‘জ্ঞান ছাড়াই উন্নতি’র ধারণা আমাদের ক্ষতি করছে

প্রকাশ | ০২ অক্টোবর ২০১৭, ০৮:২৩

মহিউদ্দিন মাহী, ঢাকাটাইমস

জ্ঞান ছাড়াই উন্নতি করা যায়- এমন ধারণা আমাদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। আর এ জন্যই আমরা জ্ঞান সৃষ্টির পেছনে না গিয়ে উন্নতির পেছনে ছুটি। এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে। এ ছাড়া দেশে জ্ঞানের মূল্যায়ন হচ্ছে না। আর তাই সবাই উন্নতির জন্য অবলম্বন করছে ভিন্ন পন্থা।

কথাগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর। রবিবার ঢাকাটাইমসকে দেয়া এক টেলিফোন সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের এই প্রবীণ অধ্যাপক।

সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে গবেষণায় চৌর্যবিত্তির অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে চারদিকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তিও ক্ষুন্ন হচ্ছে বলে মনে করছে অনেকে। এ বিষয় নিয়েও কথা বলেন ড. সিরাজুল ইসলাম। ঢাকাটাইমসের প্রতিনিধি সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার মহিউদ্দিন মাহী তার কাছে জানতে চান-

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে গবেষণায় চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ উঠেছে। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?

বিষয়টি অবশ্যই নিন্দনীয়। অ্যাকাডেমিকালি এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তবে আমার প্রশ্ন হলো, যে থিসিস নিয়ে জালিয়াতির অভিযোগ উঠল সেটির যারা তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন এবং রিভিউ করেছেন, তারা কেন এটি চিহ্নিত করতে পারেননি। এখানে তাদেরও অনেক কিছু করার ছিল।

তার মানে এর দায় তারা এড়াতে পারেন না?

বিষয়টি সে রকমই। কারণ গবেষণাকর্ম ভালো করতে হলে সেখানে তত্ত্বাবধায়কের একটা বড় ভূমিকা থাকে। তত্ত্বাবধায়ক গোড়াতেই এসব ভুলের বিষয় জানিয়ে দিতে পারে। বা কেউ জালিয়াতির আশ্রয় নিলে সেটি শুরুতেই শনাক্ত করে ব্যবস্থা নিতে পারেন।

বিশ্বের অন্যান্য দেশে কী এমনটি ঘটে?

বিশেষ করে উন্নতে দেশে এমনটি ঘটার কোনো সুযোগ নেই। কারণ তারা জানে অ্যাকাডেমিক বিষয়গুলোতে জালিয়াতির আশ্রয় নেয়া গুরু পাপ। এসব কেউ করলে সেটি অবশ্যই ধরা পরবে। একারণে কেউ এসব করে না।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কি তাহলে  এ সম্পর্কে ধারণা দেয়া হয় না?

বিষয়টি সে রকম না। ধারণা দেয়া হয় না বললে ভুল হবে। তবে এটি খুবই কম। কেউ কেউ দেয়। কিন্তু মোটা দাগে এ সম্পর্কে কেউ বলে না। যে কারণে এসব ঘটনা ঘটে চলেছে।

গবেষণার আদর্শ নিয়ম কী?

গবেষণা করতে হলে সেখানে একজন তত্ত্বাবধায়ক থাকে। তত্ত্বাবধায়ক সার্বিকভাবে গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তিনিই মূল ভূমিকা পালন করে থাকেন। এরপর এটি রিভিউ কমিটিতে যায়। সেখানেও এটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। এরপর এটি ফাইনাল হয়।

তাহলে সম্প্রতি যে অভিযোগগুলো আসছে সেখানে গবেষক ছাড়াও তত্ত্বাবধায়ক ও রিভিউ কমিটির ভূমিকা আছে?

বিষয়টি সেভাবে দেখলে হবে না। আমি বলতে চাইছি আমাদের সংস্কৃতির কথা। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ফাঁকিবাজির সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। কেউ কারো দায়িত্ব পালন করছে না। সবাই ফাঁকির মধ্য দিয়ে চলতে চায়। গবেষণার গোড়াতেই যদি জালিয়াতি ধরা পড়ে তাহলে তো আর কেউ জালিয়াতির সাহস দেখাবে না। আর এটি ধরতে হবে তত্ত্বাবধায়ক এবং রিভিউ কমিটিকে।

এ অবস্থায় করণীয় কী?

আমাদের গোড়াতেই সমস্যা। আমরা জ্ঞানকে মূল্যায়ন করি না। সারা দেশেই জ্ঞানের চর্চা নিরুৎসাহিত হচ্ছে। গবেষণাকে উৎসাহিত করি না। আমাদের ভালো অনুবাদ বই নেই। দক্ষ অনুবাদক নেই। যে দুই-একটি অনুবাদ হচ্ছে সেগুলোর মান ভালো না। এসব দিক থেকে আমরা বহু বহু গুণ পিছিয়ে আছি। আমাদের ভালো গবেষণা এবং প্রকাশনা দরকার। সেটি হচ্ছে না। উন্নত এবং আধুনিক জ্ঞান সৃষ্টি করতে হলে এসব কিছুর নিশ্চয়তা আগে দিতে হবে।

গবেষণা জালিয়াতির দায়ে শাস্তির বিষয়ে কী পদক্ষেপ আছে?

যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসছে তাদেরকে শাস্তি দিলেই কী বিষয়টি সুরাহা হয়ে যাবে? আমাদের সংস্কৃতি আগে পরিবর্তন করতে হবে। আমাদের নতুন জ্ঞান সৃষ্টিকে উৎসাহিত করতে হবে। এগুলো ভাল তত্ত্বাবধান করতে হবে। গোড়াতেই একটা ধারণা তৈরি করতে হবে এটা অপরাধ। এটা করা যাবে না। এভাবে ফাঁকিবাজির সংস্কৃতি পরিবর্তন করতে পারলেই এই ধরনের অপরাধ একটা সময় থাকবে না।

সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ, স্যার।

আপনাকেও ধন্যবাদ।

(ঢাকাটাইমস/২অক্টোবর/মোআ)