মেয়েবান্ধব টয়লেট নেই স্কুলে, ঋতুকালীন ব্যবস্থাপনায় সংকট

প্রকাশ | ০৫ জুলাই ২০১৮, ০৮:১২ | আপডেট: ০৫ জুলাই ২০১৮, ০৮:২৬

মহিউদ্দিন মাহী, ঢাকাটাইমস

‘স্কুলে এসে পানি খাই না। সকালেও কম পানি খেয়ে স্কুলে আসি। কারণ এখানে মেয়েদের জন্য আলাদা টয়লেট নেই। টয়লেট করতে গিয়ে যদি আবার বিপাকে পড়তে হয়। এই ভয়েই স্কুলের টয়লেটে যাই না।’

বলেছিল রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর ধনিয়ার আদর্শ স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্রী শেফালি বেগম। অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী সে।

মঙ্গলবার স্কুলের সামনেই কথা হয় শেফারির সঙ্গে। জানায়, ছেলে-মেয়েদের জন্য আলাদা টয়লেট না থাকার পাশাপাশি অপরিচ্ছন্ন পরিবেশও তাকে সেখানে যেতে নিরুৎসাহিত করে। জানায়, পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার অভাব আর দুর্গন্ধের কারণে সেখানে টেকাই দায়।

একই স্কুলের আরেক শিক্ষার্থী ঝর্না রায়। দশম শ্রেণি পড়ুয়া কিশোরী জানায়, টয়লেট মেয়েদের ব্যবহার উপযোগী নয়। কারণ দরজা আটকানোর ব্যবস্থাও নেই কোথাও কোথাও।

স্কুলটিতে এক হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থীর পড়াশোনা। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেক মেয়ে। তাদের জন্য আলাদা টয়লেট না থাকায় ছেলেদের সঙ্গে সেগুলো ব্যবহার করতে চায় না তারা।

আর ইচ্ছাকৃতভাবে সময় মতো টয়লেটে না যাওয়ার কারণে নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। বিশেষ করে ঋতুকালীন সময়ে জরুরি সহায়তা পাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে।

তবে মেয়েদের এসব সমস্যার বিষয়ে কর্তৃপক্ষ যে মোটেও সচেতন নয়, সেটি অধ্যক্ষ মাজেদা রাশিদ শিরিনের কথাতেই স্পষ্ট। তিনি ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমাদের আলাদা টয়লেট না থাকলেও পরিবেশ ভাল। মেয়ে শিক্ষার্থীদের তো সমস্যা হওয়ার কথা না।’

মাধ্যমিক স্কুলগুলোতে এটি এক সাধারণ চিত্র। রাজধানীর স্কুলেরই যেখানে এই দশা, সেখানে মফস্বল বা গ্রামের পরিস্থিতি কী, সেটা সহজেই ধারণা করা যায়।

অথচ শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য ঝুঁকির বিষয়টি মাথায় রেখে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্যানিটেশন ব্যবস্থা উন্নত করতে ২০১৫ সালে একটি পরিপত্র জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এতে বলা হয়, টয়লেট পরিচ্ছন্ন রাখার বিষয়টি প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কমিটির নজরদারিতে আনতে হবে। এই কমিটি এ খাতের জন্য পৃথক একটি সংরক্ষিত তহবিলের ব্যবস্থা করবে। টয়লেটগুলো নিয়মিত পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য প্রয়োজনীয় লোকবলও নিয়োগ করবে। সংরক্ষিত তহবিল থেকে এ ব্যয় মেটান যাবে।

পরিপত্রে ছাত্রীদের জন্য আলাদা টয়লেটের ব্যবস্থা রাখা, টয়লেটে ঢাকনাযুক্ত প্লাস্টিকের পাত্র রাখা, ঋতুকালীন (মাসিক) বিষয়টি নিয়ে কথা বলার জন্য একজন শিক্ষিকাকে দায়িত্ব দেয়া, স্যানিটারি ন্যাপকিন (প্রয়োজনে টাকার বিনিময়ে) রাখার কথাও ছিল পরিপত্রে।

নিয়ম অনুযায়ী কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানীয় জল, টয়লেট ব্যবস্থা, মেয়েদের আলাদা টয়লেট ব্যবস্থা, হাত ধোয়ার প্রয়োজনীয় আনুষঙ্গিক ব্যবস্থা আছে কি না, সে বিষয়ে শিক্ষা কর্মকর্তা বা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ থাকতে হয়। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে তথ্য প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটেও থাকতে হবে।

স্থানীয় এনজিওগুলোকেও স্যানিটেশন বিষয়ে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে অনুরোধ করা হয়েছে। স্থানীয় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে বছরে অন্তত দুইবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করার জন্য জেলা প্রশাসন উদ্বুদ্ধ করবে বলেও পরিপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।

কিন্তু আদর্শস্কুলসহ রাজধানীর তিনটি স্কুল সরেজিমন পরিদর্শন করে এই পরিপত্রের কোনো সুফল দেখা মেলেনি। স্কুল কর্তৃপক্ষ পরিপত্র নিয়ে জানলেও এর বাস্তবায়ন করেনি।

আদর্শ স্কুলের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী তানজিলা জানায়, মাসিকের সময় কোন শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলতে হবে, এমন কাউকেই ঠিক করেননি স্কুল। ফলে এই সময়ে সে বিদ্যালয়মুখী হয় না।

এ বিষয়ে অধ্যক্ষ জানান, ‘আমাদের মহিলা শিক্ষকদের বলা আছে তারা যেন এ বিষয়ে ছাত্রীদের সাহায্য করেন।’

এ বিষয়ে স্কুলটির পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি ইস্রাফিল সরদার ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমাদের স্কুলে টয়লেট সাময়িক সমস্যা। নতুন ভবন হচ্ছে সেখানে আর সমস্যা থাকবে না।’

তবে স্বাস্থ্যসম্মত মাসিক ব্যবস্থাপনায় শিক্ষার্থীদের স্যানিটারি ন্যাপকিন দেয়ার বিষয়ে কিছু জানেন না ইস্রাফিল সরদার।

দনিয়ার আরেক নামী স্কুল এ কে স্কুল অ্যান্ড কলেজ। এই স্কুলের শিক্ষার্থী মুনমুন আক্তারের তথ্য মতে, সেখানে দুইটি টয়লেট। কিন্তু সেখানে যায় না সে, কারণ প্রচণ্ড দুর্গন্ধ।

এই স্কুলটিতেও নেই মেয়েদের স্যানিটারি ন্যাপকিন দেয়ার মতো কোনো ব্যবস্থা। এসব নিয়ে ছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো শিক্ষক নেই।  

এ বিষয়ে স্কুলটির অধ্যক্ষ শামসুল আলম বলেন, ‘আমাদের স্কুলে টয়লেট পরিষ্কার রাখার জন্য বলা হয়েছে। তবে এটি মনিটরিং করা হচ্ছে না। ভবিষ্যতে করা হবে।’

রাজধানীর অভিজাত এলাকা ইস্কাটনের স্কুল ‘ইস্কাটন গার্ডেন উচ্চ বিদ্যালয়’। এখানকার অবস্থাও আলাদা কিছু নয়। স্কুলের সপ্তম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমার স্কুলে টয়লেট ব্যবহার উপযোগী হলেও সেখানে ঢাকনাযুক্ত বিন নেই। ফলে মাসিকের সময় প্যাড নিয়ে সমস্যায় পড়তে হয়। এটা নিয়ে কারো কাছে কিছু বলা যায় না।’

স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক শাহানা নাসরিন ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘ঢাকনাযুক্ত বিন নেই। তবে আমাদের টয়লেট পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। আমরা ছাত্রীদেরকে এ বিষয়ে সহযোগিতা করি।’

স্কুলগুলোতে মেয়েদের স্বাস্থ্য সম্মত মাসিক ব্যবস্থাপনা ও স্যানিটেশন নিয়ে কাজ করে ডর্প নামে একটি এনজিও। সংস্থাটির পরিচালক (গবেষণা ও পরিকল্পনা) জুবায়ের হাসান ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘এসডিজির চার নম্বর গোলে স্বাস্থ্যসম্মাত স্যানিটেশনের বিষয়টি আছে। এ কারণেই সরকার বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে পরিপত্র জারি করেছে। কিন্তু এটি নিশ্চিত করতে হলে স্কুল কর্তৃপক্ষ এবং স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটিকে সচেতন হতে হবে।’

২০১৪ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশ ন্যাশনাল হাইজিন বেইজলাইন সার্ভের প্রাথমিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রতি ১৮৭ জন শিক্ষার্থীর জন্য একটি টয়লেট আছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের টয়লেটগুলোর ৪৫ শতাংশ বন্ধ থাকে। প্রায় দুই-তৃতীয়াংশের টয়লেটের ভেতরে বা কাছাকাছি পানি ও হাত ধোয়ার জন্য সাবানের ব্যবস্থা থাকে না। রোগ সংক্রমণ প্রতিরোধ ব্যবস্থার অভাবে শিক্ষার্থীরা প্রায় অনুপস্থিত থাকে।

অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মেয়েদের আলাদা টয়লেটের ব্যবস্থা নেই। ঋতুস্রাবকালীন অনেক মেয়েই স্কুলে যায় না। ফলে ৮০ শতাংশ উপস্থিতি নিশ্চিত করতে না পারায় তারা উপবৃত্তি থেকে বঞ্চিত হয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, যথেষ্ট গোপনীয়তা এবং মেয়েদের জন্য আলাদা মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা উপযোগী টয়লেট মাসিক চলাকালীন সময়ে ছাত্রীদের স্কুলে আসা ও শিক্ষা গ্রহণেল পরিবেশ নিশ্চিত করে। তাই সরকারি ও বেসরকারি সকল পর্যায়ে এ সম্পর্কে যথেষ্ট সহযোগী মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ঢাকাটাইমসকে বলেন,‘আমরা সব সময় মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করার কথা বলছি। তার জন্য প্রয়োজন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অবকাঠামো, শিক্ষার্থীদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা। এ কারণেই জেন্ডারবান্ধব স্যানিটেশন নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেওয়া কথা বলা হয়েছে। তবে যারা এসব করবে না তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

(ঢাকাটাইমস/০৫জুলাই/এমএম/ডব্লিউবি)