিকেট হোক, ফুটবল হোক, বাস্কেটবল হোক, ব্যাডমিন্টন হোক। সবাই কিছু একটা খেলুক সেটা শেখ কামাল চেয়েছেন সবসময়। তবে তার চাওয়াটা শুধুমাত্র ধানমন্ডি এলাকার ছেলেমেয়েদের মধ্যে ছিল তাও নয়। আর সে কারণেই তিনি আবাহনী ক্রীড়াচক্র নামে একটি ক্লাব দাঁড় করতে পেরেছেন। শেখ কামাল প্রতিষ্ঠিত সেই আবাহনী আজ সারা দেশে অসংখ্য তরুণের প্রিয় ক্রীড়া প্রতিষ্ঠান।

সারা দেশে ছড়িয়ে আছে আবাহনীর শাখা- প্রশাখা। শুধু দেশে বলছি কেন, মাঝেমধ্যে আমেরিকায় যেতে হয়। সেখানেও দেখেছি আবাহনীর শাখা আছে। নিউইয়র্কে ক্রিকেট লীগ হয়, সেখানেও আবাহনী অংশগ্রহণ করছে। আবাহনীর নামটা দেশে-বিদেশে এত মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যায় তার একটা কারণ তো অবশ্যই আছে। জোর দিয়েই বলছি সেটা কোনো রাজনৈতিক কারণ নয়। শেখ কামাল রাজনৈতিকভাবে যে মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন, সেই মতাদর্শে বিশ্বাসী নয় তেমন অসংখ্য লোকের কাছে আবাহনী তাদের প্রাণের প্রতিষ্ঠান। কারণ আবাহনী এদেশের ক্রীড়াঙ্গনে আধুনিকতার ছোঁয়া দিয়ে বসে থাকেনি। এদেশের খেলাধুলায় তাদের সাফল্যও অনেক। তবে এই আবাহনীও অনেক রাজনৈতিক হয়রানি আর ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছে। তার একটাই কারণ এই ক্লাবটির প্রতিষ্ঠাতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুপুত্র শেখ কামাল। বঙ্গবন্ধুকে হেয় করার উদ্দেশ্যে কলঙ্কিত করার চেষ্টা হয়েছে তার ছেলেকে। কিন্তু সময়ের বিচারে সেটা সম্ভব হয়নি। কারণ একটা প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করা যায়। প্রজন্মের পর প্রজন্মকে করা যায় না। সে কারণেই শেখ কামাল যে স্বপ্ন দেখেছিলেন সেই স্বপ্নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। শেখ কামালের স্বপ্ন ছিল খেলাধুলার মধ্য দিয়ে গোটা বিশ্বে উড়বে বাংলাদেশের বিজয় পতাকা। আজ উড়াতে শুরু করেছে। আজ বাংলাদেশ ক্রিকেট বিশ্বকাপ খেলে, টেস্ট ক্রিকেট খেলছে। বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। আজ বাংলাদেশ ক্রিকেট দল ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে টেস্টে হারাচ্ছে। ওয়ানডেতে হারাচ্ছে অস্ট্রেলিয়া, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ আফ্রিকাকে।

সত্যি কথা হচ্ছে খেলাধুলার মধ্য নিয়ে যে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে এটা সেই অগ্রযাত্রার পথ নির্দেশিকা। খেলাধুলার মধ্য দিয়ে এভাবে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্নটা বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই দেখেছিলেন শেখ কামাল। বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে বলছি কেন, বলা উচিত বাংলাদেশের জন্মের আগেই শেখ কামাল এই স্বপ্ন দেখতে পেরেছিলেন। কারণ তিনি খেলাধুলার অঙ্গনের লোক ছিলেন। তাই মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের ক্যাম্পে ছুটে গেছেন তিনি। সে সময় তার বন্ধু-বান্ধবদের বারবার বলেছেন, দেশ স্বাধীন হোক আমরা নতুন ফুটবল দল গড়ব। নতুন ক্রিকেট দল গড়ব। নতুন করে সাজাবো ঢাকার ক্রীড়াঙ্গনকে। দেশ স্বাধীনের পর সে কাজটা শুরু করেছিলেন তিনি। জাতির জনকের পুত্র দেশের প্রধানমন্ত্রীর ছেলে হয়েও শেখ কামাল মেতে থাকতেন তার আবাহনী আর এদেশের ক্রীড়াঙ্গনকে নিয়ে। দেশের ইতিহাসে প্রথম বিদেশি ফুটবল কোচ নিয়োগ দিলেন তিনি আবাহনীর জন্য। দেশের ফুটবলে লাগানো আধুনিকতার ছোঁয়া এবং সেটা শেখ কামালের হাত ধরে।

এরপর যখন শুরু হলো ক্রিকেটকে নির্বাসিত করার চেষ্টা তখন প্রধানমন্ত্রীর ছেলে হিসেবে নয়, একজন ক্রিকেটার হিসেবে, একজন ক্রিকেট সংগঠক হিসেবে প্রধানমন্ত্রীসহ ক্রীড়া প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বোঝাতে পেরেছিলেন ক্রিকেট রাজার খেলা নয়, খেলার রাজা। সুতরাং ওটা বুর্জুয়াদের খেলা এই লেবেল এঁটে দিয়ে নির্বাসিত করা ঠিক হবে না। শেখ কামালের চিন্তা-ভাবনাটা যে একশভাগ সঠিক ছিল তা আজকের বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। এই দলে কজন বড়লোকের সন্তান আছেন? বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সাধারণ মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেরা বাংলাদেশ দলের প্রতিনিধিত্ব করছে। ক্রিকেট রাজার খেলা নয়, খেলার রাজা হয়েই থাকছে। একজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে তার স্বীকৃতি সময়ই দিয়ে দিয়েছে শেখ কামালকে।

ক্রীড়া সংগঠক শেখ কামালকে রাজনৈতিক অপবাদ দিতে গিয়ে তার ব্যক্তিজীবনকেও কলঙ্কিত করার অপচেষ্টা কম হয়নি। মাঠের মানুষ শেখ কামাল মাঠের একজনকেই বেছে নিয়েছিলেন জীবনসঙ্গিনী হিসেবে। বিয়ে করেছিলেন এদেশের ইতিহাসের অন্যতম সেরা মহিলা অ্যাথলেট সুলতানা খুকুকে। ভালোবাসা থেকে বিয়ে। কিন্তু দুর্ভাগ্য তাদের দাম্পত্য ইনিংস প্রায় শুরুতেই শেষ করে দিয়েছিল ঘাতকের বুলেট। কিন্তু কোনো বুলেট, ট্যাংক কিছুই শেষ করতে পারেনি তার স্বপ্নের আবাহনীকে। বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই আবাহনী অনেক বড় মহীরুহে পরিণত হচ্ছে। শেখ কামালদের মেরে ফেলা যায়, কিন্তু তাদের স্বপ্নকে শেষ করা যায় না। এখনো মনে হয় কামাল ভাই নীল রঙের টয়োটা গাড়ি নিজেই চালিয়ে ধানমন্ডির মোড়ে মোড়ে ঘুরছেন। নেই কোনো প্রটোকল, নেই কোনো পুলিশ, নেই কোনো পাহারা। এখন এ কথা বিশ্বাস করবে কেউ? একজন রাষ্ট্রপতির ছেলে সাধারণ মানুষের মতো জীবনযাপন করে গেছেন। সেই শীতের সকালে দেখেছিলাম কামাল ভাই লুঙ্গি পরা ও সাদা চাদরে ঢাকা আবাহনী মাঠে ঘুরে ফিরছেন। তাই যখনই বাংলাদেশ ক্রীড়াক্ষেত্রে সাফল্য আসে তখনই মনে হয় কামাল ভাইয়ের কথা। যে বীজ তিনি বুনে গিয়েছিলেন সাড়ে চার দশক আগে তারই ফল ক্রমেই আমরা পাচ্ছি।

লিয়াকত আলী ভূঁইয়া: প্রথম সহ-সভাপতি, রিহ্যাব