রানীর খোঁজ কেউ রাখে না

প্রকাশ | ১১ নভেম্বর ২০১৭, ০৯:১৩ | আপডেট: ১১ নভেম্বর ২০১৭, ১২:০৮

কাজী রফিকুল ইসলাম, ঢাকাটাইমস

সুসময় চলে যায়, আর দুঃসময় কাউকে বলে-কয়ে আসে না। কথাটার জলজ্যান্ত উদাহরণ রানী সরকার। বাংলা সিনেমার একসময়ের সাড়া জাগানো অভিনেত্রী রাণী সরকার বড় খারাপ সময় পার করছেন। নীরবে নিভৃতি পড়ে আছেন শহরের এক অন্ধকার খুপড়িতে। দুর্দশা যখন চরমে গিয়ে পৌঁছায় তখন মাঝে মাঝেই নাকি আত্মহত্যা করার কথা ভাবেন। কিন্তু সাহস হয় না। একসময়ের নায়িকা, বহু চলচ্চিত্রের মধ্যমণি ছিলেন, সেসব যেন কোন সুদূর অতীত। কেউ তার খোঁজ নেয় না আর। কেউ জানতে চায় না আদৌ তিনি বেঁচে আছেন নাকি মরে গেছেন।  সাদা-কালো পর্দার সিনেমা রঙিন হতেই দুর্দশার ঘোর অন্ধকার নেমে এসেছে এই অভিনয় শিল্পীর জীবনে। কাজ না পেয়ে টাকার অভাবে না খেয়ে জীবন কাটে প্রতিভাধর শিল্পী রানী সরকারের।

তার আসল নাম মোসাম্মৎ আমিরুন নেসা খানম। ১৯৫৮ সালে মঞ্চনাটকের মাধ্যমে অভিনয়ের পথচলা শুরু। একই বছর পা রাখেন বড় পর্দায়। সিনেমার নাম "দূর হ্যায় সুখ কা গাঁও"। একে একে অভিনয় করেছেন আড়াই শতাধিক সিনেমায়। ষাটের দশকে বাংলা চলচিত্রের অন্যতম সফল অভিনেত্রী রানী সরকার জন্মগ্রহণ করেন সাতক্ষীরা জেলার সোনাতলা গ্রামে। তৎকালীন সময়ে উর্দু সিনেমার বেশ প্রসার থাকলেও বাংলা সিনেমার গোড়াপত্তন আসলে তখনি। "দূর হ্যায় সুখ কা গাঁও" "চান্দা" "তালস" এর মত জনপ্রিয়  উর্দু সিনেমায় কাজ করার পাশাপাশি সমৃদ্ধ করেছেন বাংলা সিনেমাকে। "কাচের দেয়াল", "বেহুলা", "আনোয়ারা", "চোখের জল", " নাচের পুতুল" তার অভিনীত জনপ্রিয় বাংলা সিনেমা।

মোহাম্মাদপুর শেখেরটেক এলাকায় দীর্ঘ দিন ধরে বসবাস করছেন তিনি। শেখেরটেক ৬ নং প্রধান সড়কের ৬ নম্বর বাসা। নিচ তলায় দুটো ছোট ঘরে অতি জরাজীর্ণ অবস্থায় থাকেন তিনি, তার ভাইয়ের বউ ও ভাইয়ের দুই মেয়ে।

অভিনয় কিংবা সিনেমার জগৎটা যখন প্রতিবন্ধকতায় ঘেরা, তখনি অভিনয়ে সাড়া জাগিয়েছিলেন তিনি। সকল বাধা-বিপত্তি পেছনে ফেলে পা রাখেন রঙ্গমঞ্চে। অভিনয় করেছেন একের পর এক জনপ্রিয় সিনেমায়। তবে, সময়ের স্রোতে বদলেছে অনেক কিছুই। মায়ের দিকে তাকিয়ে বিয়ে করা হয়নি। মা পাগল ছিলেন। দেখার বিশেষ কেউ ছিল না। তাই মায়ের দিকে নজর দিয়ে নিজের দিকে তাকানো হয়নি তার। হয়নি ঘর-সংসার। কিছুদিন পর মা চলে গেলেন। ততদিনে বিয়ের বয়স পার হয়ে গেছে।  আয়ের পুরোটাই দিয়েছেন মা-ভাইয়ের জন্য। কিছুদিন পর মায়ের মতো ভাইও চলে গেল। রেখে গেছেন তার স্ত্রী আর দুই মেয়ে। নামমাত্র পারিশ্রমিকে কাজ করে মা-ভাইয়ের পাশে ঢাল হয়ে দাঁড়ানো রানী সরকার জীবনযুদ্ধে আজ নিরস্ত্র। শেষ বয়সে তাকে দেখার কেউ নেই। নেই দুবেলা পেট ভরার সাধ্য।

ঢাকাটাইমসের সাথে আলাপ কালে অতীতের স্মৃতি মনে করে কেঁদে ফেলেন তিনি। নায়করাজ রাজ্জাক, সুজাতা, সুচান্দা ও পরিচালক জহির রায়হানসহ সবাইকে খুব মনে পড়ে। তার সময়ের অভিনেতা-অভিনেত্রী কিংবা পরিচালক অধিকাংশরাই প্রয়াত। যারা বেঁচে আছেন, তারাও কোনো খোঁজ খবর নেয় না। এফডিসিতে গেলেও কেউ খুব একটা পাত্তা দেন না তাকে। কাজ দেন না এই প্রবীণ শিল্পীকে। আর কাজ না থাকলে টাকাও আসে না হাতে।

তিনি বলেন, "সবাই এমন ভাব করে যেন রানী সরকার নামে কেউ ছিলই না। ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকি, কারো কথা বলার সময় হয় না। দেখ ছবি দেখ। কি ছিলাম আর কি হয়েছি! খেতেও পাই না। আজ দেখার কেউ নাই। কেউ খোজ নিতে আসে না। কেন গিয়েছিলাম এ পেশায় বল? কেউ মনে রাখেনি।"

ছবি দেখার জন্য দেয়ালে চোখ দিতেই একটু অবাক হতে হলো। ১৯৯৮ সালে 'দৈনিক জনকণ্ঠ' আয়োজিত 'জনকন্ঠ গুণীজন ও প্রতিভা' সম্মাননা পেয়েছিলেন। এছাড়াও জাতীয় চলচিত্র পুরস্কার, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে আজীবন সম্মাননা পুরস্কার লাভ করেছেন তিনি। সম্মানের ঝুলিটা পূর্ণ হলেও ভাতের হাঁড়িটা খালি। নিয়মিত আধপেটা থাকতে হয় তাকে। কখনো বা অনাহারে।

জীবনের শেষ ভাগে এসে অসহায়ত্ব এমনভাবে তাকে গ্রাস করেছে, মাঝে মাঝে আত্মহত্যাকে সমাধান মনে করেন। বিবেকের তাড়নায় সেও সম্ভব হয়ে ওঠে না। তিনি বলেন, "এক মাস আগে মাথা ঘুরে পড়ে গেছি। দ্যাখো, হাতটা কত জায়গায় ভাঙছে। একটা টেবলেট কেনার টাকা নাই। আজ চার তলার একজনের থেকে একশ টাকা ধার নিয়ে চাল আর পুইশাক কিনেছি। খুব কষ্টে আছি রে। কে শুনবে আমার কথা? মাঝে মাঝে আত্মহত্যা করতে মনে চায়। কিন্তু পারি নারে। মুসলমানের ঘরে জন্ম নিয়েছি। এত বড় পাপ তো করতে পারি না।"

অভাবের তাড়নায় এর-ওর থেকে ধারদেনা করেই তাকে চলতে হয়। কখনো কখনো পরিচিতদের কাছেও ধার চেয়ে বসেন। এ অসহায় অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে চান তিনি। এখনো অভিনয় করতে চান রানী সরকার। রঙিন পর্দায় বেশ কিছু অভিনয় করেছেন। তবে, এখন আর ডাক আসে না। যেন না মরেও মরে গেছেন রানী সরকার।

ঢাকাটাইমস/৫নভেম্বর/কারই/কেএস