বঙ্গবন্ধুর আদরের মহিউদ্দিনের সারাজীবন

প্রকাশ | ১৫ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৩:৫৬ | আপডেট: ১৫ ডিসেম্বর ২০১৭, ২৩:১৬

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস
ফাইল ছবি

মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হয়ে চারমাস নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন চট্টলার মহিউদ্দিন চৌধুরী। তার গ্রেপ্তারের খবরে ভারতের একটি মুক্তিযোদ্ধা শিবিরে শহীদ মহিউদ্দীন ক্যাম্প খোলা হয়েছিল। বেঁচে থাকার কথা ছিল না তার। তাই তাকে শহীদ ভেবে ছেলের নামে ফাতেহাও দিয়েছিলেন বাবা হোসেন আহমেদ চৌধুরী। এরই মাঝে একদিন মানসিক রোগীর নাটক করে চট্টগ্রাম কারাগার থেকে পালিয়ে বের হন মহিউদ্দিন। পাড়ি জমান ভারতে। সেখানে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ শেষে সক্রিয়ভাবে সম্মুখসমরে অংশ নেন তিনি।

সাহসিকতার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নজরেও পড়েন মহিউদ্দিন। ভীষণ স্নেহ করতের তাকে। মহিউদ্দিন ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন স্কুল জীবনেই। চট্টগ্রাম সিটি কলেজে রাজনৈতিক জীবনের বিকাশ। এরপর জিয়াউর রহমানের শাসনামল এবং এরশাদের আমলেও আন্দোলন সংগ্রামে ছিলেন সামনের সাড়িতে। এরশাদকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে চক্ষুশূল হন সামরিক সরকারের। গ্রেপ্তারও হন তখন। তবে চট্টগ্রামের সর্বস্তরের মানুষের কাছে নয়নমণি হয়ে ওঠেন মহিউদ্দিন চৌধুরী।

১৯৪৪ সালের ১ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার গহিরা গ্রামে জন্ম মহিউদ্দিনের চৌধুরীর। বাবার নাম মরহুম হোসেন আহমদ চৌধুরী, মা বেদৌরা বেগম। আট ভাইবোনের মাঝে মহিউদ্দিন মেঝ। বাবা চাকরি করতেন আসাম বেঙ্গল রেলওয়েতে।

দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে মহিউদ্দিন চৌধুরী চট্টগ্রামে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও শ্রমিক লীগের শীর্ষ পদে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশ নেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। তিনি মুজিব বাহিনী নামে পরিচিত বিএলএফ কমান্ডার ছিলেন।

১৯৯৪ সাল থেকে টানা তিনবার চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। চট্টলার এই বীর সবাইকে কাঁদিয়ে শুক্রবার ভোরে পরপারে পাড়ি জমালেন। ৭৪বছর বয়সী এই রাজনীতিক চট্টগ্রামের ম্যাক্স হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি দীর্ঘদিন কিডনি রোগে ভুগছিলেন।

বাবার চাকরির সুবাদে মহিউদ্দিন পড়াশোনা করেছেন মাইজদি জেলা স্কুল,কাজেম আলি ইংলিশ হাইস্কুল, আর  প্রবর্তক সংঘে। ছাত্র অবস্থায় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া মহিউদ্দিন ১৯৬২ সালে ম্যাট্রিক, ১৯৬৫ সালে ইন্টারমিডিয়েট এবং ১৯৬৭ সালে ডিগ্রি পাস করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ এবং পরে আইন কলেজে ভর্তি হলেও শেষ করেননি। জড়িয়ে পড়েন ছাত্র আন্দোলনে।

১৯৬৮ ও ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করা মহিউদ্দিন একাত্তরে গঠন করেন ‘জয় বাংলা’ বাহিনী। গ্রেপ্তার হন পাকিস্তানি সেনাদের হাতে। পাগলের অভিনয় করে কারাগার থেকে ছাড়া পেয়ে পালিয়ে যান ভারতে। উত্তর প্রদেশের তান্ডুয়া সামরিক ক্যাম্পে প্রশিক্ষণরত মুক্তিযোদ্ধাদের একটি স্কোয়াডের কমান্ডার হন মহিউদ্দিন। সম্মুখ সমরের যোদ্ধা মহিউদ্দিন স্বাধীনতার পর শ্রমিক রাজনীতিতে যুক্ত হন। যুবলীগের নগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক পদ পান।

পঁচাত্তরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর প্রতিশোধ নিতে মৌলভি সৈয়দের নেতৃত্বে মহিউদ্দিন গঠন করেন ‘মুজিব বাহিনী’।

সে সময় ‘চট্টগ্রাম ষড়যন্ত্র মামলা’র আসামি করা হলে পালিয়ে কলকাতায় চলে যান। এরপর ১৯৭৮ সালে দেশে ফেরেন বলে আত্মজীবনীতে উল্লেখ করে গেছেন এই রাজনীতিবিদ।

দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে মহিউদ্দিন চট্টগ্রামে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও শ্রমিক লীগের শীর্ষ পদে ছিলেন। চট্টগ্রামে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, বন্দর রক্ষা আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলনেও তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন।

পাঁচ দশকের রাজনৈতিক জীবনে অনেক অর্জন থাকলেও কখনও সংসদ সদস্য হতে পারেননি মহিউদ্দিন। ১৯৮৬ সালে রাউজান থেকে এবং ১৯৯১ সালে নগরীর কোতয়ালি আসনে ভোট করে তিনি হেরে যান।

তবে ১৯৯৪ সালে প্রথমবার চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে প্রার্থী হয়েই মহিউদ্দিন বিজয়ী হন। ২০০০ সালে দ্বিতীয় দফায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এবং ২০০৫ সালে তৃতীয় দফায় মেয়র নির্বাচিত হন তিনি।

প্রায় দুই যুগ সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করার পর ২০০৬ সালের ২৭ জুন নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি হন মহিউদ্দিন। মৃত্যু পর্যন্ত তিনি নগর আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন। 

মহিউদ্দিনের বড় ছেলে মুহিবুল হাসান নওফেলকে গতবছর আওয়ামী লীগের সম্মেলনে দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক করে নেওয়া হয়। ছোট ছেলে বোরহানুল হাসান চৌধুরী সালেহীন করেন ব্যবসা।

মহিউদ্দিনের ছয় ছেলে মেয়ের মধ্যে ফৌজিয়া সুলতানা টুম্পা ২০০৮ সালের ১৭ অক্টোবর ক্যান্সারে মারা যান। বাকি তিন মেয়ের মধ্যে জেবুন্নেসা চৌধুরী লিজা গৃহিনী। যমজ বোন নুসরাত শারমিন পিয়া ও ইসরাত শারমিন পাপিয়া মালয়েশিয়া থেকে এমবিএ করেছেন।

বলিষ্ঠ নেতৃত্বের জন্য সারাদেশে পরিচিতি পেলেও মহিউদ্দিন সব সময় নিজেকে চট্টগ্রামের রাজনীতির গণ্ডিতেই ধরে রেখেছেন।

(ঢাকাটাইমস/১৫ডিসেম্বর/বিইউ/ডব্লিউবি)