বড় নেতা নয়, জনপ্রিয়দের প্রতিই ভরসা

মাসুদ কামাল
 | প্রকাশিত : ০৮ জুলাই ২০১৮, ০৮:২৬

দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা এখন পাল্টে গেছে। কেবল রাজনীতি কেন, সবকিছুই পাল্টায়। পরিবর্তন প্রতিদিনই ভর করে সবকিছুর ওপর। কিন্তু গত কয়েক বছরে রাজনীতি যেন একটু বেশিই পাল্টেছে। এক সময় বহুদলীয় রাজনীতি ছিল, সেটা বদলে গিয়ে চেহারা পেল দ্বিদলীয় রাজনীতির। সাম্প্রতিক সময়ে সেটাও যেন আর থাকছে না, ক্রমশ একদলীয় অবয়বই যেন প্রকট হচ্ছে। একটি দল দিন দিন যেন বৃহৎ থেকে বৃহত্তম হচ্ছে, অন্য দলগুলো শীর্ণ থেকে শীর্ণতর। রাজনৈতিক ভিন্নমত প্রকাশের জন্য রাজপথে আর ‘প্রধান বিরোধীদল’ বলে কাউকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। দুর্বল হতে হতে বিরোধীদল এখন সীমাবদ্ধ থাকছে বক্তৃতা-বিবৃতির মধ্যেই। আবার সেসব বক্তব্যের মধ্যেও যতটা না জনগণ বা জনস্বার্থ থাকছে, তার চেয়ে বেশি থাকছে তাদের দলীয় নেতৃত্বের সুবিধা-অসুবিধার কথা।

এ তো গেল মাঠের রাজনীতির কথা। জাতীয় সংসদের অবস্থাও একই রকম। ক্ষমতাসীন দলেরই সেখানে একক আধিপত্য। ডানে বামে সামনে পিছনে সর্বত্র কেবল তারাই। বিরোধীদল বলে কিছু একটা অবশ্য আছে। তবে সেটিকে গৃহপালিত বললেও যেন বেশি বলা হয়। এরা মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করে আমোদিত হন, নিজেদের ভাগ্যবান মনে করেন। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে, সংসদে দাঁড়িয়ে ‘বিরোধীদলীয় নেতা’ আক্ষেপের সুরে উচ্চারণ করেন নিজেদের আইডেনটিটি ক্রাইসিসের কথা। বলেন, ‘মানুষ জিজ্ঞাসা করে, আমরা কি সরকারি দল নাকি বিরোধীদল? আমি জবাব দিতে পারি না।’ তারপর কাতর কণ্ঠে সরকারপ্রধানের কাছে আবেদন জানান তার দলের নেতাদের মন্ত্রিসভা থেকে বের করে দেয়ার জন্য। তার এমন বক্তব্য সংসদের ভেতরে এবং বাইরে কোথাও কারো মনকে বিন্দুমাত্র আর্দ্র করতে পারে না, বরং অনেকটাই কৌতুকের জন্ম দেয়। মানুষ হাসাহাসি করে। সংসদের ভেতরে, এমনকি তার দলের সদস্যদের মধ্যেও হাস্যরোল দেখা যায়। সত্যি বলতে কি, এই বৃদ্ধার জন্য তখন কিছুটা মায়া অনুভব হয়।

এই যে মেরুকরণ, বিরোধীদের ক্ষুদ্র থেকে অধিকতর ক্ষুদ্রে পরিণত করা, কিছু বিরোধীকে আত্মপরিচয়বিহীন করে তোলা এসবই কি রাজনীতি নয়? নৈতিকতার বাটখারায় এ রাজনীতিকে কে কিভাবে পরিমাপ করবেন জানি না, কিন্তু প্রতিযোগিতার রাজনীতিতে আমি একে সাফল্য বলেই বিবেচনা করবো। আর সাফল্য মানলে, তার পুরো কৃতিত্বই সম্ভবত যাবে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার কাছে।

আওয়ামী লীগের বয়স এখন ৬৯ বছর হয়ে গেছে। একটি রাজনৈতিক দলের জন্য এটা তেমন কিছু বয়স নয়। কিন্তু এই সময়েই এই দলটি এমন কিছু অসাধারণ ঘটনা ঘটিয়েছে, যা কি না বিশ্বের অনেক দল এর চেয়ে কয়েকগুণ বয়সেও করতে পারে না। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে একটি জাতি স্বাধীনতা পেয়েছে, বিশ্ব মানচিত্রে একটা নিজস্ব পরিচয় পেয়েছে। এমন কৃতিত্ব বিশ্বের হাতেগোনা গোটা কয়েক রাজনৈতিক দলেরই কেবল রয়েছে। এহেন সমৃদ্ধ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে শুরু থেকেই ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। টানা ২৬ বছর নেতৃত্বে থাকার পর মৃত্যু হয় তাঁর। পরবর্তী ছয়টি বছর ছিল দলটির জন্য এলোমেলো সময়। এরপরই দায়িত্ব নেন বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা। গত ৩৭ বছর তাঁর নেতৃত্বেই চলছে দেশের বৃহত্তম এই দলটি।

কঠোর হাতে দল চালাচ্ছেন শেখ হাসিনা। উনি যখন দায়িত্ব নেন, তখন ভয়ঙ্কর এক প্রতিকূল পরিস্থিতি। রাজ্জাক বনাম মালেক উকিলের বিরোধ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ভাংচুরের পর্যায়ে পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছেছিল। দলের নিশ্চিত ভাঙন রোধ করার লক্ষ্যে বিদেশ থেকে এসে দায়িত্ব নেন শেখ হাসিনা। শুরুর দিকে অবস্থা খুবই নাজুক ছিল। তারপরও দমে যাননি তিনি। ধীরে ধীরে পুরো দলের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন। সে নিয়ন্ত্রণ এখন পরিণত হয়েছে একক নিয়ন্ত্রণে। এ নিয়ন্ত্রণ এখন কেবল নিজের দলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, বিস্তৃত হয়েছে তা অন্য দলের মধ্যেও। হয়তো সে কারণেই জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে নিজের দলের আত্মপরিচয় ফিরে পেতে বিরোধীদলীয় নেতাকে আকুতি জানাতে দেখা যায় শেখ হাসিনার প্রতি। বিষয়গুলো হয়তো কারও কারও রাজনীতির নীতি-নৈতিকতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক মনে হতে পারে, কিন্তু তারপরও এটাই বাস্তবতা।

আমার বিবেচনায়, শেখ হাসিনা তাঁর পুরো রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর। অনেকেই ভেবেছিল, অনেকে বলেছিল পর্যন্ত, এই সরকার বেশিদিন টিকবে না। কিন্তু নিজের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং কঠোর মনোবলের মাধ্যমে সেই রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ শেষ পর্যন্ত ভুল প্রমাণ করে ছেড়েছেন তিনি। তিনি যেন প্রমাণ করেছেন, এই দেশের বাস্তবতায় সরকার পরিচালনায় তাঁর কোনো বিকল্প নেই। নিজের দলের মধ্যে কিভাবে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হয়, বিরোধী দলকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়, এসব তাঁর চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না।

এমনই বাস্তবতায় ২৩ জুন দলের বিশেষ বর্ধিত সভায় আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর বক্তব্য অনেকের মধ্যে হয়তো নতুন চিন্তার জন্ম দেবে। সভাটির আয়োজন করা হয়েছিল দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে। তবে সেখানে দলীয় সভানেত্রী এবং সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্যের অনেকাংশ জুড়েই ছিল আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রসঙ্গ। আসন্ন এই নির্বাচনে কাদেরকে প্রার্থী করা হবে, কাদেরকে করা হবে না, দলীয় ঐক্য রক্ষার জন্য কি করতে হবে, দলের কাছে সাধারণ মানুষের কি প্রত্যাশা এসব নিয়েই কথা হয়েছে বেশি। যেহেতু এটি ছিল দলের একেবারে কোর-গ্রুপের সভা, তাই অনেকেই তাদের কথা বলেছেন খোলামেলাভাবে। আবার বিপরীত দিকে দলনেত্রীও তার দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন কোনো রকম রাখঢাক ছাড়াই। এই সভায় নেত্রীর বক্তব্যের যে বিষয়গুলো খুবই আশাপ্রদ মনে হয়েছে, তা হলো জনগণের প্রতি বাড়তি গুরুত্ব দেয়া। আওয়ামী লীগের এখন এমনই সাংগঠনিক অবস্থা, তাদের অনেক নেতা-কর্মীর মধ্যে এমন ধারণাও রয়েছে যে, জনগণ কি চায় বা না চায় সেটা বড় কথা নয়, কোনোভাবে দলের মনোনয়নটা পাওয়াই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। একবার মার্কাটা পেয়ে গেলে জয় আর ফেরায় কে? এই মানসিকতার মধ্যে এক ধরনের স্বৈরাচারী চিন্তা কাজ করে। কিন্তু বর্ধিত সভায় এই মানসিকতার কোনো প্রতিফলন দেখা গেল না। বরং দলীয় নেতাদেরকে শুনতে হলো গণতন্ত্রের কথা, জনগণের মতামতকে গুরুত্ব দেয়ার কথা। বড় নেতা আর জনপ্রিয় নেতার পার্থক্যটিও যেন পরিষ্কার করে দিলেন তিনি।

বড় নেতা হওয়া মন্দ নয়। দলের গুরুত্বপূর্ণ অনেক সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে বড় নেতাদের অনেক ভূমিকা থাকবে। কিন্তু বড় নেতা মানেই তাকে এমপি হতে হবে, মন্ত্রী হতে হবে এমন কোনো প্রতিজ্ঞা থাকা ঠিক নয়। নেতা হওয়া এবং জনপ্রতিনিধি হওয়া এক বিষয় নয়। জনপ্রতিনিধি হওয়ার জন্য জনপ্রিয়তা দরকার, জনসম্পৃক্ততা থাকা দরকার। সাধারণ মানুষের সঙ্গে কোনো প্রকার যোগাযোগ নেই, এলাকায় বছরেও একবার যাওয়া-আসা নেই, কিন্তু নির্বাচনের সময় দেখা যায় তিনিই পেয়ে গেছেন দলের মনোনয়ন এদেশে এমন উদাহরণ কম নেই। আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই একটা ঘটনার কথা বলতে পারি। সেটা ১৯৯১ সালের কথা। আমি তখন মিরপুর থাকি। এরশাদের পতনের পর নির্বাচন হচ্ছে। হারুন মোল্লা মিরপুরের মানুষ, দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগ করে আসছেন। প্রত্যাশা ছিল তার তিনিই হয়তো মনোনয়ন পাবেন। কিন্তু নির্বাচনের সময় দেখা গেল সেখানে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেলেন ড. কামাল হোসেন। ড. কামাল বড় নেতা, এতই বড় নেতা যে, সাধারণ মানুষ তার নাগাল পর্যন্ত পায় না। দলীয় মনোনয়ন না পেলেও নির্বাচনের সময় কিন্তু ভোটাররা হারুন মোল্লাকেই বেছে নিয়েছিল। ড. কামালের মতো হাই ভোল্টেজ নেতাও ভোটের রাজনীতিতে ফিউজ হয়ে গিয়েছিলেন। ভোট যখন অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়, তখন কে কত বড় নেতা সেটা আর নিয়ামক হয় না। বরং গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দেয় কোন প্রার্থীর বেশি যোগাযোগ রয়েছে সাধারণ মানুষের সঙ্গে। কে কেবল ভোটের সময়ই নয়, সারা বছরই যোগাযোগ রাখছে জনগণের সঙ্গে। কে রাখছে উন্নয়নে ভূমিকা। মানুষের বিপদে আপদে কে দাঁড়াচ্ছে পাশে, হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে আপনজনের মতো।

রাজনীতিতে ১৯৯১ সালের চেয়ে অনেক বেশি সুসংহত এখন আওয়ামী লীগের অবস্থান। কিন্তু তারপরও গণমানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথাটি উচ্চারিত হলো খোদ আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর মুখে। স্পষ্টই বললেন তিনি, ‘কেউ দলীয় মনোনয়ন পাবেন কি পাবেন না, সেটা নির্ভর করবে এলাকায় কতটুকু জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পেরেছেন, আর দলের নেতা-কর্মীদের কিভাবে মূল্যায়ন করছেন তার ওপর।’ এর চেয়ে স্পষ্ট বক্তব্য আর কিছু হতে পারে না। জনপ্রিয়তা এবং দলীয় নেতা-কর্মীদেরকে মূল্যায়ন করা এই দুটি বিষয়ই আসলে একজন রাজনৈতিক নেতার প্রধান বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিত। শেখ হাসিনার এমন বক্তব্য খুবই আশাব্যঞ্জক। তিনি এখানে দলনেত্রী কেবল নয়, জননেত্রী হিসেবেও কথা বলেছেন। দলের নেতা-কর্মীদের মূল্যায়নের কথা যেমন বলেছেন, তেমনি বলেছেন জনগণের সঙ্গে থাকার কথাও। এই প্রত্যাশার বাস্তবায়ন যদি সম্ভব হয়, দল হিসেবে আওয়ামী লীগের অগ্রযাত্রা আগামীতে আরও সাফল্যম-িত হতে বাধ্য।

তবে একটা প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায়। যে কথা সমালোচকরা এরই মধ্যে বলতেও শুরু করেছে। তাদের মতে, নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেতে নেতাদের কেমন হতে হবে তা তো বলা হলো। কিন্তু তারপরও মনোনয়নের সময় যদি অন্য দৃশ্য দেখা যায়? যদি এলিয়েনরাই মনোনয়ন পেতে থাকেন? এমন কিন্তু হতেই পারে। জনবিচ্ছিন্ন বড় নেতারা অনেক শক্তিশালী। যেহেতু তারা বড় নেতা, তাই তাদের মেধা ভালো, আর যেহেতু জনবিচ্ছিন্ন তাই হাতেও অঢেল সময়। এই মেধা এবং সময়ের সমন্বয়ে ষড়যন্ত্র করারও সুযোগ পান তারা বেশি। আর সেটা যদি সফল হয়, তাহলে হয়তো দেখা যাবে নানা ক্যারিকেচারের মাধ্যমে তারা দলনেত্রীর নির্দেশনাকেই প্রতিনিয়ত ব্যর্থ করে দিচ্ছেন। তবে এসবই আশঙ্কার কথা। বাস্তবে নির্বাচনের সময় দলীয় শীর্ষনেত্রীর প্রত্যাশারই প্রতিফলন ঘটুক, এটাই চাইবে আওয়ামী লীগের কোটি কোটি সমর্থক।

মাসুদ কামাল: লেখক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :