অতি সাধারণ এক সাংবাদিকের কথা-৩৮

প্রকাশ | ২৩ আগস্ট ২০১৭, ০৮:৫৮ | আপডেট: ২৬ আগস্ট ২০১৭, ১২:০২

আলম রায়হান

মোস্তফা ফিরোজের সঙ্গে পূর্তমন্ত্রী মির্জা আব্বাসের রুমে ঢুকলাম অনেকটা ভয়ে-ভয়ে। এ রুমে প্রথম ঢুকেছিলাম জেনারেল এরশাদের শাসনের শেষ দিকে ব্যারিস্টার আবুল হাসনাতের আমলে। বেগম খালেদা জিয়ার প্রথম সরকারের আমলে ঘনঘন যেতাম ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়ার সময়ে। তার কাছে রাজনীতির অনেক খবর সহজেই পাওয়া যেতো, তিনি মিডিয়াবান্ধব মন্ত্রী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। মির্জা আব্বাসের আমলে গিয়েছিলাম সেদিনই প্রথম। কক্ষে আগে থেকেই বেশ কয়েকজন লোক ছিলেন। তবে আমরা পেলাম বাড়তি মনোযোগ। আর আমাদের দিয়ে শুরু হলো আপ্যায়ন পর্ব। এতে আগের দর্শনার্থীরাও অংশ নেন; অর্থাৎ তারা এতক্ষণ খালিমুখে বসে ছিলেন মন্ত্রীর মুখপানে চেয়ে। সচারচার এমনটাই ঘটে।

মন্ত্রীর রুমে যারা ঢোকেন তারা মন্ত্রীর বদনের দিকেই তাকিয়ে থাকেন চাতক পাখির মতো; এক মুহুর্তও মিস করেন না। এ সবই করা হয় রহমতের দৃষ্টির আশায়। কিন্তু প্রায় ক্ষেত্রেই বে-রহম হয়েই মন্ত্রী-দর্শন পর্বের সমাপ্তি ঘটে। তবে তার অর্থ এই নয় যে, মন্ত্রীর দপ্তরে কখনো দর্শনার্থীর আকাল পড়ে। শুধু দপ্তরে নয়, মন্ত্রীদের বাসায়ও দর্শনার্থীদের ভিড় লেগে থাকে সকাল-সন্ধ্যা-রাতে। এ ব্যাপারে জেনারেল জিয়ার স্বরাষ্ট্র ও খালেদা জিয়া সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কর্নেল মোস্তাফিজ একবার বলেছিলেন। অনেক সময় রাথরুমে যেতে পানি না, সুপারিশের জন্য কাগজ হাতে ঢুকে পড়ে। আবার এর বিপরীত চিত্রও আছে। মানুষের ভিড়ের ভরানদী এবং মানুষহীন মরানদী- দুই চিত্রই দেখেছি কর্নেল মালেকের বাসায়। সন্ধ্যার পর তিনি বাসার ড্রইং রুমে বসতেন এবং থাকতেন গভীর রাত পর্যন্ত। আর পুরো সময় মানুষে ঠাসাঠাসি থাকতো বিশাল কক্ষটি। অনেক সময় কক্ষের দরজাও লোকাল বাসের মতো হয়ে যেতো। জেনারেল এরশাদের ইচ্ছায় ঢাকার মেয়র থেকে পতিত হয়ে বস্ত্রমন্ত্রী এবং অতপর পত্রপাঠ বিদায় হবার দিনও যথারীতি তিনি সন্ধ্যায় ড্রইং রুমে বসেছিলেন। কিন্তু একই দিন এরশাদের মন্ত্রিসভা থেকে পত্রপাঠ বিদায় হওয়া মাঈদুল ইসলাম মুকুল, ঢাকার ডেপুটি মেয়র আবদুস সালাম ও তার স্ত্রী ভানু ছাড়া আর কাউকে সেদিন দেখিনি কর্নেল মালেকের বিশাল সেই ড্রইং রুমে। তবে রাত ১২টার দিকে বেবি নাজনীন এসেছিলো দলবল নিয়ে ঘরোয়া সঙ্গীতের মুর্ছনা তুলতে। যা চলেছে ফজরের আজানের আগ পর্যন্ত।

মন্ত্রিত্ব চলে গেলে কর্পূরের মতো দর্শনার্থী উবে যাওয়া প্রসঙ্গ কর্নেল আকবর হোসেনের উচ্চারণ, ‘মন্ত্রিগিরি গেলে কুত্তাও আসে না।’ আর শাহ মোয়াজ্জমের মন্তব্য, ‘মরা গাছে বান্দরও ওঠে না।’ বাংলার মাটির এক কৃতি সন্তান ভানু বন্দ্যপাধ্যয়ের একটি কৌতুক নকশা আছে, ‘যে ডালে কাক বসে না।’

এসব জানা ছিলো বলেই মির্জা আব্বাসের রুমে অনেক লোকের ভিড় দেখে ‘মন্ত্রীর জনপ্রিয়তায়’ সাধারণের ভিমরি খাবার মতো অবস্থা হলেও আমার কোনো প্রতিক্রিয়া হয়নি। কেবল মন্ত্রীর সামনের চেয়ার থেকে তিনজনকে নিরস বদনে উঠে গিয়ে পেছনের সোফায় ঠাসাঠাসি করে বসতে দেখে একটু খারাপ লেগেছিলো। তবে ফ্লোরে বসতে হয়নি, এই সান্ত্বনা। যদিও বিএনপিতে ফ্লোরে বসার কালচার আছে। শুনেছি, বেগম খালেদা জিয়ার সামনে দলের এমন নেতারা ফ্লোরে বসেছেন, যারা সেই সময়েই সিনিয়র নেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন, এমপি-মন্ত্রী হয়েছেন। এমনকি এদের মধ্যে একজন রাষ্ট্রপতি হবারও দোড়গোড়ার পৌ঳ছে গিয়েছিলেন, কেবল ভাগ্যের সিকা ছেড়েনি অল্পের জন্য।

অন এয়ারে প্রায় প্রস্তুত এনটিভির জন্য মোস্তফা ফিরোজের পেশাগত কাজ শেষ হলো আধা ঘণ্টার মধ্যে। তার সঙ্গে আমিও বিদায় নেবার জন্য দাঁড়ালাম। মির্জা আব্বাস আমাকে বললেন, ‘আপনি থাকেন।’ একটু খটকা লাগলো: বিষয় কি? তাহলে কি বকেয়া প্রাপ্তি আজ চুকিয়ে দেয়া হবে। কিছুক্ষণের মধ্য অন্যান্য দর্শনার্থীদের বিদায় করলেন মন্ত্রী। সংসদে বাজেট আলোচনায় সংশোধনী প্রস্তাব গিলোটিনে নাকচ করার পদ্ধতিতে। মিনিট দশেকের মধ্যে রুমে কেবল আমরা দুজন; প্রায় কবরের নীরবতা, আমার মনে আতঙ্ক। পিএসকে আসার হুমুক দিয়ে মির্জা আব্বাস বললেন, “এখন রুমে মাছিও ঢুকবে না।’ আমার আর কোনো সন্দেহ থাকলো না। তাহলে আজই হবে এবং তা হবে পিএসের সামনে।

পিএস নাজমুর ভাই ছিলেন বরিশালের, তখন তিনি উপ-সচিব। অতিরিক্ত সচিব হিসেবে অবসরে গেছেন। আগে থেকেই তার সঙ্গে আমার খাতির ছিলো, যত না আমলা হিসেবে তার চেয়ে বেশি বরিশালের লোক হিসেবে। কি ঘটবে তার চেয়েও বেশি চিন্তা হচ্ছিলো, পরিচিত লোকের সামনে ঘটার আশঙ্কায়। এ এক বড় আপসোসের বিষয় হয়ে দাঁড়ালো। ভাবলাম যাই হোক, নাজমূল ভাইর সামলে না হলেই শুকুর আলহামদুলিল্লাহ। এক অদ্ভূত সান্ত্বনা খোঁজার চেষ্টা। কপালে গুলি লেগে মরে গেলেও যেমন বলার লোকের অভাব হয় না, চোখ দুটো তো রক্ষা পেয়েছে। অবশ্য চোখ নিয়ে নতুন এক তত্ত্ব এনেছেন ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া। তার মতে ‘টিয়ার সেলের আঘাতে দুই চোখ নষ্ট হতে পারে না; ছাত্রদের ছুঁড়ে দেয়া ফুলের টপের আঘাতে সিদ্দিকুর রহমানের চোখ নষ্ট হয়েছে।’ কি অদ্ভূত পুলিশি বচন। খনার বচনের চেয়েও এককাঠি সরেস; যেনো অমৃতসম। তবু ভালো, তিনি ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সচিব শাহ কামালের মতো ছাগলতত্ত্ব হাজির করেননি। চাইলে বাকপটু ডিএমপি কমিশনার বলতে পারতেন, ছাগলের দুই পায়ের জোড়া লাথিতে তিতুমীর কলেজের ছাত্র সিদ্দিকুর রহমানের দুই চোখ নষ্ট হয়েছে। স্মরণ করা যেতে পারে, মতিঝিল থানায় এক হাজতির রহস্যজনক মৃত্যুর পর পুলিশ বলেছিল, সে জুতার ফিতা গলায় জড়িয়ে আত্মহত্যা করেছে। পুলিশ কি না পারে! কেবল পারে না সাগর-রুনীর হত্যাকারীদের ধরতে।

আপন মনে নিজের দুর্ভাগ্যের মাত্রা পরিমাপ শেষ হবার আগেই প্রায় ছুটতে ছুটতে মন্ত্রীর রুমে প্রবেশ করলেন পিএস জনাব নাজমূল। তার পুরো নাম ভুলে গেছি। তবে মনে আছে, মন্ত্রীর ডাকে হন্তদন্ত হয়ে আসা বিষয়টি ছিলো আমলাতান্ত্রিক নাটক। সামনে ফাইল ধরার ইঙ্গিত করলেন মন্ত্রী। প্রতিটি ফাইলেই নানান কোয়ারি করছিলেন মির্জা আব্বাস। আর তোতা পাখির মতো উত্তর দিচ্ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা। তার মতো দক্ষ আমলা আমি খুব কমই দেখেছি। তবে সেদিন তার দক্ষতার চেয়ে বেশি ভাবছিলাম আমার ভাগ্য নিয়ে। প্রায় ঘণ্টাখানেক ফাইল দেখলেন মির্জা আব্বাস। এর মধ্যে কিছু না ঘটায় আশ্বস্ত হলাম, আজ আর কিছু হবে না। কিন্তু এ স্বস্তির ভাব কেটে গেলো মির্জা আব্বাস যখন বললেন, ‘আপনি আমার সঙ্গে যাবেন।’

আমি মির্জা আব্বাসকে অনুসরণ করে গাড়ি পর্যন্ত গেলাম। কিন্তু গাড়িতে উঠতে চাচ্ছিলাম না। তিনি বললেন, ওঠেন। উঠলাম। আর ভাবলাম, আজ কপালে বড় ভোগান্তি আছে। তবে যেহেতু অনেকে দেখেছে সেহেতু গুম হয়ে যাবার আশঙ্কা ছিল না মোটেই। এই দেখার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ তা টের পেয়েছি ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়। নয়াপল্টনের সাপ্তাহিক সুগন্ধা কাগজের অফিস থেকে ডিবি পুলিশ আমাকে এমনভাবে নিয়ে গিয়েছিলো যা অফিসের লোকরাও বুঝতে পারেনি। আমাকে ডিবি অফিসে দেখে ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়ার প্রথম প্রশ্ন ছিলো, কেউ দেখেছে? আমি বললাম, না। তিনি বললেন, সর্বনাশ। ব্যারিস্টার রফিক ডিবি অফিসে গিয়েছিলেন নারায়ণগঞ্জের বিএনপি ক্যাডার ডেবিডের জন্য। ডিবি আমাকে তুলে নিয়ে যাবার বিষয়টি  জানাজানি হয় ব্যারিস্টার রফিকের মাধ্যমে। উল্লেখ্য, তার আমলে পুলিশ প্রায়ই ‘অজ্ঞাতপরিচয়’ লাশ উদ্ধার করতো রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে। এমনকি গোয়েন্দা অফিসের পানির ট্যাংক থেকেও গলিত লাশ উদ্ধারের ঘটনা আছে।

মন্ত্রীর গাড়ি গুলিস্তান পেরিয়ে ‘রাজরোগে আক্রান্ত’ রাজউক ভবনের সামলে আসলে মির্জা আব্বাস নিচু গলায় বললেন, “স্পেশাল কোন কথা থাকলে বলেন।’ মনে হলো, ভুল শুনেছি। মন্ত্রী আবার বললেন, “কোন কাজ আছে?’ আমি বললাম, না। আসলেও ছিলো না। বললাম, না আব্বাস ভাই কোন কাজ নেই। গাড়ি দৈনিক বাংলার মোড়ে পৌঁছলে বললাম, আব্বাস ভাই আমি নামবো, অফিসে যেতে হবে। তিনি হাতের ইশারায় না করলেন। অল্প সময়ের মধ্যে তার বাসায় পৌঁছলাম। চা খেতে খেতে খুবই আন্তরিকভাবে বললেন, কোন কাজ থাকলে আমাকে বলবেন। আমি মাথা নাড়লাম। কিন্তু নিশ্চিত ছিলাম, তার কাছে আমার কোন কাজ থাকার সুযোগ নেই। যদিও পরদিনই এক ‘মহাকাজ’ নিয়ে এসেছিলো রাজউকের এক কর্মচারী। নাম সম্ভবত আবদুল্লাহ, বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের বড় ভাই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কবীর আনসারীর ছোট ভাই। আবদুল্লাহ বললো, মন্ত্রীর সামনে কাগজ ধরলেই কাজ হয়ে যাবে। সে খুবই আবেগাপ্লুত। আমি বললাম তোমার এমন মনে হলো কেন? সে বললো, “কাল মন্ত্রীর সঙ্গে আপনাকে গাড়িতে যেতে দেখেছি।’ ভাবলাম, দেশ কত এগিয়ে যাচ্ছে। বিরক্ত হয়ে বললাম, এইসব দালালি আমি করতে পারবো না। বছর দুই আগে থেকে মনে হচ্ছে, আমার এ প্রবণতা বাস্তবসম্মত নয়।

ছোট ভাই আবদুল্লাহ প্রচণ্ড আশাহত এবং আমার উপর মহাক্ষিপ্ত হয়ে ফিরে গেল। আব্বাস প্রসঙ্গ আমি আর মাথায় রাখিনি। মাসখানেক পর সচিবালয় বিট করা এক সাংবাদিক পেছন থেকে ছুটতে ছুটতে এসে বললো, আরে ভাই আপনে থাকেন কই, আব্বাস ভাই আপনাকে খোঁজে, দেখা করতে বলেছে।

: আচ্ছা, যাবো একদিন।

: না এখনই চলেন; আপনাকে নিয়ে যেতে বলেছে।

তার সঙ্গে পূর্তমন্ত্রী মির্জা আব্বাসের রুমে গেলাম, সেটি দ্বিতীয় ও শেষবার। তবে সেদিন আর চর-থাপ্পরের ভয় ছিলো না। আমার দিকে তাকিয়ে পিএকে বললেন, শওকত মাহমুদকে ধরতে। শওকত মাহমুদকে বললেন, “আলম রায়হানকে চেনেন?’ ওপারের উত্তর কি ছিলো জানি না। তবে না চেনার কোন কারণ ছিলো না। সাংবাদিক হিসেবে সাধারণ চেনা-জানার বাইরেও তার সঙ্গে একটু বেশি ঘনিষ্ঠতা ছিলো। তার ব্যর্থ উদ্যোগ ‘মিডিয়া সিন্ডিকেট’-এর বরিশাল ব্যুরোর দায়িত্ব পেতে আগ্রহী নজরুল ইসলাম রাজনের জন্য সফল সুপারিশ করেছিলাম শওকত মাহমুদের কাছে। নজরুল ইসলাম রাজন রাজনৈতিক নেতা থেকে হয়ে গেল সাংবাদিক; মিডিয়া সিন্ডিকেট-এর বরিশাল ব্যুরো চিফ। তবে সে রাজনীতি ছাড়েনি। এ ক্ষেত্রে সহায়ক ছিল লিটন বাশার; পরবর্তীতে দৈনিক ইত্তেফাকের বরিশাল ব্যুরো চিফ। অফিস খোলা থেকে শুরু করে গভীর রাতে বন্ধ করা পর্যন্ত সবকিছু আগলাতো অকল্পনীয় পরিশ্রমী ও মেধাবী লিটন বাশার। অকাল প্রয়াত লিটন বাশারকে আমি সংযুক্ত করেছিলাম রাজনের সঙ্গে।

এক সময় শওকত মাহমুদের সঙ্গে এক হাউজে কাজও করেছি, নাঈম ভাইয়ের দৈনিক আমাদের সময়- এর সূচনা লগ্নে। তিনি সম্ভবত প্রধান বার্তা সম্পাদক হিসেবে যোগদান করেছিলেন। আগে থেকে বার্তা সম্পাদক ছিলেন আজমল হোসেন খাদেম। তবে তারা দুজন অল্প সময় ছিলেন দৈনিক আমাদের সময়-এ। আর অতি অল্প সময়ের মধ্যেই প্রায় সকলের চোখেই পড়েছে, দুই সিনিয়রের দ্বন্দ্ব কত নিম্নমানের হতে পারে।

আলম রায়হান, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়