অমানবিক সু চি

প্রকাশ | ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১২:০৯

তায়েব মিল্লাত হোসেন

মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন চলছেই। সারা দুনিয়া থেকে তাই অং সান সু চির বিরুদ্ধে ধিক্কার উঠছে। একজন নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী কী করে এতা নিষ্ঠুর হতে পারেন― উঠছে সেই প্রশ্নও। অথচ বন্দিজীবনের বিষাদময় অভিজ্ঞতা আছে সু চির। সামরিক জান্তার রূঢ়তাও জানা আছে। কেননা সমরতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামে দীর্ঘ এক সময় অতিবাহিত করতে হয়েছে তাকে। তিনি গণতন্ত্রকামী। তিনি শান্তিকামী। তখনি এই সব পরিচয়ে বিশ্ববাসী জেনেছে তাকে। শুধু আমজনতার শাসন প্রতিষ্ঠায় পরিবার-পরিজন থেকে দূরে থাকতে হয়েছে তাকে। এই ত্যাগের মানসিকতা। শান্তির জন্য এই আপসহীনতার মনোভাব―দারুণভাবে আকৃষ্ট করেছে পশ্চিমাদের। তাই প্রাচ্যের এক অবরোধবাসিনী অং সান সু চিকে ১৯৯১ সালে নোবেল দিয়ে দিল শান্তি পুরস্কারদাতারা। সেটা আড়াই দশক আগের কথা। সু চি এখন মিয়ানমারকে গণতন্ত্রের দিকে নিয়ে এসেছেন। সবার আশা ছিল সামরিক শাসকরা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে যে আচরণ করেছে, তার অবসান হবে সু চির শাসনে। কিন্তু তা আর হলো কই! রোহিঙ্গা নিপীড়নে সু চির সরকার যেন আরো এক কাঠি সরেস।

বছর বছর দফায় দফায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী উৎপাটনের অমানবিক কর্ম চলছেই। অসহায় মানুষেরা দলে দলে নিরাপদ আশ্রয়ের তালাশে আসছে বাংলাদেশে। মিয়ানমারে যাদের শত শত বছরের বসতি, তাদের ভার নিতে হচ্ছে এই দেশকে। নিজভ‚ম থাকলেও পরবাসী হতে হচ্ছে তাদের। আর যারা বাপ-দাদার ভিটে আঁকড়ে থাকতে চাইছে তাদের কাউকে জীবন দিতে হচ্ছে। কেউ হচ্ছে ধর্ষণের শিকার। সোজা কথায়, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে যা যা করা দরকার তার সবই করছে মিয়ানমারের সরকার, প্রশাসন আর সামরিক বাহিনী। অথচ সেখানে সরকারি দলের প্রধান একজন নোবেল শান্তি বিজয়ী।

নোবেল কমিটি যখন সু চিকে শান্তি পুরস্কার দেয়, তখন তারা তাদের বিবৃতিতে তিনটি কারণের কথা জানায়। এগুলো হচ্ছে: প্রথমত, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জন্য তার অহিংস সংগ্রামের জন্য দেওয়া হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, তিনি নিপীড়নের বিরুদ্ধে একজন আদর্শ হিসেবে পরিণত হয়েছেন। আর তৃতীয় বিষয়টি হচ্ছেÑ নোবেল কমিটি অং সান সু চিকে সম্মান জানাতে চায় বিশ্বের বহু মানুষের গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম, মানবাধিকার ও জাতিগত শান্তি বজায় রাখায় তার শান্তিপূর্ণ সমর্থন ও অবিরত প্রচেষ্টার জন্য। রোহিঙ্গাদের উপর জাতিগত শোষণ অব্যাহত রেখে সু চি তিনটি বিষয়ই লঙ্ঘন করে চলেছেন। রাখাইনে রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার বলে আসলে আর কিছু অবশেষ নেই। স্টেট কাউন্সেলর হিসেবে তিনিই আজ এক নিপীড়কের ভ‚মিকায়। জাতিগত শান্তির বিনাশে সারা বিশ্ব থেকে আজ তার বিরুদ্ধে নিন্দার ঝড় উঠেছে।

ক্ষমতার চ‚ড়ায় আরোহণ করে সু চি তার অতীত মুক্তমনা চিন্তাধারা থেকে প্রায় বিপরীত মেরুতে চলে গেছেন। এমনকি মিয়ানমারের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে স্বীকৃত তার পিতা জেনারেল অং সানের আদর্শ থেকেও সরে এসেছেন। এ প্রসঙ্গে গণহত্যা বিষয়ক মার্কিন বিশেষজ্ঞ ড. গ্রেগরি এইচ স্ট্যানটন গণমাধ্যমে বলেছেন, সু চি তার সরকারের বর্ণবাদী নীতির সপক্ষে দাঁড়িয়েছেন। তিনি প্রকৃতপক্ষে তার পিতার সঙ্গেই বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। কারণ, বার্মার মূল সংবিধানে রোহিঙ্গাসহ সব গোষ্ঠীকেই বার্মার নাগরিক হিসেকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। ১৯৪৮ সালে বার্মার স্বাধীনতার বহু আগে থেকে রোহিঙ্গারা সেখানে বসবাস করে চলছিল। সুতরাং পিতার অনুসৃত নীতি থেকে ছিটকে বাইরে এসেছেন তিনি। এভাবে মেয়ে অং সান সু চির দ্বারা নৈতিকভাবে বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়েছেন জেনারেল অং সান। একসময়ের শান্তিকামী সু চিকে গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত করার পক্ষে যুক্তিও তুলে ধরছেন। তিনি বলেছেন, বার্মা মিয়ানমার হওয়ার বহু আগে যে গণহত্যা প্রক্রিয়া শুরু হয়, এখন অং সান সু চি তার দায়িত্বভার তুলে নিয়েছেন। এটা একটা স্ববিরোধিতা।

 

ফিরিয়ে নাও সব সম্মান!

গণতন্ত্রের মানসকন্যা হিসেবে, মিয়ানমারের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল সু চির খ্যাতি। তার ভার আর সইতে পারলেন না তিনি। ক্ষমতার মসনদে বসে ভুলে গেলেন সব অর্জনের কথা। তাই রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অবিরাম বিষোদগার করে যাচ্ছেন সু চি। আর অত্যাচারী বাহিনীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হচ্ছে বারবার। উগ্র জাতীয়তাবাদের জনপ্রিয়তার জোয়ারে তিনি যে ভেসে যেতে বসেছেন, সেদিকে কোনো খেয়ালই নেই। তাই তো তার নোবেল পুরস্কার ফিরিয়ে নেয়ার দাবি উঠছে বিশ্বের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে সেজন্যে মিলছে লাখো মানুষের সমর্থন। যার আওয়াজ প্রথম শুরু হয় গত বছর। সে সময় অনলাইনে তার নোবেল শান্তি পুরস্কার ফিরিয়ে নেয়ার জন্য এক আবেদনে স্বাক্ষর করেছেন লক্ষাধিক মানুষ। চেঞ্জ ডট অর্গে এই আবেদনটি করা হয়।

এই আবেদনে বলা হয়, ‘আন্তর্জাতিক শান্তি এবং ভ্রাতৃত্ববোধ রক্ষায় যারা কাজ করেন, তাদেরকেই নোবেল শান্তি পুরস্কারের মতো সর্বোচ্চ পুরস্কার দেয়া হয়। সু চির মতো যারা এই পুরস্কার পান, তারা শেষ দিন পর্যন্ত এই মূল্যবোধ রক্ষা করবেন, এটাই আশা করা হয়। যখন একজন নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী শান্তি রক্ষায় ব্যর্থ হন, তখন শান্তির স্বার্থেই নোবেল শান্তি পুরস্কার কমিটির উচিত এই পুরস্কার হয় জব্দ করা নয়তো ফিরিয়ে নেয়া।’ চলতি সহিংসতার পর অং সান সু চির নিন্দা করেছেন শান্তির নোবেলের আরেক বিজয়ী ডেসমন্ড টুটু। এর আগে সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন শান্তিতে নোবেল জয়ী ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস ও মালালা ইউসুফজাই।

নোবেল পুরস্কার প্রত্যাহারের কোনো পথ হয়তো নেই। তাই তা নিজের শোকেসে রেখে দিতে পারছেন সু চি। কিন্তু কিছু সম্মান ও সম্মাননা খসেই পড়ছে তার ঝুলি থেকে। এক যুগ আগে তাকে দেওয়া সম্মাননা স্থগিত করেছে যুক্তরাজ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম ট্রেড ইউনিয়নÑইউনিসন। গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, আরও কয়েকটি ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান সু চিকে দেয়া সম্মাননার বিষয়ে পর্যালোচনা শুরু করেছে। সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের আন্দোলনের কারণে দীর্ঘদিন গৃহবন্দি থাকা সু চিকে ২০০৫ সালে সম্মানসূচক সদস্যপদ দিয়েছিল ইউনিসন।

এদিকে অক্সফোর্ড শহর কর্তৃপক্ষ ১৯৯৭ সালে মিয়ানমারের এই নেত্রীকে যে ‘ফ্রিডম অব দি সিটি অব অক্সফোর্ড অ্যাওয়ার্ড’ দিয়েছিল, তা এখন প্রত্যাহার করার কথা ভাবছেন কাউন্সিলররা। অক্সফোর্ড কাউন্সিলের সদস্য জন ট্যানার অক্সফোর্ড মেইলকে বলেছেন, ‘মিয়ানমারের পরিস্থিতি যদি না বদলায়, তাহলে কাউন্সিলররা ওই সম্মাননা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।’

রাখাইনে মানবাধিকারের দিকটি দিয়ে সু চির অমানবিকতায় হতবাক ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্যরাও। তাই তারা সেই ১৯৯০ সালে পাওয়া তার শাখারভ পুরস্কার নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। কারণ এই সম্মাননা দেয়া হয় যাদের, তারা মানবাধিকার ও মুক্তচিন্তায় অবদান রাখেন। রাষ্ট্রক্ষমতায় এসে সু চি যে এখন উল্টোরথে চড়েছেন, তা বেশ আঁচ করতে পেরেছেন ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্যরা।

কানাডা থেকে সু চিকে সম্মানসূচক যে নাগরিকত্ব দিয়েছে তা-ও টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে। রোহিঙ্গা নির্যাতন বন্ধে পদক্ষেপ না নেয়ায় এরই মধ্যে তা বাতিলের দাবি উঠেছে। রাজনীতিবিদ, মানবাধিকার কর্মী, আইনজীবী ছাড়াও বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডীয় নাগরিকরা বিভিন্ন বিক্ষোভ সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর কাছে এ দাবি তুলে ধরছেন। ইন্টারনেটে এ বিষয়ে একটি পিটিশন ক্যাম্পেইন চলছে, যেখানে হাজার হাজার মানুষ সই করেছে। গত ১৬ সেপ্টেম্বর টরেন্টোতে কয়েকটি সংগঠন আয়োজিত রোহিঙ্গাদের পক্ষে সমবেদনার এক সমাবেশে অংশ নেন খোদ কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড।

রাখাইনে চলমান সেনা অভিযান সম্পর্কে ফ্রিল্যান্ড বলেন, মিয়ানমার সরকারের অভিযান মূলত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করার উদ্দেশ্যেই পরিচালিত হচ্ছে। কানাডার সরকার এ বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিচ্ছে। মিয়ানমারের নেত্রী সু চিকে ২০১২ সালে কানাডার সম্মানসূচক নাগরিকত্ব দেয়া হয়। কানাডার ১৫০ বছরের ইতিহাসে বিশ্বের মাত্র ছয়জনকে সম্মানসূচক এ নাগরিকত্ব দেয়া হয়েছে। এ ছয়জনের মধ্যে সু চিসহ চারজন আবার শান্তিতে নোবেল বিজয়ী।

স্বার্থবাদী কিছু শাসক আর দেশ ছাড়া পুরো বিশ্বের বিবেকই আজ সু চির বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছে। সবাই সহমর্মী, সমব্যথী নিপীড়িত রোহিঙ্গাদের জন্য। তবুও ফিরবেন না আগের সেই সু চি? ক্ষমতার মমতা আর মোহে অন্ধই হয়ে থাকবেন তিনি?

সু চির অসত্য বচন

রোহিঙ্গা ইস্যুতে কখনোই খুব একটা উচ্চবাচ্য করতেন না সু চি। কিন্তু এবার যখন এই জনগোষ্ঠী আক্রান্ত হলো, অসহায় শিশু-নারী-বুড়ো মানুষেরা দলে দলে বাংলাদেশমুখো হচ্ছে, তখন তাদের বিরুদ্ধে নানা বিষোদগার করতে লাগলেন সু চি। শোষিতদের বিরুদ্ধেই আনতে লাগলেন রকমারি অভিযোগ। যার সবই আসলে ডাহা মিথ্যা। কেবল স্বার্থের কারণে, উগ্র জাতীয়তাবাদের জন্য এখন নোবেলজয়ী যে এতটা নিচে নামতে পারেন, তা দেখে পুরো পৃথিবী আজ হতবাক। সু চির সাম্প্রতিক বক্তৃতা-বিবৃতির কিছু নমুনা দেখলেই এর প্রমাণ মিলবে।

রাখাইনে সহিংসতায় বিশ্বজোড়া সমালোচনার মধ্যে গত ১৯ সেপ্টেম্বর মিয়ানমারের পার্লামেন্টে দেয়া ভাষণে দেশটির স্টেট কাউন্সেলর সু চি অনেকটা সাফাইয়ের সুরে বলেন, ৫ সেপ্টেম্বরের পর কোনো ধরনের সহিংসতা বা নির্মূল অভিযান রাখাইনে হয়নি। অথচ টেকনাফ থেকে গত ১৫ সেপ্টেম্বরও সীমান্তের ওপারে রোহিঙ্গাদের গ্রামে গ্রামে ধোঁয়ার কুণ্ডলী উঠতে দেখা গেছে।

সু চির ভাষণের অনেক কথাই মনগড়া ও সত্য নয়। এমন দাবি করেছেন বিবিসির দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রতিনিধি জনাথন হেড। রোহিঙ্গা সংকট শুরুর পর থেকেই তিনি বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের দুই দিকের রোহিঙ্গাদেরই দুর্ভোগ-দুর্দশার চিত্র তুলে ধরছেন। সু চির অসত্য বক্তব্যের বিষয়ে এই সাংবাদিক বিশদ বলেছেন। তার ভাষ্য এমন, ‘রাখাইন পরিস্থিতি দেখতে মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় আয়োজনে একটি গণমাধ্যম প্রতিনিধি দলের ৭ সেপ্টেম্বর আমি রাখাইনের আলেল থান কাউয়ে গিয়েছিলাম। ওই সফরে আমরা স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্রের গুলির শব্দ পেয়েছি। এছাড়া ওই এলাকার চারটি জায়গা থেকে ধোঁয়া উড়তে দেখেছি। সফর শেষে বাংলাদেশে আসার পরও নাফ নদীর বাংলাদেশ অংশ থেকে ধোঁয়া দেখতে পেয়েছি। এটিই প্রমাণ করে গ্রামগুলোতে আগুন দেয়া হয়েছে।’

সু চি পার্লামেন্টে বলেছেন, ‘রাষ্ট্রের আইনের বিরুদ্ধে গিয়ে যারা মানবাধিকার লঙ্ঘন করবে, তাদের ধর্ম, বর্ণ বা যে রাজনৈতিক পরিচয় যা-ই হোক তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ এ প্রসঙ্গে জনাথন হেড বলেন, বর্তমান অভিযান শুরুর পর আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) নয় বরং সামরিক বাহিনীর অত্যাচারে বাধ্য হয়ে চার লাখের বেশি সাধারণ মানুষ জীবন রক্ষায় বাংলাদেশে এসেছে।

সু চি তার ভাষণে আরও বলেছেন, ‘কোনো ধরনের বৈষম্য নয়, রাখাইনে বসবাসকারী সকলেই সমান শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবার সুযোগ পায়।’

সু চির এই বক্তব্যের জবাব দিতে গিয়ে জনাথন বলেন, সু চির এই বক্তব্য পুরোপুরি মিথ্যা। বহুদিন ধরেই রোহিঙ্গাদের চলাফেরার কোনো স্বাধীনতা নেই। নিজ এলাকা ব্যতীত অন্য এলাকায় বিয়ে করতে গেলেও কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হয়, সেজন্য দিতে হয় মোটা অঙ্কের ঘুষ। ২০১২ সালে সহিংসতার পরে এই বিধিনিষেধ আরও কঠোর করা হয়েছে। অন্যদিকে আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা পরিবারের সদস্যরা বিশেষ অনুমতি ছাড়া আশ্রয় কেন্দ্রের বাইরেও যেতে পারেন না। এছাড়া ওই আশ্রয়কেন্দ্রের শিশুদের পড়াশোনা প্রায় পাঁচ বছর ধরে বন্ধ হয়ে গেছে। জনাথন বলেন, চার বছর আগে আমি রাথেডাংয়ে একটি গ্রাম পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। সেখানকার রোহিঙ্গারা চিকিৎসার জন্যও বাইরে যেতে পারেন না। সেখানে তারা স্থানীয় বৌদ্ধদের দ্বারাই পরিবেষ্টিত।

সু চির ভাষণ শুনে ক্ষুব্ধ ইউরোপিয়ান রোহিঙ্গা কাউন্সিলের (ইআরসি) প্রতিষ্ঠাতা ইব্রাহিম মোহাম্মদ। তিনি গণমাধ্যমে বলেছেন, রাখাইনে সেনাবাহিনী যে গণহত্যা চালাচ্ছে, তা আড়াল করার প্রয়াস চালিয়েছেন সু চি। দিয়েছেন নানা মিথ্যা তথ্য। প্রকৃত সত্য লুকিয়ে বিশ্ব সম্প্রদায়কে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছেন সু চি। এমন দাবি করেছেন রোহিঙ্গাদের এই নেতা।

ইব্রাহিম মোহাম্মদ বলেন, ‘আমরা যা ধারণা করেছিলাম, তাই ঘটেছে। অং সান সু চি মিথ্যা তথ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বিভ্রান্ত করার প্রয়াস চালিয়েছেন। প্রথমেই তিনি ছায়া দিয়েছেন সেনাবাহিনী ও নিরাপত্তা বাহিনীকে, যারা গণহত্যা ঘটাচ্ছে। তিনি নিরাপত্তা বাহিনীর ভ‚মিকার কোনো নিন্দা জানাননি; উপরন্তু দায়ী করেছেন রোহিঙ্গাদের।’

সেনা অভিযান সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে শেষ হয়েছে বলে সু চির কথাও ঠিক নয় দাবি করে ইব্রাহিম বলেন, ‘এই সপ্তাহেও সেনাসদস্যরা রোহিঙ্গাদের ঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছিল। তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, কিন্তু আন্তর্জাতিক অনুসন্ধানী দলকে ভিসা দেয়া হচ্ছে না।’ রাখাইনে মুসলিমদের মতো অন্য সম্প্রদায়ও বাস্তুচ্যুত হয়েছে বলে সু চি যে কথা বলেছেন, তার প্রতিবাদ জানিয়ে রোহিঙ্গা নেতা বলেন, ‘এটা মোটেই সত্য নয়। অন্য জনগোষ্ঠীগুলোকে সরকারি উদ্যোগে সরিয়ে নেয়া হয়।’

সু চির বিচার

রোহিঙ্গাদের পক্ষ নিয়ে বিশ্বজোড়া যে সভা-সমাবেশ চলছে তা আসলে নৈতিকতার প্রতি গণমানুষের চিরন্তন পক্ষপাত। তারা মিয়ানমারের শাসকগোষ্ঠী বিশেষ করে কথিত গণতান্ত্রিক নেতা সু চির অমানবিক অবস্থানের প্রতি ঘৃণার আগুন ছড়িয়ে দিতে চাইছেন। তাতে আসলে মিয়ানমারের উগ্র জাতীয়তাবাদী এই নেত্রীর কী আসে যায়।

সাগরে ভেসে যাওয়া কিংবা সৈকতে উপুড় হয়ে থাকা রোহিঙ্গা শিশুদের লাশ হয়তো একদা মিলিয়ে যাবে। কিন্তু তাদের অতৃপ্ত আত্মা পৃথিবীজোড়া ক্রন্দনধ্বনি ছড়িয়ে যেতেই থাকবে। সু চি ও তার ঘাতক বাহিনীর বিচার না হওয়া পর্যন্ত ওপারে পাড়ি জমানো সেই শিশুদের আত্মা কখনোই শান্তি পাবে না।

মিয়ানমারে মানবতার ভ‚লুণ্ঠন দেখে অবশ্য এরই মধ্যে মালয়েশিয়ায় আন্তর্জাতিক গণআদালত সক্রিয় হয়েছে। তারা মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সুচি, সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইয়াং এবং তার দোসরদের বিরুদ্ধে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে বিচার শুরু করেছে। পার্মানেন্ট পিপলস ট্রাইব্যুনাল (পিপিটি) নামে ওই প্রতীকি আদালতে তারা অভিযুক্ত হয়েছেন। দোষী প্রমাণিত হয়েছেন।

আদালতে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা, কাচিন, কারেনসহ কয়েকটি জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা এ অভিযোগ আনেন। গত ১৮ সেপ্টেম্বর মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদে অনুষ্ঠিত এ শুনানিতে বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হকসহ আন্তর্জাতিক অপরাধ তদন্তে যুক্ত ব্যক্তিবর্গ ও আইনজীবীরা অংশগ্রহণ করেন। শুনানিতে তারা মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার দায়ে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী, পুলিশ, অন্যান্য বৌদ্ধ মিলিশিয়া এবং দেশটির বর্তমান বেসামরিক সরকারকে অভিযুক্ত করেন।

সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ এনে শুনানিতে অংশ নেয়া ব্যক্তিরা জানান, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের সর্বস্তরে বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার। এসময় মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বর্বর নিপীড়নের নানা চিত্র তুলে ধরেন তারা। সাত সদস্যের প্যানেলে রয়েছেন ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব জেনোসাইড স্কলারসের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও আর্জেন্টিনায় সেন্টার ফর জেনোসাইডের প্রতিষ্ঠাতা দানিয়েল ফিয়েরেস্তেইন, গান্ধী ইন্টারন্যাশনাল পিস অ্যাওয়ার্ড বিজয়ী আয়ারল্যান্ডের ডেনিস হেলিডে, ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধ তদন্ত-প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকা মালয়েশিয়ার জুলাইহা ইসমাইল, বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধ বিষয়ে কাজ করা পিপিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট কম্বোডীয় আইনবিদ হেলেন, অস্ট্রেলিয়ার সিডনির মেকুইয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক প্রধান গিল এইচ বোয়েরিঙ্গার, ইন্দোনেশিয়ার মানবাধিকার আইনজীবী নুরসিয়াবানি কাতজাসুংকানা, ইরানের মানবাধিকার আইনজীবী সাদি সদর এবং ইতালির সুপ্রিম কোর্ট অব ক্যাসেসনের বর্তমান সলিসিটর জেনারেল নিলও রেসি।

আন্তর্জাতিক এই গণআদালতের রায় হয়েছে ২২ সেপ্টেম্বর শুক্রবার। গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়েছে অং সান সু চি নেতৃত্বাধীন মিয়ানমার সরকার। শুধু মুসলিম রোহিঙ্গা নয় মিয়ানমারের খ্রিষ্টান, কাচিন, এমনকি বৌদ্ধ তারাংদের বিরুদ্ধে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের প্রমাণ পায় রোমভিত্তিক এই আদালত।

তায়েব মিল্লাত হোসেন: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক