মায়ের লিভারে আমানের নতুন জীবন!

প্রকাশ | ২৮ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৪:১০ | আপডেট: ২৮ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৪:১৬

কমরেড খোন্দকার, ইতালি থেকে

সেই যে এক প্রেমিক-পুত্রের গল্প আমরা জানি। প্রেমিকা প্রেমের বিনিময় হিসেবে চেয়েছে প্রেমিকের মায়ের কলজে। তো পুত্রের প্রেম কিছুতেই ব্যর্থ হতে দেবে না মা। তাই সন্তানের হাতে বধ হতে তার স্বেচ্ছামরণ। 

পুত্র এবার মায়ের কলজে নিয়ে ছুটছে প্রেমিকার দুয়ারে। তো যাত্রা করতেই বেহুঁশ প্রেমিকের পা লাগলো মায়ের হাড়গোড়ে। সেই হাড় থেকেই দরদি মায়ের আর্তনাদ, ‘ব্যথা পাওনি তো বাবা!’ সন্তানের প্রতি এই মমতা কেবল মায়েরাই দেখাতে পারেন। বাস্তবে মায়েরা এর চেয়েও বেশি দরদি এই ভবে। চলুন আমরা এমন একটি ঘটনা জেনে নেই।

আড়াই বছর বয়সে ছোট্ট আমান জাওয়াদের লিভার নষ্ট হয়ে যায়। সেই ছোট্ট আমানকে নিজের লিভার দিয়ে বাঁচিয়ে তোলেন মা। এটা লক্ষ্মীপুরের এক মা আর ছেলের গল্প। এখন তারা বসবাস করছে ঢাকার কাফরুলে। 

ভারতের দিল্লিতে অ্যাপোলো হাসপাতালে লিভার প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে নতুন জীবন পেয়েছে প্রায় তিন বছরের আমান। হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা সফলভাবে তার লিভার প্রতিস্থাপন করেন। আর মায়ের দেওয়া লিভারেই আমান ফিরে পায় নতুন জীবন। আগস্ট মাসে তার শরীরে জন্ডিসের ভাব দেখা দেয়। মা ফারজানা তানজী দেরি না করে পাশের হাসপাতালে নিয়ে যান। এরপর দেশের নামকরা একটি প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি করান। সেখানে অবস্থার অবনতি হতে থাকে। ডাক্তাররা তাকে পিআইসিইউতে (পেডিয়াট্রিক ইনসেনটিভ কেয়ার ইউনিট) নিয়ে গেলেন। জানালেন, ‘ওর বাঁচার সম্ভাবনা কম।’

তখন স্বজনদের একজন জানালেন বঙ্গবন্ধু হাসপাতালের শিশু পুষ্টি ও পরিপাকতন্ত্র বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক বজলুল করিমের কথা। ডা. বজলুল করিম আমানকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে ভর্তি করাতে বললেন। সঙ্গে সঙ্গে সেখানে ভর্তি করানো হলো। সেখানে ডা. বজলুল করিম আমানের শরীর চেক করে দেখলেন লিভার পুরোটাই নষ্ট হয়ে গেছে। এখন লিভার প্রতিস্থাপন ছাড়া বাঁচার সম্ভাবনা ৫-১০ শতাংশ। ‘আমানের অবস্থার অবনতিই হচ্ছে শুধু। আর আমরা কিছুই করতে পারছি না।’ বলছিলেন ফারজানা। 

আমানের বাবা জামাল উদ্দিন পলাশ খোঁজ নিতে লাগলেন কোনো চিকিৎসা আছে কি না ছেলেকে বাঁচানোর। ডা. বজলুল ভরসা দিলেন। জানালেন, বারডেম হাসপাতালের প্রফেসর ডা. মোহাম্মদ আলী প্রথম লিভার প্রতিস্থাপন করেন। তিনি সফলভাবে আরো কয়েকটি লিভার প্রতিস্থাপন করেন, কিন্তু সেগুলো বড়দের। দেশে এখনো শিশুদের লিভার প্রতিস্থাপনের নজির নেই। এদিকে ডা. বজলুল ভারতের চিকিৎসক প্রফেসর অনুপম সিবালের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।

ডা. সিবাল দিল্লি অ্যাপোলো হাসপাতালে আমানের চিকিৎসার ব্যবস্থা করলেন। ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭ দিল্লি থেকে আসা এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে যাওয়া হলো আমানকে, সঙ্গী হলেন তার মা-বাবা। দুপুরে হাসপাতালে পৌঁছার পরপরই শুরু হয় নানা পরীক্ষা। রাত তিনটায় আসে মা ছেলে দুজনের পরীক্ষার ফলাফল। মা ফারজানা তার লিভার দিতে পারবেন। এরই মধ্যে আমান জাওয়াদকে ডায়ালাইসিস করতে হলো। ফারজানা বলেন, ‘তখন পর্যন্ত আমরা জানতামই না, একজনের লিভার অন্যজনের শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়। কিভাবে সাধারণ জন্ডিস থেকে মানুষের লিভার নষ্ট হয়ে যায় এসব কিছুই জানতাম না। আমরা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, লিভার তো প্রতিস্থাপন করতে হবে কিন্তু সেটা কোথায় পাওয়া যাবে? তারা বললেন, ডোনার তো আপনারাই দেবেন। ডোনার কোথায় পাই! ওর বাবার রক্তের গ্রুপ মেলে না। আমার সঙ্গে মেলে। আমাকে দিতে বললেন। আমার থেকে যে লিভার নেবেন আমার মোটেও ভয় লাগেনি। আমার তখন চিন্তা ছেলেকে নিয়ে, আমি মরব না বাঁচব সেই চিন্তাই ছিল না। শুধু চাইতাম আমার যা-ই হওয়ার হোক, ছেলেটা যেন সুস্থ হয়।’

২০ সেপ্টেম্বর দুপুরে একই অপারেশন থিয়েটারে মা ও ছেলের অপারেশন শুরু হয়। মায়ের লিভারের ৪০ শতাংশ কেটে ছেলের শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়। মায়ের অপারেশন শেষ হয় ১২ ঘণ্টায় আর আমানের ১৪ ঘণ্টায়। অপারেশনের পর দুজনকে আলাদা আইসিইউ কেবিনে রাখা হয়। ২১ দিনে কিছুটা সুস্থ হয়ে ওঠার পর দুজনকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আমানের ইনফেকশন দেখা দেয়। তাকে আরো আট দিন রাখা হয় হাসপাতালে।

ওর অপারেশন করেন ডা. নিরব গয়াল। ফারজানা বলেন, ‘তিনবার আমাকে কাউন্সিলিং করা হয়, যাতে মনোবল না হারাই। কিন্তু অপারেশনের পর দেখি এই রোগ খুব সচরাচর। আমরা থাকতে সেখানে ফিলিপাইনের ১০ মাসের একটা বাচ্চাসহ কয়েকটি অপারেশন হয়। এ পর্যন্ত দিল্লির অ্যাপোলো হাসপাতালে প্রায় ৩ হাজার লিভার প্রতিস্থাপন করা হয়েছে, এর মধ্যে আড়াইশই শিশু। আমাদের এমন একজনকে দেখানো হয় যাকে ১৯৯৮ সালে লিভার প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল ১ বছর বয়সে। সে এখন ডাক্তারি পড়ছে।’

সাধারণত হেপাটাইটিস এ, বি, সি, ডি এবং ই এই পাঁচ ধরনের ভাইরাস থেকে এই রোগ হয়ে থাকে। কিন্তু আমানের ক্ষেত্রে তা হয়নি, আমানের জ্বর হওয়ার পর তাকে টাইফয়েডের অ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশন দিয়েছিলেন ১৪টি। তা বছরখানেক আগে। ধারণা করা হচ্ছে শিশু আমানের শরীরে সেটা সয়নি। ভুল চিকিৎসার ফলে তার ছোট্ট শরীরে বাসা বাঁধে বড় রোগ। গত ১০ নভেম্বর দেশে ফেরে মা-ছেলে। ৬ মাস থাকতে হবে খুব সাবধানে। এ সময় মায়ের লিভার পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে। মায়ের লিভার নিয়ে এখন আমান ভালো আছে। সে এখন রাজধানী ঢাকায় নানার বাড়িতে পরিবারের সঙ্গে হাঁটছে-খেলছে-দৌড়াচ্ছে।

(ঢাকাটাইমস/২৮ডিসেম্বর/এজেড)