ঘাস ফড়িং

জাকির হোসেন সেলিম
 | প্রকাশিত : ০৮ জুলাই ২০১৮, ২০:৩১

গলা দিয়ে ক্ষ্যা— ক্ষ্যা— শব্দ বের হতেই পাশের ঘর থেকে মিঠুর বোন চিৎকার করে উঠে ।

এই খবরদার, জানালা দিয়ে থুথু ফেলবি না । বাইরে কাপড় দেয়া আছে ।

তার বোন শুনল কি করে ? মিঠু বুঝতে পারে না ।

এই বাসাটা ছোট আর একটু লম্বাটে । তার বোনের ঘরটা পাশাপাশি, দক্ষিন দিকে । ঘরে সব সময় হাই ভলিয়মে টিভি চলে । মিঠুর ঘরের দরজা বন্ধ, দুই রুমের মাঝে কোন জানালাও নাই । তবুও ক্ষ্যা— ক্ষ্যা— শব্দ তার বোনের কানে গেছে । অতি আশ্চর্যের বিষয় ! আজ মিঠুর ঘুম ভেঙ্গেছে একটু বেলা করে । দীর্ঘদিন পর কাল রাতে এক বিয়ের দাওয়াতে গিয়েছিল । কনের স্পেশাল গেষ্ট হিসাবে । রাতে বাসায় ফিরতেও দেরী হয়েছিল । আজ ঘুম থেকে উঠেই প্যারা । মিঠু জানালা দিয়ে বাইরে তাকায় । আকাশ দেখে । আকাশ মেঘলা, বৃষ্টি শুরু হতে পারে যে কোন সময় । শিলা বাইরে কাপড় শুকাতে দিয়েছে । শিলা তার বোনের নাম । মিঠু বাচ্চা ছেলে না । সে জানালা দিয়ে থুথু ফেলার আগে আশপাশ দেখবে । না দেখে থুথু ফেলবে না । ফেললে ফেলবে, থুথু কাপড়ে যাবে কেন ?

সাবধান করার দরকার কি ?

শিলার দুনিয়া হলো এই ঘর, টিভি আর এক মাত্র সন্তান । সব কিছুতেই তার খবরদারি । সব সময় কিছু একটা বলা চাই, অভ্যেস । রাতে শোয়ার সময় মিঠুর বই পড়তে ভাল লাগে । একটা বই হাতে নিয়েছে, পড়বে; সাথে সাথে শিলার চিৎকার ।

মিঠু, লাইট নিভা । বিল উঠছে ।

নিজের ঘরে সারাক্ষণ টিভি চলে, সমস্যা নাই । ছোট ভাই বই পড়বে, অনেক সমস্যা; বিল বাড়ছে । এই বাসায় তার সম্মানের ব্যাপারটা সে বুঝতে পারছে । পারদ ক্রমশ নীচে নামছে । এই কথাটাও ঠিক না, পারদের নামা নামির কিছু নাই; ইতিমধ্যে তলানীতে নেমে স্হির হয়ে আছে । মনে হয় জমে গেছে । পারদও জমে ? পরিবেশের তাপমাত্রা ঋনাত্বক, কত ডিগ্রী?

এই ভাবে থাকা যায় না ।

মিঠু যাবে কোথায় ? নিজের অবস্হার কথা ভাবে । বোনের বাসায় আছে, একটা ঠিকানা আছে । চাকুরী নাই, সহসা হবে বলেও মনে হচ্ছে না । একটা ফার্ম থেকে মাঝে মাঝে ডাক আসে, বলার মতো কিছু না । নিয়ম করে অফিসেও যেতে হয় না । সময় মতো তাদের কাজ হলেই হলো । মিঠুর পয়সা দরকার, সে কোন প্রশ্ন না করেই কাজ করে দেয় । প্রায় নিয়ম করে সকাল এগারটা হতে দুপুর তিনটা পর্যন্ত রাস্তায় রাস্তায় হাঁটে । চাকুরীর জন্য এখানে সেখানে পরীক্ষা দেয়, প্রতিক্ষা করে থাকে; সুখবরের চিঠি আসবে; কখনও আসে না । দীর্ঘদিন ধরে বিসিএস দিয়ে চলেছে । সে যে খুব খারাপ আছে, তাও না । দীর্ঘদিন প্রেমও করছিল । সময়ও কেটে যাচ্ছিল । কনা তার সাবেক প্রেমিকা, বিউটিফুল এক্স, মিঠু গত রাতে তার বিয়ে খেয়ে এসেছে । বর কনের স্ট্যাজের সামনে গিয়ে কনাকে বলেছে,

হাই !

বর্তমানে কনার মতো কেউ নাই । নতুন কারো সাথে জড়াতে ইচ্ছে করছে না । মিঠুর মনে হয়, তার দিন কাল এমনি করেই কেটে যাবে । নিজের কোন ঠিকানা নাই, কখনও ভাই এর সংসারে কখনও বোনের সংসারে । ভাই-বোনদের ইচ্ছে মতো চলবে তার দিন কাল । নিজের ইচ্ছায় থুথুও ফেলতে পারবে না ।

তার চাকুরীর ব্যাপারে বন্ধু জাহাঙ্গীর একটা ভবিষৎত বানী করেছে ।

তোর বিসিএস হবে না । চেষ্টা বাদ দে, তুই তো গাউছিয়া যাসনি । বিসিএস হতে হলে নিয়মিত গাউছিয়া যেতে হবে ।

মিঠু বুঝতে পারে না, বিসিএস এর সাথে গাউছিয়া মহিলা মার্কেটের কি সম্পর্ক !

গাউছিয়া যে মিঠু যায়নি, তা না । বেশ কয়েক বার গিয়েছে । মেয়েদের মার্কেট, সব সময় জটলা থাকে । স্বাভাবিক ভাবে চলাচল করা যায় না । মেয়েদের মার্কেটে তার যাবার দরকারও নাই ।

শেষবার এক সিনিয়র ভাই এর সাথে গিয়েছিল । তিনি ব্যাংকে চাকুরী করেন । নিউ মার্কেট হতে আম কিনেছেন । দোকানারকে টাকা দিয়ে সামনে তাকাতেই মিঠুর সাথে চোখা চোখি হয়ে যায় ।

হঠাৎ করেই দেখা, ডিপার্টমেন্টের ব়ড় ভাই না, মহল্লা সম্পর্কের বড় ভাই । এড়িয়ে যাওয়া যায় না ।

মিঠু যে ! যাও কই ?

মিঠু, চোখ দিয়ে সামনে ইশারা করে বলে, ঢাকা কলেজের হোষ্টেলে যাব । একজনের সাথে দেখা করতে হবে ।

বাসায় চল । রাতে আমার সাথে খাবা । আম কিনেছি, পাঁচ কেজি । বাসায় আম দুধ হবে ।

ভাই, অন্য একদিন যাব । আজ একটু কাজ আছে ।

রাখ তোমার কাজ । আমার সাথে রাত্রে খাবা, এটাই তোমার আজকের কাজ । পড়াশুনার খবর কি ?

আমি এইবার ফাইনাল ইয়ারে ।

ভাল, ভাল । পাশ করেই চলে আসবা । ব্যাংকে চাকুরী করবা । হাত দিয়ে কোটি কোটি টাকা যাবে । হা হা হা । তখন শরীরের এই হাল থাকবে না । হাতের ইশারায় মিঠুকে দেখায় ।

মিঠু বুঝতে পারেনা তার শরীরের হাল খারাপ কোথায় দেখলো । তার এই ভাইটি দেখতে শিম্পাঞ্জির মতো । সাদা শিম্পান্জি । উচ্চতায় মিঠুর অর্ধেক, তবে প্রস্হে দ্বিগুন । পরচুলা পড়ে । দুই হাতে কালো কালো লোম । গায়ের রঙ মাখনের মতো । তার আসল নাম নিঠুর মনে নাই, গায়ের রঙের জন্য সবাই তাকে মাখন বসে ডাকতো ।

মিঠুর দম বন্ধ হয়ে আসে । এমন শরীরের তার দরকার নাই । সে পালানোর পথ খুঁজে ।

ধর তো ! রিক্সা ডাকি, বলে মাখন ভাই আমের ব্যাগটা মিঠুর হাতে ধরিয়ে দেন । মিঠু হাতে নেয় । রিক্সা ডাকার কথা । মাখন ভাই তা না করে পুরোপুরি মিলিটারী কায়দায় উল্টোদিকে ঘুরে সরাসরি ওভার ব্রিজের দিকে হাঁটতে থাকেন । মিঠুর, তার পিছু নেয়া ছাড়া উপায় থাকে না ।

মাখন ভাই ওভার ব্রীজ পার হয়ে গাউছিয়া যান । ভাবীর জন্য কিছু কিনবেন, শেষ মূহুর্তে মনে পড়েছে ।

মাখন ভাই এক দোকানে ঢুকেন । দোকানী তখন একজন মহিলা ক্রেতাকে ব্রা দেখাচ্ছিলেন । সামনের কাঁচের উপর রাখা । দরদাম চলছে। দোকানী মহিলা ক্রেতাকে মুগ্ধ করার চেষ্টা করছে ।

আপা আটত্রিশ সাইজের মথ্যে এই ডিজাইনটা ভাল চলছে । সবাই এটা চায় ।

বটিস আছে বডিস, বলে মাখন ভাই মহিলা ক্রেতাকে পাশ কাটিয়ে যাবার সময় কাঁচের উপর রাখা ব্রা তে হাল্কা চাপ দিয়ে সামনে এগিয়ে যান ।

ক্রেতার সাথে দোকানীর দর দাম ঠিক হয়ে গেছে । দোকানী ব্রা প্যাকেট করার জন্য কাগজের প্যাকেট হাতে নিয়েছে । মহিলা ক্রেতা বলেন,

ভাই এইটা বদলায়া দেন ।

কেন আপা, কোন সমস্যা ?

কোন সমস্যা নাই । আপনি এইটা বদলায়া দেন ।

আপা আর তো নাই । আপনার দামেই তো দিলাম ।

মহিলা ক্রেতা কিছু বলে না । একবার ব্রা আর একবার মাখন ভাই এর দিকে তাকায় । দোকানদার বিষয়টা বুঝতে পারে । প্রথমবার দেখেও থাকবে হয়তো । বিষয়টাকে আগে গুরুত্ব দেয়নি ।

ভাই, আপনি কি ? কিছু দেখলেই টিপ দিতে ইচ্ছে করে ?

কিসের টিপ ? মাখন ভাই প্রতিবাদ করে । আমি কেবল হাত দিয়ে দেখলাম জিনিসটা সফ্ট কি না । এতোক্ষন দোকানীর ক্ষিণ আশা ছিল, মহিলা হয়তো শেষ পর্যন্ত কিনবেন । এই সাইজের এমন ডিজাইন খুব বেশী নাই এই মার্কেটে, দামও ভাল পাচ্ছিলেন। মাখন ভাই এর শেষ কথা শুনে মহিলা ক্রেতা বের হয়ে যান । পাঁচ কেজি ওজনের আমের ব্যাগ নিয়ে মিঠু পেছনে দাঁড়িয়ে থাকে ।

তারা পাঁচ ভাই বোন । মিঠু মাঝে মাঝে ভুলে যায়, পাঁচ সংখ্যাটা তাকে নিয়ে নাকি তাকে ছাড়া । ভাই বোনরা সবাই তার বড় । বাবা- মা মারা গেছেন দীর্ঘদিন । তার তিন বোন, বড় এক ভাই আছেন; মিঠুর সাথে যার বয়সের ব্যবধান কুড়ি বৎসরের বেশী । বৎসরে দুই একবার দেখা হয় । বড় ভাই তার অভিভাবক, বাবার মতো । মিলের মধ্যে এতো টুকুই । মিঠু কি করছে, কেমন আছে; এই সব জানার আগ্রহ তার আছে বলে মনে হয় না । মিঠু কলেজে পড়া পর্যন্ত ভাই এর বাসাতেই ছিল । ভাই কখনও কোন কিছু জানতে চাইতেন না । প্রায় কোন কথাই হতো না । বাবা তার জন্য কিছু টাকা রেখে গিয়ে ছিলেন । শেষ বয়সের সন্তান, নাবালক রেখে পরপারে যাত্রা করছেন, অপরাধ বোধ থেকেও হতে পারে । মিঠুর পড়াশুনা করতে সমস্যা হয়নি । তার এক ফুপু ছিল, ফুপু না বলে দাদী বললে মানাত ভাল । দন্ত বিহীন বুড়ি, তাকে মাসে মাসে টাকা দিত । অন্য ভাই বোনদের সাথে ফুপুর কোন সম্পর্ক ছিল বলে মনে হতো না । প্রতি মাসের শুরুতে ফুপুর সাথে মিঠুর দেখা হতো । কলেজে পড়ার সময় হতেই এমন বন্দবস্ত ছিল । মিঠু ফুপুকে জিজ্ঞেস করেছিল, তাকে কেন টাকা দেয় । ফুপু বলতো, তোর বাপের টাকা । আমিও খাই, তোকেও দেই । ফুপুর সাথে দেখা হলে অদ্ভুত সব কথা বলতেন । ফুপুর সাথে আলাপের শুরুটা হতো এই ভাবে -

মিঠু, বজ্জাত গুলার খবর কি রে ?

মিঠু, প্রথম প্রথম এই প্রশ্নের কিছুই বুঝতে পারতো না । পরে বুঝতে পেরেছিল, ফুপু তার ভাই-বোন দের খবর জানতে চাচ্ছেন ।

মিঠু এই প্রশ্নের উত্তর দিত না । ফুপুরও যে এই প্রশ্নের উত্তর দরকার, তাও মনে হতো না । রানুকে বজ্জাত বলাতে মিঠুর লাগতো । ফুপুকে জিজ্ঞেস করতো,

রানুকে বজ্জাত বলছ কেন ?

ফুপু মাছি তাড়াবার মতো করে হাত নাড়তেন । সব গুলা একই রকম বজ্জাত । তুই পড়াশুনা করিস ।

মিঠুর মাঝে মাঝে মনে হতো যাদের সে বাবা মা বলে জানে, সে তাদের সন্তান তো ?

প্রশ্নটা ফুপুকে করে ছিল ।

ফুপুর উত্তরটাও ছিল ধূঁয়াশা । তিনি বলতেন,

তোকে তোর বাবা মেলা থেকে এনেছিল ।

তার বোন রানুকে জিজ্ঞেস করেছিল । রানুর সে কি হাসি ! রানু তার ইমিডিয়েট বড় বোন । বয়সে তিন চার বৎসরের বড় । এই রানুই তার ভাই ছিল, বোন ছিল, অভিভাবক ছিল । তার সাথে খেলতো । মায়া মায়া বড় বড় চোখ । সব কিছুতেই অবাক হতো । চোখ গোল গোল করে বলতো,

বলিস কি ? এমন ! আশ্চর্য হয়ে “এমন” শব্দটা বলা ছিল রানুর মুদ্রা দোষ ।

তারা দুই ভাই বোন, বড় ভাই এর বাসায় থাকতো । সে ফুপুও একদিন টুপ করে মরে গেল । তাদের বাসায় কেউ জানল না, মিঠু জেনেছে টাকা আনতে গিয়ে । ফুপুর মৃত্যুতে মিঠুর বাবার বন্দবস্ত শেষ হয়ে যায়।

তার বড় ভাই এর সাথে কথা বলা মিঠু নিয়ন্ত্রন করতে পারে । তার বড় তিন ভাই বোনের মধ্যে এক ধরনের যোগাযোগ আছে । মিঠু ঠিক জানে না তবে অনুমান করতে পারে । যোগাযোগের কারনটা পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট । মিঠুর মাঝে মাঝে অস্হির লাগে । শিলার কথা গুলো খুব কঠিন মনে হয় । বাসা ছেড়ে চলে যাবে বলে ঠিক করে । দাদা তখনি ফোন দিবেন । বড় ভাইকে তারা সবাই দাদা ডাকে । বোনদের আপা, বুবু কিছুই ডাকে না । নাম ধরে ডাকে । দাদা অভিভাবকের দাবি নিয়ে ফোন দিবেন । সে যে অপদার্থ মনে করিয়ে দিবেন । তাকে দিয়ে কিছু হবে না, বোন থাকতে দিচ্ছে, খেতে দিচ্ছে, সেই বোনকে একা বাসায় রেখে চলে যেতে তার মতো অপদার্থই পারে । তার পরে ফোন দিবেন তার আরেক বোন কেয়া । সে আরেক নমুনা, ফোন করেই সরাসরি হুমকি ।

তুই নাকি শিলার বাসা ছেড়ে চলে যাচ্ছিস ?

ভাবছি, এখানে থেকে তো কিছু হচ্ছে না । অন্য কোথাও—কথার এই পর্যায়ে গিয়ে মিঠুকে থামতে হয় কেয়ার কথা শুনার জন্য ।

ভাবনা পর্যন্তই যেন থাকে । কেয়ার গলার স্বর সপ্তমে । বাসা ছেড়ে গেলে রেবে দিয়ে দেব । বে-ওয়ারিশ লাশ হয়ে রাস্তার মোড়ে পড়ে থাকবি ।

আর কথা চলে না । মিঠুর, দৈর্ঘ, প্রস্হ, উচ্চতা থাকলেও পদার্থ বিজ্ঞানকে কাঁচ কলা দেখিয়ে সে অপদার্থ খেতাব বয়ে চলেছে । চলুক, দিন তো চলছে । মিঠু, এতো কিছু শুনার পরও তার বোনের বাসায় থেকে যায় । এক ধরনের দায়িত্ব বোধ থেকেই । ভাগ্যগুনে কোন চাকুরী পেয়ে গেলে দায়িত্ব বোধের কথা বিশেষ ভাবে ভাববে বলে ঠিক করে ।

সে রানুর কথা ভাবে । তার উইন্ডো ছিল তার ইমিডিয়েট বড় এই বোনটা । তার একটু সমস্যা ছিল । প্রেম করে বিয়ে করেছিল, বাসা থেকে পালিয়ে বিয়ে । বয়সের দোষ, এক প্রকার নিরাপত্তাহীনতার জন্য হতে পারে, অনিশ্চিত ভবিষতের জন্য হতে পারে । হতে পারে, বাসায় সবার অবহেলা থেকে পালানোর জন্য, সবাইকে মুক্তি দেয়ার জন্য । পালিয়ে যাবার আগের রাতে মিঠুকে বলেছিল,

মন দিয়ে পড়বি । কোন ফাঁকি বাজি করবি না । তুই অবশ্য ফাঁকিবাজ না । শেষের কথাটা নিজেকে বলে । তারপর বার ইন্চি লম্বা একটা কাঠের স্কেল মিঠুর হাতে দিয়ে বলেছিল,

সবাই যখন তোকে বকবে, তুই এই স্কেলটাতে কামড় দিয়ে পড়ে থাকবি । পোড়া মাটি নীতি, একদম কাঁদবি না; বলেই রানু নিজেই কাঁদতে শুরু করেছিল । রানু যে চলে যাবে মিঠু বুঝতে পারেনি । রানু চলে যাবার পর বাসায় রানুকে নিয়ে কোন আলোচনাও হয়নি । সন্ধ্যার পর দাদা বাসায় ফিরলে ভাবীর কাছে শুনে শুধু বলেছিল,

অহ, আচ্ছা ।

মিঠুর খুব কষ্ট হতো । রানুকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতো । এক একটা স্বপ্ন এমন হতো, মনে হতো একেবারে সত্যি । মিঠুর খুব কান্না পেত । বার ইন্চি লম্বা স্কেলে দাঁত বসে যেত । তবু সে কাঁদতো না ।

রানুর ভালবাসার সংসার টিকেনি ।

রানু ঠিক দশ মাস পর ফিরে এসেছিল । এই দশ মাস বাসায় কেউ রানুর কথা বলেনি । এই বাসায় রানু নামে যেন কেউ ছিল না । ফিরে আসার পরও একই অবস্হা । কেউ জিজ্ঞেস করেনি এতোদিন কোথায় ছিল । যেন কোন ব্যাপারই না । ঘরের মেয়ে বাইরে বেড়াতে গিয়েছি, বিকেলে ফিরে এসেছে ।

সন্ধ্যা হতে বৃষ্টি হচ্ছে । মিঠুর একটু জ্বরের মতো হয়েছে । রানু, মিঠুর পাশে বসে আছে । দাদা ঘরে ঢুকেই রানুকে তৈরী হতে বলল,

রানু তৈরী হয়ে নে । তোকে ষ্টেসনে রেখে আসবো । কোন আলামত ছাড়া ঝড় । রানু কাঁদতে শুরু করে,

আমি কোথায় যাব দাদা ?

আল্লাহ দেখবে রে বোন । চিন্তা করিস না । আল্লাহ মহান ।

তুমি এতো রাতে আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেবে ?

তোকে বের কে দিব তো বলছি না । লোকে কি বলবে ? আমি নিজে গিয়ে তোকে রেখে আসব । ষ্টেশনে রাত আর দিন কি ? সারা রাত ফক ফকা আলো, মানুষ জন চলাচল করে।

রানু আর আপত্তি করেনি । খালি হাতেই দাদার পেছনে পেছনে বাসা থেকে বের হয়ে গিয়ে ছিল ।

এই বাসাটাও উদ্ভুত, ছাদের উপর ছাদ ।

ব্যাপারটা হলো, এতো বড় ছাদের দরকার কি ? অর্ধেক হলেই তো চলে । বুদ্ধিমান বাড়িওয়ালা । তিনি ছাদ অর্ধেক করে ফেলেছেন, বাকি অর্ধেক ছাদে দুই রুমের ফ্লাট । ছাদের এই মাথা হতে ঐ মাথা । সেই ফ্ল্যাটেরও ছাদ আছে । একেই বলে ছাদের উপ ছাদ । শিলা এখানে ভাড়া থাকে । মিঠুর দুলাভাই থাকেন দেশের বাইরে, মালেশিয়ায় । তিন বৎসরের ছেলেকে নিয়ে শিলা একাই থাকে । বিয়ের পনর বৎসর পর ছেলের মা হয়েছে শিলা । আহ্লাদ একটু বেশীই । ভাগনের নাম তমাল । উচ্চতা বলার মতো না হলেও ওজন বলার মতো, ত্রিশ কেজি । মিঠু দিনের বেলা ছাদে খুব একটা আসে না । বাসায় থাকলেও বিছানায় গড়ায় । দিনের বেলা ছাদে না আসার পেছনে একটা কারন আছে । বাড়িওয়ালার কাজের মেয়েটা চটাং চটাং কথা বলে । সবার সাথেই বলে । একবার তাকে ছাদে দেখে বলেছিল,

কেমন আছেন খালুজান ?

এই তুমি আমাকে খালুজান বলছ কেন ?

তো কি বলব, ভাইজান ?

কোন জানই বলার দরকার নাই । আমার সাথে তোমার কথা বলার দরকার কি ? যা বলার আমার বোনকে বলবে ।

তাকে তো বলা যাবে না । একটা শিল্লুক দিব, উত্তর বলতে পারলে ভাইজান বলব ।

মিঠু ছাদ থেকে চলে আসে । তার শিল্লুক কিংবা ভাইজান, কোন কিছু শুনার আগ্রহ নাই । মেয়েটা তখনও বলে চলেছে । শিল্লুক শুনবেন না ? সবার সামনে বলা যাবে না । শুধু আপনাকে বলব, বাসা খালী হলে ডাক দিয়েন । আপনার বোন বাইরে যায় না কেন ? খালি ঘরে বসে বসে টিভি দেখে । আমি ডিশের লাইন কাইট্টা দিমু ।

মিঠু ঘরে ঢুকেই শিলাকে দেখে । সে সব শুনেছে । শিলা বলে,

মিঠু শোন, এই বজ্জাত মেয়েকে কখনও ঘরে আনবি না ।

শিলা সব শুনেছে, তারপরও কেন কথাটা বলল মিঠু বুঝতে পারে না । সে শিলার দিকে তাকাতে পারে না ।

মিঠু, শিলার কথাটার কি অর্থ করবে ?

শিলা তাকে কোথায় নামিয়ে এনেছে ?

মিঠু নিজের জগতেই থাকে । তার উপস্হিতি কেউ টের পায় না । এক রকম ভাল, সে কোথাও নেই । শিলার ঘরে সারাক্ষণ টিভি চলছে । কেউ বাইরে থেকে কান পাতলে কেবল টিভির শব্দই শুনতে পাবে । শিলা ঘরের দরজা মাঝে মাঝে খুলে, ঘর থেকে বের হয় । বাসায় রান্নাও হয়, মাঝে মাঝে । ফ্রিজে রাখা থাকে, কেউ কাউকে খাওয়ার জন্য সাধে না, দরকার হলে নিজে গরম করে খেয়ে নেয়; বাংলাদেশের গ্যাসের সর্বোত্ত ব্যবহার । মিঠুর দুলাভাই আসলে অবশ্য অন্য কথা । শিলা তিন বেলা রান্না করে । সেই সময় অন্য একটা সমস্যা হয়, বোন-দুলাভাই ভালবাসা করার সময় এতো চেঁচামেচি করে, মিঠুর কান লাল হয়ে যায় । তাদের আশপাশে যে কেউ থাকতে পারে সেটা তাদের মনে থাকে না । একমাত্র ছেলে ঘুম থেকে জেগে কান্না জুড়ে দেয় । মিঠুর তাই মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়, সে জীবিত আছে তো ? মাঝে মাঝে চুপ করে দরজা খুলে ছাদের এক পাশে দাঁড়িয়ে থাকে । রাতের ঢাকা শহর দেখে । পাঁচতলা বিল্ডিং এর ছাদ হতে চারপাশ দেখতে ভাল লাগে । এখনও দক্ষিন দিক খোলা, পূর্ব আর উত্তর দিকে উঁচু উঁচু বিল্ডিং, দৃষ্টি ফিরে আসে । দক্ষিন দিকে প্রায়ই শব্দ শুনা যায়, পাইলিং এর শব্দ; খুব শিঘ্রই দক্ষিণ দিকেও উঁচু বিল্ডিং উঠবে ।

কাল রাতে কনার বিয়ে ছিল । বিয়ে ঠিক ঠাক হবার পর কনা কিছুই গোপন করেনি । পাঁচ বৎসরের সম্পর্ক তারা গত বৎসর শেষ করেছে । কনার প্রতি মিঠুর কোন রাগ নেই । খুশী মনেই বিয়ে খেয়ে এসেছে ।বিয়ের দাওয়াত দিতে এসে কনা পাঁচ হাজার টাকাও দিয়ে গেছে । বিয়েতে যেতে খরচ পাতি হবে । চাকুরী নেই, মিঠু টাকা পাবে কোথায় ?

রাখ, এই টাকাটা তুমি রাখ । কনা মিঠুর দিকে হাতটা বাড়িয়ে দেয় । সম্পর্ক চলা সময়ে তারা ডেটিংয়ে গেছে অনেক বার । খরচ পাতি তো হতোই । কনা কখনও জানতে চায়নি, মিঠু টাকা কোথায় পায় । মিঠুর তো চাকুরী নেই ।

এখন কনা বুঝতে পারছে । মিঠু জানে টাকা দেয়ার কারনটা ভিন্ন । সে টাকাটা হাতে নেয় । গুনে দেখে পাঁচ হাজার । মিঠু বুঝতে পারছে কনার ব্যাগে আরো টাকা আছে । কনা বিয়ের খরচ দেবার জন্য ব্যাগে করে আরো টাকা নিয়ে এসেছে ।

মিঠুকে নিয়ে কনার ভয় এক পাহাড় সমান । মিঠুর অস্হির লাগে ।

কি অবিশ্বাস !

কনা, মিঠুর মুখ বন্ধ করতে এই টাকা দিচ্ছে । তাদের সম্পর্কের দাম পাঁচ হাজার টাকা ? কণার বিয়ের সম্পর্কটা খুবই ভাল । কোন রকম ভুলে যেন হাত ছাড়া না হয় । কনার চেষ্টার কমতি নাই । মিঠু, একটু পরীক্ষা করতে চায় ।

তুমি পাঁচ হাজার দিলে ? তোমার বিয়ে উপলক্ষ্যে এক সেট স্যুট নেয়ার ইচ্ছা ছিল । কি করা যায় বলো তো ?

কাপড় সহ ত্রিশ হাজার টাকা তো লাগবেই । ভাবছিলাম তোমার সাথে আর একবার উত্তরা কটেজেও ঘুরে আসব ।

শেষ বার বলে কথা ।

কনা অনেকক্ষণ ধরে মিঠুকে দেখে । মিঠু তাকে ব্ল্যাকমেইল করছে । তার বিশ্বাস হচ্ছে না, মিঠু এমন কথা বলতে পারে । তবে, কনা ব্যাগে হাত দেয় । আরো পনের হাজার টাকা বের করে আনে । মিঠুর হাতে দেয় । দুই চোখে রাজ্যের ভয় । কনার চোখে ভয় দেখে মিঠুর কান্না পায় । এতোটুকু বিশ্বাস সে অর্জন করেছে ? একটা বার ইন্চি লম্বা কাঠের স্কেল থাকলে ভাল হতো ।

এক সময় প্রেমিকারা বিয়ের করার জন্য জেদ ধরতো । মরে যাবার ভয় দেখাত । মিঠু মজা করার জন্য শুধু বলেছিল,

আমাকে একবার বলে তো দেখতে ?

কি হতো ? তুমি কি বিয়ে করার অবস্হায় আছ?

মিঠু যা বুঝার বুঝে নেয় । কনার বর নির্বাচনে প্রি বলে একটা ব্যাপার আছে । পূর্ব যোগ্যতা ব্যাপার । সারটেন-স্ট্যান্ডার্ড থাকতে হবে । তবেই কনা তাকে নিয়ে ভাববে । মিঠুর সে যোগ্যতা নেই । বিয়ে পূর্ব প্রেম কেবলি প্রেম, সময় কাটানোর জন্য, নিজেদের সময়কে উপভোগ করা, যোগ্যতার কোন ব্যাপার নাই । পিছনে ফিরে দেখে মিঠু, সময়টা তারা বেশ উপভোগ করেছে । পরস্পরের জন্যই তারা সঠিক ছিল ।

হবু হব কি করে ?

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক । পিএইচডি করতে দেশের বাইরে যাবে ।

পনের হাজার টাকা মিঠু কনার হাতে ফেরত দেয় । বলে,

বাকি পাঁচ হাজার টাকা আমার কাছেই থাকুক । বলা তো যায় না, মানুষের মন । ঘুষ নিয়ে রাখলাম । মুখ বন্ধ থাকবে ।

কনা মিঠুকে জড়িয়ে ধরে । অনেক্ষণ ধরে রাখে, কান্না করে । মিঠুর কাছে কান্নাটা অভিনয় মনে হয় না । কান্না ছড়াতে থাকে । মিঠু কাঁদে না । তার একটা কাঠের স্কেল আছে ।

কাল রাতে কনাকে দারুন লাগছিল । সত্যিই কনা দারুন একটি মেয়ে, সব দিক থেকেই ।

একবার হাইকোর্টের সামনে দিয়ে যাবার সময় মিঠু রানুর মতো একজনকে দেখে । মিঠু ছিল মিনি বাসে । বাস থামে শাহবাগের সিগনালে । মিঠু দৌঁড়ে ফিরে আসে । রানুকে পায় না । তার কেন জানি মনে হয় তার বোনটা এমন কোন কাজ করে । বয়স আর সৌন্দর্য মানুষের এক প্রকার দূর্বলতা । মানুষের অনেক বিপদ ডেকে আনে । ক্ষুধার জ্বালাও অনেক । মানুষকে স্বাভাবিক চিন্তা ভাবনা করার সময় দেয় না ।

একবার রানুর খুঁজে সংসদ ভবনের সামনে গুড়া গুড়ি করা সময় পুলিশ মিঠুকে ধরে নিয়ে যায় । সারা রাত থাকে তেজগাঁও থানায় । সকালে পুলিশ এসে পকেট চেক করে । কোন টাকা পয়সা পায় না । ঘাড় বরাবর দুইটা থ্যাবড়া দিয়ে আরেক পুলিশকে বলে,

এরে বাইর কর । যত ঝামেলা ধরে আনস । সব ফকির মিসকিন । মরে গেলেও কেউ লাশ চাইতে আসবে না । পুলিশের শেষ কথাটা মিঠুর মনে ধরে । কথাটা সত্যি, মরে গেলেও কেউ তার লাশ চাইতে আসবে না । একজন জানলে আসতো, সে তার বোন; রানু । সে হারিয়ে গেছে ।

এই বাসা হতে বের হয়ে বড় রাস্তা পর্যন্ত গেলে হাতের ডান দিকে একটা কদম গাছ দেখা যায় । বর্ষা এস গেছে । মিঠু কাল দেখেছে কদমফুলে গাছটি ছেয়ে আছে । রানু কদম ফুল খুব পছন্দ করতো । মিঠু ঠিক করে এক সন্ধ্যায় বৃষ্টি শুরু হলেই সে বের হয়ে যাবে । এক মুঠো কদম ফুল নিয়ে রানুকে খুঁজবে । হাইকোর্টের কদম ফোয়ারা হতে শুরু করবে যাত্রা, রমনা, সোহরাওয়ার্দী হয়ে সংসদ ভবন, সব জায়গায় সে রানুকে খুঁজবে । এক বৃষ্টির রাতে তার বোনটা হারিয়ে গিয়ে ছিল । মিঠুর কেন জানি মনে হয় এমনি কোন বৃষ্টির রাতে সে তার বোনকে ফিরে পাবে ।

[email protected]

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :